চলে গেলেন কবি বেগম সুরাইয়া কামাল

খায়রুল আনাম : কবি বেগম সুরাইয়া কামাল আর নেই। কলকাতার জিডি হসপিটালে গতকাল বিকাল পাঁচটা নাগাদ না ফেরার দেশে চলে গেলেন তিনি। চল্লিশটারও বেশি পত্র পত্রিকায় তিনি লেখালেখি করেছেন। প্রবন্ধ, কাব্য, গল্প সংকলন তিনটির প্রকাশ তিনি দেখে যেতে পারলেন না। বেগম সুরাইয়া কামাল ১৯৪৪ সালের ২৪ জুলাই মাতুলালয় বর্ধমানের জেলার মঙ্গলকোটের ঝিলু গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । পূর্ব বর্ধমান জেলার কেতুগ্রামের কুচুটিয়ার মেয়ে বেগম সুরাইয়ার বিবাহ হয় কুচুটিয়াতেই পারিবারিক সূত্রে আত্মীয় গোলাম সোবহান কামালউদ্দিনের সঙ্গে। লেখালেখির বিষয়ে যিনি ছিলেন তাঁর প্রধান প্রেরণাদাতা। মিষ্টভাষী সুরাইয়া কামাল আব্দুল আজিজ আল আমান ও মহাশ্বেতা দেবীর স্নেহধন্য ছিলেন।
বেগম সুরাইয়া কামাল আর্থিক ভাবে পিছিয়ে থাকা মহিলা ও শিশুদের কল্যাণে নবনীড় নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা গড়ে তোলেন। তিনি তাঁর সৃষ্টি ও সমাজসেবামূলক কাজের জন্য জিরো পয়েন্ট পুরস্কার(২০০৭), মহিলা সাংস্কৃতিক সংঘ পুরস্কার(২০১০) পেয়েছিলেন। এমদাদুল হক নূর সম্পাদিত নতুন গতি পত্রিকার পক্ষ থেকেও তাঁকে সংবর্ধনা (২০১২) জানানো হয়। লেখেছেন বর্তমান, যুগান্তর, আজকাল, ওভারল্যান্ড, বঙ্গলোক, কাফেলা, নতুন গতি, কলম, বুলবুল প্রভৃতি পত্রিকায়। সেই সব সৃজন সৃষ্টি গুলিকে তিনি সংকলন আকারে প্রকাশের প্রচেষ্টায় নিয়োজিত ছিলেন জীবনের শেষ দিন গুলিতে। তাঁর সান্নিধ্যে পাওয়া যেত এক মাতৃ হৃদয়। রান্না করতে ভালবাসতেন। ভালবাসতেন মানুষকে খাওয়াতেও। লেখেও ফেলেছিলেন আস্ত দুটি বই। বাদশাহি রান্না ও রকমারি রান্না। প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা লেখার ক্ষেত্রেও ছিল তাঁর অসাধারণ দক্ষতা। মুসলিম সমাজের প্রাচীন ঘরানার মেয়ে হয়েও তিনি আধুনিক মনের মানুষ ছিলেন। মহিলা ও সমাজের এগিয়ে থাকার ব্যাপারে ভাবতে পারতেন অনেকটা এগিয়ে।
বেগম সুরাইয়া কামাল প্রকৃতির সৃষ্টি দেখে সৃষ্টির প্রেরণা পেতেন। তাঁর কবি মনের জন্যই নিজের বাড়িতে বানিয়ে ফেলেছিলেন ফুলে ফুলে সুরোভিত এক উদ্যান। কলকাতা, বর্ধমান, কুচুটিয়া কেটে যেত সময়।অসম্ভব জীবনীশক্তি ছিল তাঁর। সেখান থেকেই পেতেন সৃষ্টির নেশা, জীবনের উৎসাহ । তাঁর কবিতার কল্পলোক থেকে কয়েকটি কাব্যিক লাইন, –
কনক – কমলে গড়েছে ঈশ্বর,
হে সুতুনু! তুমি বেড়ে ওঠো
ঈশ্বরিক প্রতিভায়, প্রজ্ঞায়।
শুভ উজ্জ্বল স্বমহিমায়,
চির নবীন, চির নূতন, –
হও ভাস্বর, অনন্য গুণ সুধায়।
বেগম সুরাইয়া কামালের সৃষ্টির মূল্যায়ন হবে আগামী দিনে। মুসলিম মহিলাদের সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে অবদানের বিষয়ে গবেষকের বিষয়বস্তু হয়ে উঠবে তাঁর কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প । তিনি রেখে গেলেন দুই মেয়ে দুই ছেলে। তাঁদের সন্তান সন্ততিদের। রেখে গেলেন অসংখ্য আত্মীয়, গুণমুগ্ধ। তাঁর প্রতি সম্মান জানাতে এবং তাঁর সৃজনশীল সৃষ্টি গুলিকে আগামী প্রজন্মের জন্য সংরক্ষিত করতে সংকলন গুলির দ্রুত প্রকাশের ব্যবস্থা করা কর্তব্য । সমাজের জন্য যে সম্পদ তিনি রেখে গেলেন তার সংরক্ষণ জরুরি। সদাহাস্যময়ী, মাতৃ মূর্তির বিরল হৃদয়ের এই মানুষটি যে চেতনার আলো অবলোকন করেছিলেন, সেই আলোই ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন সমাজের মধ্যে। স্বাধীনতা পরবর্তী যুগে যে কয়েকজন মুসলিম মহিলা বৌদ্ধিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সাহিত্য সংস্কৃতি জগতে পা দিয়ে বহু বাধা উপেক্ষা করে সারস্বত সাধনায় এগিয়ে এসেছিলেন তাঁদের সঙ্গে উচ্চারিত ও চর্চিত হবে বেগম সুরাইয়া কামালের নাম। লেখা থাকবে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে।