ব্যাডমিন্টন এর নক্ষত্রপতন, অকালে তলিয়ে গেল মেমারি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র

সেখ সামসুদ্দিন : ২৪ মার্চঃ পূর্ব বর্ধমান জেলার ব্যাডমিন্টন জগতে কালো মেঘ নেমে এলো, নক্ষত্র পতন হলো। জেলা তথা রাজ্য ব্যাডমিন্টনে জেলার একদা চ্যাম্পিয়ন শেখ মহম্মদ মুসকান রায়নার শ্যামসুন্দর বহরমপুরের বাসিন্দা। শ্যামসুন্দর রামলাল আদর্শ বিদ্যালয় থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে গত বছর মেমারি কলেজে ভর্তি হয়, বর্তমানে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিল। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তঃ কলেজ ব্যাডমিন্টনের তৃতীয় নির্বাচিত হয়ে আন্তঃ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিযোগিতায় গত ৬ ডিসেম্বর ২০২২ খেলতে যায় মধ্যপ্রদেশে। ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি ছিল প্রবল আগ্রহ। পিতা সেখ মহম্মদ খুশিবর জেলা ব্যাডমিন্টন সংস্থার এক কর্মকর্তা তথা জেলা পর্যায়ের আম্পিয়ার হয়েছেন এই বছর। পিতা ছিলেন ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড়। খেলার নেশায় শীতের রাতে ক্লাবে ক্লাবে আম্পায়ারিং করতে যেতেন। ফলে ছেলেকে খেলোয়াড় বানাতে গ্রাম ছেড়ে শহরে আসেন। দরকার ছিল প্রশিক্ষণ, খেলার সামগ্রী, দিনমজুর পিতার পক্ষে বহন করা সম্ভব ছিল না। তৎকালীন বর্ধমান সদর দক্ষিণের মহকুমা শাসক অনির্বাণ কোলে এবং রায়না ১ এর তৎকালীন সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিক সৌমেন বণিক এর যুগ্ম সহযোগিতায় খেলা ছেড়ে দেওয়ার পরেও আবার নতুন করে শুরু করে। প্রথমে ডাঃ এন আই এস কোচ, জেলার সংস্থার সম্পাদক, ন্যাশনাল আম্পায়ার, স্পোর্টস মেডিসিন চিকিৎসক ডাঃ অরিন্দম বিশ্বাস, পরে এন আই এস কোচ সুহাস নাথ, সুব্রত দত্ত, সম্রাট দাস প্রমুখের হাতে কোচিং নেন। কিছুদিন পর কলকাতা সাই এসটিসিতে মোহন সামন্তর কাছে অনুশীলন শুরু করে। সাই এর এসটিসি স্কীম উঠে গেলে সমস্যা শুরু হয়। পরে কখনো বর্ধমান মেডিকেল কলেজ কোর্টে, কখনো আফতাব ক্লাব, কখনো সিন ক্লিয়ার রিসোর্ট বা কখনো কোচ অভিজিৎ রায়ের কাছে, পারিজাত নগরে প্রশিক্ষণ নেয়। ২০২৩ সালে জেলার লাইন জাজ পাস করে। শারীরিক শিক্ষার ছাত্রের জীবনের মূল লক্ষ্য ছিল এনআইএস কোচ হয়ে গ্রামে একাডেমি করে রায়না গ্রামে ব্যাডমিন্টনের উন্নতি সাধন করা। জীবনে খেলার আগ্রহ তৈরীর মূল কান্ডারী শ্যামসুন্দর রামলাল আদর্শ বিদ্যালয়ের শিক্ষক সুরজিৎ চ্যাটার্জী খেলার সরঞ্জাম দিতেন ও উৎসাহ দিতেন। সর্বদা আন্তঃ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিযোগিতায় যাবার পূর্বে কোচিং নেবার জন্য ২৪ পরগণাতে জাতীয় আম্পায়ার ও কোচ দেবব্রত পাল এর কাছে যায় বিবেকানন্দ ব্যাডমিন্টন একাডেমিতে আধুনিক প্রশিক্ষণ নেবার জন্য। সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন সাংসদ সুনীল মন্ডল এবং জেলা প্রশাসন। কিন্তু সব আশা নির্মূল করে জেলা ব্যাডমিন্টন সংস্থার নক্ষত্র পতন হলো গত বুধবার। কলেজ থেকে ফিরে নিজের গ্রামে একটি পুকুরে স্নান করতে গিয়ে সাঁতার কাটার সময় জলের অতল গভীরে তলিয়ে যায় ব্যাডমিন্টন তারকা। বাঁচাও বাঁচাও বলে ছটফট করেও শেষ রক্ষা হয় না, একজন দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলেও সকল প্রচেষ্টা বিফলে যায়। খবর দেওয়া হয় ডুবুরিদের, জাল ফেলে দুইবারের চেষ্টায় দেহ উদ্ধার হলেও ততক্ষণে জীবনহানি ঘটে যায়। মহেশবাটী গ্রামীণ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত বলে ঘোষণা করেন। গতকাল বর্ধমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে ময়নাতদন্ত করা হয়। রমজান মাসের শুরুর আগেই শেষ হয় তার জীবনের খেলা। দুই সন্তানের পিতা এক সন্তানকে হারিয়ে ছিল খুব ছোটতেই, আবার দ্বিতীয় সন্তানকেও হারিয়ে পাগলের মত অবস্থা।বিদ্যালয়ের শিক্ষক সুরজিৎ চ্যাটার্জী বলেন খেলার প্রতিভার থেকে খেলার সময় জেতার জন্য লড়াই করার অদম্য জেদ সত্যিই নজর কাড়া হলেও জীবন যুদ্ধে মাত্র ১৯ বছরে হার মানতে হলো নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাসে। পূর্ব বর্ধমান জেলা ব্যাডমিন্টন সংস্থা তথা বর্ধমান সদর সাউথ ব্যাডমিন্টন অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক ডাক্তার অরিন্দম বিশ্বাস বলেন, “দুঃখ প্রকাশ করার মত কোন ভাষা নেই, জেলা ব্যাডমিন্টনের বড় ক্ষতি হলো।” বৈঁচি ব্যাডমিন্টন ক্লাবের ওইদিনের টুর্নামেন্ট বাতিল করে শোকযাপন করেন খেলোয়াররা এবং পারিজাত নগরের ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড়রা রমজানের চাঁদ উঠলেও এদিন অন্ধকার নেমে আসে বাড়ির নিজের ব্যাডমিন্টন কোর্টে। বহরমপুর শ্যামসুন্দর গ্রাম যেন নিশ্চুপ, বাবা-মার চোখে জল।