ধারাবাহিক: তৃতীয় পর্ব

সিরিয়া সন্ধানে

    কলমে:মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ

    সিরিয়ার ইতিহাস খনন করলে পূর্বে উল্লিখিত আলাউয়ি, সুন্নি, শিয়া ছাড়াও ইসমাইলী ও দ্রুজ জাতির অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়।এই পর্বে সংক্ষেপে ইসমাইলী ও দ্রুজ জাতির বিবরণ দেওয়া হল-

    ইসমাইলী মুসলিম:
    সিরিয়ার ইতিহাস আলোচ্য বিষয় হলে আলাউয়িদের পাশাপাশি ইসমাইলিদের গুরুত্ব কোন অংশে কম নয়।শিয়াদের ইমাম নিয়ে তারা প্রধান দুই ভাগে বিভক্ত ;একদল ১২ ইমামে বিশ্বাসী যারা দ্বাদশবাদী শিয়া নামে পরিচিত অন্যদিকে একদল ৭ ইমামে বিশ্বাসী যারা সপ্তবাদী নামে পরিচিত।।সাত ইমামে বিশ্বাসী অর্থাৎ সপ্তবাদীদের মতে সপ্তম ইমাম হলেন ৬ষ্ঠ ইমাম জাফর আস সাদিকের বড় ছেলে ইসমাইল যাকে তিনি প্রথমে ইমাম হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছিলেন।কিন্তু পরবর্তিতে তাঁর মৃত্যুর পর বাবা ২য় ছেলে ইসমাইলের ছোট ভাই মুসাকে ইমাম পদে অভিষেক করান।সপ্তম ইমাম মুসাকে ইমাম হিসেবে যারা মেনে নিয়ে পরবর্তী ১২তম ইমামকে ইমাম মাহদি হিসেবে শেষ ইমাম মেনে চলেন তারা দ্বাদশ ইমামে বিশ্বাসী শিয়া বা দ্বাদশবাদী শিয়া।দ্বাদশবাদীরা ইমাম মাহদির আগমনে খুবই আবেগপ্রবণ।আর যারা ইসমাইলকে অদৃশ্য হয়ে আছেন মনে করেন এবং এও মনে করেন যে যে কোন সময় তিনি পাপপূর্ণ সমাজ সংস্কারের জন্য জগতে ইমাম মাহদি রূপে হাজির হবেন এবং মুসা নয়,বরং ইমাম মাহদিকেই একমাত্র বৈধ ইমাম বলে বিশ্বাস করেন তারাই ইসমাইলীয় শিয়া নামে পরিচিত।পৃথিবীর ভূখন্ডের দিকে নজর দিলে, ইসমাইলিদের উপস্থিতি সিরিয়ার পাশাপাশি ভারত ও উত্তর আফ্রিকার বেশ কিছু রাজ্যে পরিলক্ষিত হয়।যেমন উত্তর আফ্রিকার ফাতেমি খেলাফত,আলামুত দুর্গের গুপ্তঘাতক

    সম্প্রদায়,ভারত বর্ষের খাজা ও সর্বশেষ আগা খান, উনারা সকলেই ইসমাইলি সম্প্রদায়ের মানুষ ছিলেন।হালাকু খান আলামুত দুর্গ ধ্বংস করে নির্বিচারে তাদের হত্যা করা শুরু করলে পালিয়ে পুর্ব দিকে ভারতে ও দক্ষিণ দিকে বাহরাইন বা আরো দক্ষিণে দক্ষিণ আরব ইয়েমেনে চলে যায়।আর ভারতে যারা আসেন তারা সুন্নি মুসলিম শাসকদের নির্যাতন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রকাশ্যে হিন্দু ধর্মের আচার আচরণ পালন শুরু করলেন।এভাবে ভারতে ধর্মীয় নতুন মাত্রা সৃস্টি হয়।এছাড়াও ভারতীয় মুসলিম সংস্কৃতির নতুন ধারা সুফিবাদের মজ্জুব শাখা প্রসারে তাদেরই অবদান বেশি বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।তবে সালিক শাখার খেলাফত ধারণাটিও তাদের থেকেই চলে এসেছে বলে পন্ডিতদের বিশ্বাস।

    দ্রুজ সম্প্রদায়:
    আরবি শব্দ ‘দরজি’ থেকে দ্রুজ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে।দ্রুজরা সাধারনত একেশ্বরবাদী হয়ে থাকে অর্থাৎ তারা এক ঈশ্বরের উপাসনা করে এবং এক ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস স্থাপন করে।দ্রুজরা সাধারণত সামাজিক সম্প্রদায় হয়ে থাকে। দ্রুজরা বাস করে সিরিয়া, লেবানন, ইসরাইল, ও জর্ডানে।দ্রুজরা তাদের নিজস্ব ধর্মের আবেদন করে কিন্তু দ্রুজ ধর্মকে আলাদা ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয় না। কারণ এই ধর্মের ভিত্তিমূল ইসলাম। দ্রুজ ধর্ম মূলত শিয়া ইসলামের একটি শাখা। দ্রুজদের ধর্ম বিধানে ইব্রাহিমীর ধর্মসমূহের পাশাপাশি নিওপ্লাতিনিক এবং পিথাগোরীয় মতবাদের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। দ্রুজগণ নিজেদেরকে “আহলে তাওহীদ” (একেশ্ববাদী মানুষ ) বলে দাবি করে।

    লেবাননে দ্রুজদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।কারণ লেবাননের ইতিহাস গঠনে দ্রুজদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দ্রুজদের সামাজিক রীতিনীতি মুসলমান,হিন্দু, খ্রিস্টান,ইহুদীদের থেকে ভিন্ন।

    সিরিয়া তথা মধ্যপ্রাচ্যের ছাড়াও দ্রুজরা ইউরোপ,কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, লাতিন আমেরিকা, যুক্তরাষ্ট্র এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় বাস করে। দ্রুজদের প্রধান ভাষা হল আরবি,তারা আরবি ভাষাতেই কথা বলতে পছন্দ করে।এরা মূলত প্রাচ্যীয় ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের সামাজিক রীতিনীতি অনুসরণ ও অনুকরণ করে।সর্বশেষ আদম-শুমারি অনুযায়ী পৃথিবীতে দ্রুজ অনুসারীগণের সংখ্যা প্রায় এগারো লাখ।দ্রুজরা সাধারণত বিশ্বাস করে যে আল্লাহ হচ্ছে ঈশ্বর প্রেরিত দূত(নাউযুবিল্লাহ)।এও বলা হয় যে দ্রুজ নামটি এসেছে মুহাম্মাদ বিন ইসমাইল নাশতাকিন আদ-দারাজীর নাম থেকে। দারাজী শব্দটি একটি ফারসি শব্দ। আদ-দারাজী ছিলেন প্রাক দ্রুজ যুগের একজন সন্ন্যাসী ও দ্রুজ- প্রচারক। দ্রুজগণ সাধারণত আদ-দারাজীকে ধর্মগুরু মনে করে এবং নিজেদেরকে দ্রুজ বলে আখ্যায়িত করে।ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে,প্রথম দিকে আদ-দারাজী তাঁর মতবাদ প্রচার করতেন গোপনে।

    তিনি গোপনে প্রচার করতেন সৃষ্টিকর্তা বা আল্লাহ মানুষের মাঝে বসবাস করেন। বিশেষ করে হযরত আলী (রাঃ) এবং তার বংশধরদের মাঝে। তৎকালীন খলিফা আল-হাকিম বি-আমর আল্লাহ’র মাঝেও সৃষ্টিকর্তা আছেন বলে প্রচার করেন(নাউযুবিল্লাহ)। আদ দারাজী নিজেকে ‘বিশ্বাসের তরবারি’ ঘোষণা করেন এবং তাঁর অনুসরনকারীদের তাঁর কথা নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করতে বলেন।

    সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আদ দারাজি ও তার অনুসারীরা সাহসী হয়ে ওঠেনএবং ১০১৬ সালে আদ দারাজি এবং তার অনুসারীগণ প্রকাশ্যে তাদের বিশ্বাস প্রচার করতে শুরু করেন এবং জনসাধারণকে তাদের এই ধর্মমত গ্রহণের ডাক দেন।তাই মিশরে তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। এই কারণে প্রায় বছরখানেক আদ-দারাজীর কার্যক্রম বন্ধ থাকে।পরবর্তীতে আদ-দারাজী আততায়ীর হাতে ১০১৮ সালে আটক হন এবং পরবর্তীতে নিহত হন।ইতিহাসের কোন কোন উৎস দাবী করে যে দ্রুজদের এই মহান নেতা আল-হাকিম বি-আমর আল্লাহ তাঁকে হত্যা করেছে।

    আবার অনেকে মনে করেন যে ‘দ্রুজ’ শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ ‘দারেশাহ'(যিনি শিক্ষাগ্রহণ করেন) থেকে।বেঞ্জামিন টুডেলা একজন ইহুদি প্রথম ইউরোপীয়ান ভ্রমণকারী হিসেবে ১১৬৫ সালে লেবানন অথবা এর আশপাশ অতিক্রম করার সময় দ্রুজদের দেখা পান। তিনি দ্রুজদের ‘দগজিইন’ নামে সম্বোধন করতেন। তিনি বিশেষ ভাবে উল্লেখ করেন যে দ্রুজরা ছিল পাহাড়চারী ও একেশ্বরবাদী জাতি যাদের পরমাত্মার উপর বিশ্বাস ছিল প্রবল।