বাঙালি মুসলমানের আপন ভুবনের সন্ধান চলুক নবীন প্রজন্মের জন্যও

সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায়: ব্যক্তিগত কথা দিয়েই শুরু করি। ১৯৮০র দশকে কলকাতার একটি সরকারি স্কুলে পড়তাম। বিভিন্ন স্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক এবং খেলার কর্মকাণ্ডের জন্য যেমন ছাত্রদের কয়েকটা হাউসে ভাগ করা হয়, সেই স্কুলেও সেরকম ছিল। প্রত্যেক হাউসের নির্দিষ্ট পরিচয়জ্ঞাপক রঙের রিবন আর ব্যাজ ছিল। প্রত্যেক হাউস বাংলার এক একজন মনীষীর নামাঙ্কিত ছিল। লাল রঙের রিবন আর ব্যাজ ছিল রামমোহন হাউসের। সবুজ রং ছিল বিদ্যাসাগর হাউসের। ভূদেব হাউসের ছিল হলুদ রং। আর নীল রঙের রিবন আর ব্যাজ ছিল মহসীন হাউসের। সমাজ সংস্কারক রামমোহন রায় আর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কথা তো ছোট থেকেই জানতাম। ভূদেব মুখোপাধ্যায় আর হাজী মহম্মদ মহসীনের নামের সঙ্গে পরিচয় ওই স্কুলে গিয়েই হয়েছিল। ভূদেব মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে পরে আরও জানার সুযোগ ঘটেছে। কিন্তু মহসীন সম্পর্কে বিশদে জানার সুযোগ অন্তত বাংলা সাহিত্য বা ইতিহাসের পাঠ্যসূচী করে দেয়নি। তাও সেই সরকারি স্কুলের কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ দেব কয়েক হাজার ছাত্রর মধ্যে মহসীনের নামটা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য। তা না হলে হয়তো শিশুমনে এই ধারণাই পোক্ত হয়ে যেত যে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যে বাঙালি মুসলমানের অবদানের কোনও অস্তিত্বই নেই। আর ঠিক এই প্রশ্নটাই তুলেছেন, তুলছেন আর তুলে চলেছেন খাজিম আহমেদ। একের পর এক “বাঙালি মুসলমান”-এর ইতিহাস লিখেছেন তিনি, “বাঙালি মুসলমান : আপন ভুবনের সন্ধানে”। আর সেই ইতিহাস লিখতে গিয়ে সঙ্গতভাবেই মন্তব্য করেছেন, “আত্মবিস্মৃত বাঙালি জাতি তাঁকে ভুলে গেছে। বাংলার জাগরণের খণ্ডিত ইতিহাসে তাঁর অবদানের কথা আলোচিত হয়নি। এত বড়মাপের ব্যক্তিত্বকে উপেক্ষা করে উনিশ শতকের বাংলার ইতিহাস রচনা হাস্যকর। বেদনাদায়ক তো বটেই।” তাঁর এই মন্তব্য নবাব আব্দুল লতিফ খান সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে। তবে একই কথা প্রযোজ্য হতে পারে অন্য “বাঙালি মুসলমান”-দের ক্ষেত্রেও। বস্তুত, এই “বাঙালি মুসলমান”-দের জীবন ও কাজের সঙ্গে পরিচয় পাঠ্য ইতিহাস পাঠের মাধ্যমে বাঙালিদের ঘটে না। মহসীন হাউস বা সৈয়দ আমির আলি এভিনিউ-এর কথা শুনে কেউ যদি তাঁদের সম্বন্ধে জানতে চান তাঁদের কথা স্বতন্ত্র।

    আজকের ইন্টারনেটের যুগে হয়তো তাঁদের সম্বন্ধে কিছু তথ্য পাওয়া যাবে তবে তার প্রামাণ্যতা সম্পর্কে প্রশ্নও থেকে যাবে। আর সেখানেই খাজিম আহমেদের বইটির গুরুত্ব। তিনি অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় এই মানুষদের সম্পর্কে তথ্যনিষ্ঠ বর্ণনা পেশ করেছেন। বইটা পড়তে পড়তে আত্মদর্শনও হচ্ছিল। দু’দশকের বেশি সময় ধরে ইতিহাসচর্চার সঙ্গে পেশাগতভাবে জড়িয়ে থাকলেও আমাদের তো এই সব জীবন সম্পর্কে পড়াতে বা পড়তে হয়নি। অর্থাৎ বলতে চাইছি, এই বিষয় কোনও পাঠ্যসূচিতে বাধ্যতামূলক ছিল না। আগ্রহ থেকে পড়ার কথা এই হিসেবের মধ্যে ধরছি না। আসলে যেকোন বিষয়ের তো ব্যতিক্রমও থাকে। বেশ মনে পড়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এ পড়ার সময় আমার এক মাস্টারমশাই খুব বিশদে পড়িয়েছিলেন সৈয়দ আমির আলি আর আব্দুল লতিফের ইতিহাস, বিশ্ববিদ্যালয়স্তরে বড় বিষয়ের মধ্যে বিশেষ কিছু বিষয় পড়ানোর যে স্বাধীনতা শিক্ষকের থাকে, তাকে ব্যবহার করে।

    স্বল্প পরিসরে খাজিম আহমেদের বইটি সম্পর্কে বিশদ আলোচনার অবকাশ নেই। শুধু আগ্রহীদের পড়ার ইচ্ছে উসকে দেওয়ার জন্যই পাঠকদের জানিয়ে দিতে চাই কোন কোন বাঙালি মুসলমানের জীবনকথা তুলে ধরেছেন খাজিম আহমেদ। আগে উল্লেখ করা এই তিনজন ছাড়া এই তালিকায় রয়েছেন মর্যাদার অন্বেষক হুমায়ুন কবির, যিনি না থাকলে পশ্চিমবঙ্গে প্রথম অ-কংগ্রেসি মন্ত্রীসভা গড়ে উঠত না। রয়েছেন উপমহাদেশের বাংলা সাংবাদিকতার অগ্রনায়ক আবুল কালাম শামসুদ্দিন, সম্প্রীতির প্রতীক রেজাউল করিম, সাহিত্যসাধক এম আব্দুর রহমান। তালিকায় আরও অনেক নাম থাকতে পারত। কিন্তু লেখক তাঁর নিজের মাপকাঠি নির্মাণ করেছেন। তাঁর মতে যাঁরা সাধারণ মুসলমানমহলে সুপরিচিত তিনি তাঁদেরকেই বেছে নিয়েছেন। সেকারণেই এই তালিকায় নেই দার্শনিক ভাবুক আব্দুল ওদুদ। খাজিম আহমেদের ভাষায় “শাশ্বত ও সৃজনশীল বাংলার বৌদ্ধিক জগতটি তাঁর চিন্তাভাবনার দ্বারা কিঞ্চিৎ প্রভাবিত হলেও সাধারণ মানুষ তাঁর দর্শন ভাবনা সম্পর্কে পরিচিত ছিল না”। একইভাবে বাদ আবু সৈয়দ আইয়ুব কারণ তাঁকে “সাধারণ মুসলমানরা চিনত না”। এই মাপকাঠির সঙ্গে আমরা ভিন্নমত হতেই পারি তবে এটা মানতেই হবে যে ব্রিটিশ শাসনে বাংলায় হিন্দু সমাজে যেমন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজ গড়ে উঠেছিল মুসলমান সমাজে সেরকম প্রক্রিয়া আদৌ গড়ে ওঠে নি। যেটুকু গড়ে ওঠার চেষ্টা হয়েছিল তাও অনালোচিত এবং অনালোকিত থেকে গেছে।

    স্বভাবতই অসম্পূর্ণ থেকে গেছে জাতির প্রকৃত ইতিহাস। লেখক সঙ্গত কারণেই মন্তব্য করেছেন, “একটি জাতির প্রকৃত ইতিহাস পুরো জাতির সামনে তুলে না ধরলে ক্ষোভের উদ্রেক স্বাভাবিক। সেই ক্ষোভ আর উপেক্ষা থেকেই উদ্ভূত হয় সংখ্যালঘুদের মনে এক বিশেষ ধরনের অস্বস্তিকাতরতা।” টয়েনবির তত্ত্বর উল্লেখ করে লেখক বলেছেন, “সেই অস্বস্তিকাতরতা থেকেই বিচ্ছিন্ন মানসিকতার উদগমন সম্ভব হয়ে ওঠে।” আর সেই বিচ্ছিন্নতাকে প্রতিরোধ করতে গেলে আরও বেশি করে পাল্টা কথা বলতে হবে। আর ঠিক সেই কারণেই গুরুত্বপূর্ণ সুবে বাংলার নিজামত প্রশাসনে আসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারার ওপর আলো ফেলা। জরুরি, অন্তহীন অসহিষ্ণুতার আবহের স্বরূপ উদ্ঘাটন করা আবার একই সঙ্গে ধর্মীয় সন্ত্রাস আর মানসিক অন্ধতার বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষ ভাবধারার ইতিহাস তুলে ধরা। একটা বইয়ের পক্ষে এত দায় পালন করা কঠিন তবে আশ্চর্যের বিষয় খাজিম আহমেদ সেই কঠিন কাজ অক্লেশে করেছেন। শুধু বাঙালি মুসলমানের মধ্যে তিনি তাঁর আলোচনাকে সীমায়িত করেন নি। ভাবনাচিন্তা করেছেন ভারতের মুসলমানদের জন্য। বইতে হাজির আবুল কালাম আজাদ; লেখকের ভাষায়, যিনি ছিলেন “এক নিঃসঙ্গ পদাতিক”।

    বইতে উদার আকাশ-এর প্রকাশক ফারুক আহমেদ যে প্রকাশকের কথা লিখেছেন তাও অতি মূল্যবান যা বইয়ে প্রবেশকের কাজ করে। আশা করব, ভবিষ্যতে প্রকাশক বাঙালি মুসলমানের আপন ভুবন সন্ধান করার আরও উদ্যোগ নেবেন। সেখানে নিশ্চয়ই আরও বেশি সংখ্যক উল্লেখযোগ্য মানুষের জীবন ও কাজ বিশ্লেষণ করা হবে। এই কাজ যদি নবীন প্রজন্মের দিকে তাকিয়ে করা হয় তবে নিঃসন্দেহে তা আরও অর্থবহ হয়ে উঠবে। আর সেজন্যই দরকার ছোটদের জন্য এই বিষয়ে বিশেষভাবে লেখা বই; তবেই তো খণ্ডিত ইতিহাস, আর প্রকৃত ইতিহাস বলে প্রচারিত হতে পারবে না।