|
---|
জাকির হোসেন সেখ, নতুন গতি, ২৬ অক্টোবর: নরেন্দ্র মোদী তথা কেন্দ্রের অস্বস্তি বাড়িয়ে আজ সুপ্রিম কোর্ট বলল, অপসারিত সিবিআই প্রধান অলোক ভার্মার বিরুদ্ধে তদন্ত করবে সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ কে পটনায়েকের তত্বাবধানে সিভিসি অর্থাৎ সেন্ট্রাল ভিজিলেন্স কমিশন। এবং দু’সপ্তাহের মধ্যে শেষ করতে হবে সেই তদন্ত। আর এই সময়সীমার মধ্যে অর্থাৎ আগামী ১২ ই নভেম্বর পরবর্তী শুনানির আগে পর্যন্ত্য কোনও রকম পলিসি সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না মোদী দ্বারা নবনিযুক্ত সিবিআই প্রধান নাগেশ্বর রাও।
মোদ্দা কথায় সুপ্রিম কোর্টের রায় ছিল আজ এটাই।
দূর্নীতিতে জড়িয়ে পড়া সিবিআই নিয়ে কী হবে আজ সুপ্রিম কোর্টে ? তাই নিয়ে ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের দিকে তাকিয়েছিল গোটা দেশ। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘’অ্যাসিড টেস্ট’’, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্যের ডিভিশন বেঞ্চের অবস্থায়ও হয়েছিল ঠিক সে রকম। বিশেষ করে রঞ্জন গগৈ দেশের সর্বোচ্চ আদালতের শীর্ষ পদে বসার পর এই প্রথম তাঁর দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে ছিল শাসক ও বিরোধীদল তো বটেই, এমনকি শাসক-বিরোধী কোনো দিকে না থাকা সাধারণ শান্তিপ্রিয় অথচ সজাগ মানুষও। আজ শুক্রবার সুপ্রিম কোর্টের অন্তর্বর্তী এই রায়দানের ফলে আপাত দৃষ্টিতে মোদীর মুখই পুড়লো বলে সব মহল মনে করছে।
সম্ভবত ১২ নভেম্বর পরবর্তী শুনানির দিন নির্ধারিত হতে চলেছে দেশের সবচেয়ে দক্ষ, সেরা ও ক্ষমতাবান বলে পরিচিত গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআইয়ের ভাগ্য। যার পদাধিকারবলে থাকা দু’নম্বর কর্তা রাকেশ আস্থানার বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগে সরিয়ে দেয়ার জায়গায় উল্টে তাকে বাঁচাতেই শুধু নয় বরং নিজেও বাঁচতে ২৩ অক্টোবর মঙ্গলবারের গভীর রাতে রাকেশ আস্থানার সাথে সাথে সিবিআইয়ের ডিরেক্টর অলোক ভার্মা সহ আরো ১৪ জন কর্মকর্তাকে ছেঁটে ফেলা হয়েছিল। অলোক ভার্মার স্থলে নিয়োগ করা হয়েছিল মোদী ঘনিষ্ঠ নাগেশ্বর রাওকে।
অলোক ভার্মা, বাধ্য হয়ে পরের দিন সকালেই ২৪ অক্টোবর ন্যায়বিচারের আশায় দ্বারস্থ হন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের এজলাসে। সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর স্থগিতাদেশ চেয়ে তাঁর অভিযোগ, সংস্থার স্বাধীন ও স্বশাসিত চরিত্রকে সরকার খর্ব করেছে। এবং তা করা হয়েছে এই আশঙ্কায় যে, কিছু অতি স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগের তদন্ত সরকারের স্বার্থের বিরুদ্ধেই চলে যাচ্ছিল। মইন কুরেশির থেকে দুকোটি টাকা ঘুষ নেয়ায় অভিযুক্ত রাকেশ আস্তানার বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগ, বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি সংস্থার কাজে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তদন্তকারী কর্মকর্তাদেরও বদল করে দেওয়ার অভিযোগ এনেছিলেন অলোক ভার্মা। এই আবেদনের মীমাংসা কীভাবে করে সুপ্রিম কোর্ট, আগ্রহ জমাট বেঁধেছিল তা ঘিরেই। কারণ অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলার তদন্ত অতঃপর কোন দিকে এগোবে তা নির্ভর করছিল এই রায়ের ওপরেই।
সবচেয়ে বড় আগ্রহটা ছিল রাফাল কেনাবেচার দুর্নীতি নিয়ে। এই বিষয়টা রাজনীতিতে এখন টগবগ করে ফুটছে। ফ্রান্সের এই যুদ্ধবিমান কেনাবেচার বিষয়টা শুরু হওয়া ভোটের মরসুমে বিজেপিকে কোনঠাসা করে তুলেছে। দুর্নীতির অভিযোগে কংগ্রেস দল সরাসরি কাঠগড়ায় তুলে দিয়েছে খোদ প্রধানমন্ত্রীকেই। রাফাল হয়ে দাঁড়িয়েছে বিজেপির গলার কাঁটা। এক সময়ের বিজেপি দলের সদস্য তথা মন্ত্রী অরুণ শৌরি এবং যশবন্ত সিনহা আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণকে সঙ্গে নিয়ে অলোক ভার্মার কাছে রাফাল কেনাবেচার দুর্নীতির তদন্ত করার আর্জি জানিয়ে এসেছিলেন মাত্র কিছুদিন আগে। জমা দিয়েছেন ১৩২ পৃষ্ঠার নথি। তদন্তের দাবি কংগ্রেসেরও। অলোক ভার্মা অপসারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রাফাল নিয়ে আবার ওই তিনজন বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের কাছে গিয়েও নতুন করে আরজি জানিয়ে এসেছিলেন। কংগ্রেস সভাপতি রাখঢাক না রেখেই বলেছেন, রাফালের তদন্তের দিকে এগোচ্ছিলেন বলেই অলোক ভার্মাকে মোদি সরকার সরিয়ে দিয়েছে। সরে যাওয়ার আগে যে অভিযোগগুলো অলোক ভার্মা বিবেচনা করছিলেন, সেই তালিকায় রাফাল সবার ওপরে।
আর মেডিকেল কাউন্সিল ঘুষকাণ্ড মামলা ছিল সেই তালিকায় দ্বিতীয়। হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ইসরাত মাসরুর কুদ্দুসিকে চার্জশিট দিতে সিবিআই প্রস্তুত। অপেক্ষা শুধু অলোক ভার্মার অনুমতির। এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি এস এন শুক্লর বিরুদ্ধেও রয়েছে টাকা নিয়ে ডাক্তারিতে ভর্তি করানোর অভিযোগ। অভিযোগ ওঠার পরেই তাঁকে ছুটিতে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। তদন্তে সিবিআই রাজি। প্রয়োজন ছিল শুধু ডিরেক্টরের সম্মতি। অর্থাৎ অলোক ভার্মার সম্মতি। কিছুদিন আগেই কেন্দ্রীয় অর্থ ও রাজস্ব সচিব হাসমুখ আধিয়ার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ এনেছেন বিজেপির নেতা সুব্রামনিয়াম স্বামী। তদন্তের জন্য সিবিআইকে আরজিও জানিয়েছেন। সেই বিষয়েও সিদ্ধান্ত ঝুলে রয়েছে। ঝুলে রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের এক আমলার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগও।
সবথেকে বড়ো কথা,এই অবস্থায় অনিশ্চিত হয়ে গেছে, সিবিআইয়ের ২ নম্বর কর্মকর্তা রাকেশ আস্তানার বিরুদ্ধে আনা অলোক ভার্মার অভিযোগ গুলোর ভাগ্যও। রাকেশ আস্তানার বিরুদ্ধে যাঁরা তদন্ত করছিলেন, তাঁদের সবাইকেই বদলি করেছেন মোদী। সুপ্রিম কোর্টের আজকের রায় তাই খানিকটা হলেও অলোক ভার্মার পক্ষে গেল বলে মনে করা হচ্ছে।
তবে সারদা নারদা নিয়ে বাড়াবাড়ি করা সিবিআইয়ের গায়ে যে কালো দাগ লেগে গেল, বা যেভাবে এই সংস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা ঘিরে প্রশ্ন উঠেগেল, কীভাবে তার মেরামত হবে সেই ধারণা আপাতত কারও নেই। আপাতত এটাই স্বস্তির যে কলেজিয়াম প্রথা ভেঙে অলোক ভার্মার অপসারণ এবং তার জায়গায় মোদীর নিযুক্ত নাগেশ্বর রাওকে সুপ্রিম কোর্টের অন্তর্বর্তী রায়ে ঠুঁটো জগন্নাথ করে রাখা।