আমি চাই আমার কথাটা মানুষকে বলে যেতে: ইরফান

সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

    মৃত্যু তো তাঁর হয়, যে মুছে যায়।

    হলিউড বলিউডের স্বনামধন্য অভিনেতা হিসেবে নয়,

    একশ ছবিতে  অসাধারণ অভিনয় করেছেন বলে তিনি বেঁচে থাকবেন, সেটাও না। অনেক বেশি ছবি করে মানুষের মন থেকে হারিয়ে গেছেন এমন অভিনেতা কম নেই। কিন্তু ইরফানের মৃত্যু নেই! কেন? কারণ ইরফান নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন শুধু অভিনয় করে নয়, সেলুলয়েড এবং সেলুলয়েডের বাইরে নিজেকে এক অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। হতে পারে তাঁর অনেক বক্তব্য বিতর্কিত, কিন্তু যেটা ভেবেছেন সোজাসাপ্টা বলেছেন। জীবন সত্যের প্রতি তাঁর অবিচল আস্থা ছিল।বলিউডের অন্যান্যদের মত তিনি মানুষের মন বুঝে জনপ্রিয়তা অর্জনের চেষ্টা করতেন না। চুলগুলো যেমন তার উস্কোখুস্কো ছিল, জীবনের বাইরেটাও উস্কোখুস্কো করে রাখতে ভালোবাসতেন। একজন বিখ্যাত আন্তর্জাতিক অভিনেতা হওয়া সত্ত্বেও কখনো তাঁকে দেখে মনে হতো না  পা মাটিতে পড়ছে না। ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে রেড কার্পেট এর উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষটা কখনো মনে করেননি এ দেশের আমজনতা থেকে তিনি আলাদা।

    এই কারণেই তিনি যখন যা যেমন করে সঠিক বলে মনে করতেন সেভাবেই কথা বলতেন। একবার তাঁর একটি মন্তব্য নিয়ে তোলপাড় হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন ভারতীয় মহিলাদের নব্বই শতাংশকে বিয়ের পর স্বামীর কাছে ধর্ষিত হতেই হয়। এটাই  আমাদের সমাজের বাস্তবতা!সেই কথা নিয়ে খুব বিতর্ক হয়েছিল! মনে আছে গালফ নিউজের সাংবাদিককে বলা তাঁর এই কথা পরেরদিন মিডিয়াতে প্রকাশিত হওয়ার পর দেশজুড়ে তার উপর অনেক ধিক্কার বাণী বর্ষিত হয়েছিল। কেউ কেউ বলেছিল ভারতীয় নারী এবং ভারতীয় সংস্কৃতিকে  তিনি অবমাননা করছেন। বিদেশীদের চোখে ভারতের ভাবমূর্তি খারাপ করছেন। ইরফানের বন্ধুরা সেই সময় পরামর্শ দিয়েছিল ইরফানকে, তুমি তোমার বক্তব্য থেকে সরে যাও। বলে দাও যে আমি ওভাবে বলতে চাইনি। কিন্তু ইরফান সরেন নি। বরং প্রতিটি সমালোচনার উত্তর তিনি নিজে দিয়েছেন। মানুষের কাছে বোঝাতে চেয়েছেন, এদেশের নারীরা তার সংসার জীবনেও কতটা পরাধীন। তাদের নিজস্ব কোনো সত্তা নেই। এক্ষেত্রে কোনো ধর্ম জাতের ভেদাভেদ নেই, ভারতীয় সমাজের প্রায় সকল পুরুষই নারীকে দমন করে রাখতে ভালবাসে। তিনি বলেছিলেন আমি এটা মেনে নিতে পারি না যে একটি নারী তার নিজের মতো করে বাঁচার অধিকার পাবে না। এইজন্যেই আমি কথাটি বলেছি। তাঁদের সত্ত্বা নিয়ে তাঁরা উদ্ভাসিত হোক। আমি চাই আমার কথাটা বলে যেতে। ধাক্কা না দিলে এটা নিয়ে আলোচনা হবে না। আমি পরিসংখ্যানবিদ নই। এটা আমি জানি না যে সত্যি ৯০% কিনা, তবে এটা ভারতীয় সমাজে এটি একটি সত্য! ভারতীয় নারীরা বিয়ের পরেও বরের কাছে স্বাধীন নয়! আমার মূল বক্তব্য এটাই। আমি সেখান থেকে সরতে রাজি নই।

    এই হলেন ইরফান খান। না। আমি লিখতে পারলাম না, ” হলে ন” শব্দটার বদলে ” ছিলেন”।

    কারণ কিছু মানুষ অতীত হন না। জীবন থেমে যায়। কিন্তু মানুষটা থেকে যান তাঁর বক্তব্যে, ভাবনায়, ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তায়। এইসব মানুষরাই তার কর্মের মধ্যে দিয়ে একটি দর্শন কে প্রতিষ্ঠা করে যান। অভিনেতা ইরফান খান বলিউডের এক ব্যতিক্রমী দর্শনের নাম। যে দর্শন গগনচুম্বী খ্যাতি এবং ক্ষমতার মিনারে বসেও শেখায় কি করে সাধারণ মানুষের হয়ে কথা বলতে হয়।সাধারণের  মতো জীবন যাপন করতে হয়। যে দর্শন শেখায় সাধারণ মানুষের মতোই নিজের ক্ষমতাকে ব্যবহার না করে চলতে। তাই তার মায়ের চার দিন আগে মৃত্যুর সময় তিনি চাইলেই যেতে পারতেন রাজস্থানে, প্রশাসনের উচ্চস্তরে জাস্ট একটা ফোন করলেই সেটা হয়ে যেতে পারত! কিন্তু তিনি লকডাউন এর নিয়ম ভাঙ্গেন নি।

    মৃত্যুতেও প্রমাণ করে দিয়েছেন তার জীবনের দর্শন।

    লাইফ অফ পাই সিনেমার সেই সংলাপ টা যেন এখনো তিনি বলে যাচ্ছেন,

    I suppose in the end, the whole of life becomes an act of letting it go… But what always hurts the most not taking a moment to say goodbye…

    সত্যিই ইরফান জানতেন না এভাবেই তাঁকে চলে যেতে হবে। তাই’ চলি ,গুডবাই’ হয়তো বলতে পারলেন না!

    তিনি থেকে গেলেন আমাদের মধ্যে তাঁর অভিনয়ে, জীবনে, দর্শনে! যিনি বেঁচে থাকেন তাঁর ভাবনায়, তাঁর মৃত্যু নেই।

    তথ্যসূত্র বার্তা সাম্প্রতিক