পশ্চিমবঙ্গ কি সেফ?| উত্তর খুজছেন সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় | তৃতীয় পর্ব

মহল্লায় মহল্লায় যেভাবে মুখ্যমন্ত্রী ঘুরেছে লকডাউন নিয়ে এখন সেভাবেই স্বাস্থ্য দপ্তরের দেখা উচিত অসুস্থ কে কে

     

     

    সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

     

    রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্য দপ্তরের এখন উচিত  প্রতিটি মহল্লায় তল্লাশি চালিয়ে জ্বর জারিতে আক্রান্তদের আলাদা করে চিকিৎসকদের হাতে তুলে দেওয়া। প্রাথমিক পরীক্ষার পর আক্রান্তদেরকে নিয়ে চলে আসা উচিত সরকারি করেনটাইন কেন্দ্রে।এই কাজে  জনস্বাস্থ্য কর্মীদের নিয়ে নেতৃত্ব দিতে পারে একমাত্র পুরসভা এবং পঞ্চায়েত। বস্তিগুলোতে মোবাইল ইউনিট নিয়ে গিয়ে ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীরা ঘরে ঘরে পরীক্ষা চালিয়ে আসতে পারে কেরালায়এইভাবে গণ সংক্রমণ ঠেকানো হয়েছিল । এটাই করা দরকার অবিলম্বে। এটা হচ্ছে না বলেই সমস্যাটা বাড়ছে।

     

    রাজ্য সরকারকে বুঝতে হবে আক্রান্ত বা মৃতের সংখ্যা দিয়ে আসল পরিস্থিতিকে বোঝা যাবে না।উপসর্গহীনরা করোনাবাহী মানুষ অনেক বেশি বিপজ্জনক।তারা সমাজের মধ্যে প্রচুর আছে।করোনা প্রতিরোধে তাদেরকে চিহ্নিত করে আলাদা করাটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। ঘরে ঘরে স্বাস্থ্য কর্মীদের নিয়ে যাওয়া দরকার প্রকৃত অর্থে প্রতিরোধ এবং প্রতিকারের জন্য। নইলে সংক্রমণ এখন কমবে, আবার কিছুদিন পর বাড়বে নতুন করে।

     

    দুর্ভাগ্যের বিষয়, রাজ্য আটকে আছে কলকাতা হাওড়া নিয়ে।রাজ্যের জেলায় জেলায় ছড়িয়ে পড়া দরকার এই তল্লাশি টিমের। সেটাই করা হচ্ছে না।

     

    সবচাইতে বড় প্রয়োজন এই মুহূর্তে  যথেষ্ট নিরাপত্তা দিয়ে চিকিৎসা কেন্দ্রগুলিতে ডাক্তার নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সংখ্যা বাড়ানো। স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রটেক্টিভ গিয়ার সহ সামগ্রিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা অবিলম্বে বলবৎ করা  l নইলে স্বাস্থ্যকর্মীরা একের পর এক আক্রান্ত হতে থাকবে।  স্বাস্থ্যব্যবস্থা তখন ভেঙে পড়বে। শুধু এই কারণেই  চিকিৎসারত প্রায় শ’খানেক ডাক্তারকে কোয়ারান্টিনে চলে যেতে হয়েছে। যার জন্য এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কে বলতে হচ্ছে, কোয়ারেন্টাইন বাড়িতেই করা হোক। সরকারের ক্ষমতা নেই। এটা ওনার আগেই বোঝা উচিত ছিল যে  চিকিৎসকদের নিরাপত্তা না দিতে পারলে এই মহামারী বিপর্যয় ঠেকানোর কোন উপায় থাকবে না।

     

    ওয়েস্ট বেঙ্গল হেলথ সার্ভিসে এমনিতেই ডাক্তারের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। তার মধ্যে যদি করোনায় আক্রান্ত হয়ে ডাক্তাররা নিজেরাই  করেনটাইনে চলে যেতে বাধ্য হন,  তাহলে মুখ্যমন্ত্রীকে অসহায় হয়ে এভাবেই হাত তুলে ফেলতে হবে।

     

    ডাক্তারদের নিরাপত্তা দেওয়ার ব্যাপারটা কিন্তু সম্পূর্ণ রাজ্যের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। করোনা সংক্রান্ত প্রথম নির্দেশেই কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক থেকে বলে দেওয়া হয়েছিল ডাক্তারদের পি পি ই দিতে হবে রাজ্যকেই। রোগীর সংস্পর্শে দাঁড়িয়ে যারা চিকিৎসা করবেন তাঁরা যদি এই পি পি ই না পান, তাহলে তাঁরা নিজেরাই যেকোনো মুহূর্তে আক্রান্ত হবেন। এই অনিশ্চয়তার আতঙ্কেই বহু ডাক্তার ডিউটি করা বন্ধ করে দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। রাজ্য সরকার কিন্তু সে ব্যাপারে চুপ। কলকাতা পুরসভার থেকে জানানো হয়েছে নিরুদ্দেশ ৬০ থেকে ৭০ জন ডাক্তার।তাঁরা আসছেন না কর্মক্ষেত্রে। ডাক্তার মহলের অন্দরে কান পাতলেই শোনা যাবে  , ভাই মরবো?যেভাবে করো না রোগীদের সামনে দাঁ

     

    কলেজ থেকে হাওড়া মেডিকেল কলেজ ডাক্তাররা এই কথাগুলি বলে যাচ্ছেন। তাঁদের কথাগুলো যে ফেলনা ছিল না সেটার প্রমাণ এখন হচ্ছে। গত ২৩ এপ্রিল রাজ্যের আটটি ডাক্তারদের সংগঠন একজোট হয়ে রাজ্য সরকারের কাছে চিকিৎসকদের নিরাপত্তা নিয়ে দাবি জানিয়েছিল। তারপর বিশেষ কিছু কিন্তু অগ্রগতি হয়নি।বরং পশ্চিমবঙ্গের দুজন চিকিৎসক মারা গেলেন করোনায়।

     

    গতকাল মারা গেছেন স্বাস্থ্য দপ্তরের এক প্রবীণ প্রথম সারির চিকিৎসক কর্মকর্তা, আজ মারা গেলেন বেলভিউয়ের অস্থি বিশেষজ্ঞ । ভয়ংকর কথা এটাই যে ইতিমধ্যে আক্রান্ত আরো অনেক চিকিৎসক! ডাক্তারের অবস্থা খুব ভালো নয়।

     

    বেসরকারি হাসপাতালেও সংক্রমণ ছড়িয়েছে এতই যে সেখানে নার্স, স্বাস্থ্য কর্মীরা আক্রান্ত। হাসপাতাল গেট গুলিতেই  কাউকে ঢুকতে দেওয়া র আগে সংক্রমণ পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখা দরকার বলে চিকিৎসা সংগঠনগুলি রাজ্য জানিয়েছিল। সেসব তো দূরের কথা কোন মেডিকেল কলেজ এর মধ্যেই যথেষ্ট সংখ্যক নার্স নেই।স্বাস্থ্য কর্মী নেই।তাদের সামান্য নিরাপত্তাটুকু দিতেই রাজ্য ব্যর্থ।

     

     

    স্বাস্থ্যকর্মীরা বারবার বলে আসছে। সবার আগে তাদের নিরাপত্তা দিতে কেন্দ্র-রাজ্য উভয়ই মিলে সচেষ্ট হওয়া উচিত। তা না করে খালি  করোনা য়  কজন মরলো আর কজন মরেনি এই সেই তর্কে  হারিয়ে যাচ্ছে করোনা চিকিৎসার মধ্যেকার ভঙ্গুর ব্যবস্থা।  রাজনীতির খোঁচা সামাল দিতে দিতেই  স্বাস্থ্য প্রশাসনের শীর্ষ কমিটির ব্যাক্তিদের অনেকটা সময় কেটে যাচ্ছে। তার উপর  মরার উপর খাড়ার ঘা এর মতন এসে জুটল কেন্দ্রের টিম। চারজনের টিম ফিরে গিয়ে গিয়ে এবার  ৮ জনের টিম আসছে। রোগীর চিকিৎসা দেখভাল করবে, চিকিৎসকের নিরাপত্তা দেবে যাঁরা, তাঁরা ব্যস্ত এখন কেন্দ্রকে চিঠির উত্তর দিতে।

     

    খুব নৈতিকভাবে একটা প্রশ্নটা ওঠে।কেন্দ্র-রাজ্য দ্বন্দ্ব কি সময়টা খুব দরকার ? ।এইভাবে মহামারীর মধ্যে একটি রাজ্য সরকারকে বিব্রত করা মানে রাজ্যবাসীকেই  বিপন্ন করে তোলা। এটা হয়তো ঠিক রাজ্য সরকার নিজেও ঠিকঠাক কোন রিপোর্ট দিচ্ছেন না! কাজটা করছে!রিপোর্টের উপর জোর না দিয়ে কাজের উপর জোর দেয়া টা বেশি দরকার! যদিও একইসঙ্গে মহামারী রূপ দিয়ে সঠিক রিপোর্টার খুব জরুরী ।  দায়ী তাই কেন্দ্র রাজ্য দুই পক্ষই। রাজ্য যখন কিটস নেই  বলছে কেন্দ্র তখন কিটস দিচ্ছে না। আক্রান্তের সংখ্যা তাহলে সঠিকভাবে জানা সম্ভব নয়। এই কথা বলার পরেও  কেন্দ্র জানাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে আক্রান্তের সংখ্যা কম, তাই কম দেওয়া হচ্ছে।  কিটসের স্টক সীমিত বলে অল্পই দেওয়া হচ্ছে, সেটা কাজে লাগানো হোক আগে। প্রশ্ন এটাই, কিট না দেওয়ার সময় যুক্তি দেখানো হচ্ছে এই রাজ্যে আক্রান্ত কম।তাহলে কেন্দ্র এই রাজ্যে প্রতিনিধি পাঠাচ্ছে কেন?  যেখানে মানুষকে পরীক্ষা করার প্রয়োজন বেশি বলে কিট পাঠানো জরুরি , কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি  সেখানে যাচ্ছে না কেন?

     

    এতেই  প্রমাণিত হয় চিকিৎসা ব্যবস্থার সরেজমিন করে উন্নতির জন্য পরামর্শ দিতে কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দল আসেননি, এসেছিলেন মৃতের তথ্য গোপন করা হচ্ছে এই অভিযোগের সত্যটা বিচার করতে। আর এটা নিয়ে তো সত্যি সত্যিই রাজ্য সরকার রাখঢাক গুর গুর করছিল তাই জনগন এটা  বিশ্বাস করে।  নানা টেকনিক্যাল কারণ দেখিয়ে যাই বলা হোক, জনমানসে এটাই ধারণা হয়েছে যে রাজ্য সরকার শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করছিল।

     

    কিন্তু এসবের দরকার ছিল কি? সত্যিই অনেক বেশি দক্ষতা নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসন এই মহামারী রুখতে লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতই কাজটা করেছে। লক ডাউন বলবৎ করবার জন্য তাদের উদ্যোগে মুগ্ধ হয়েছে ওই কেন্দ্রীয় বাহিনী নিজেও। সর্বভারতীয় কেন্দ্রীয় সমীক্ষায় তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। দেশের সব বড় মেট্রো গুলোর চাইতে কলকাতায় সবচাইতে বেশি ভালো করে লকডাউন পালন করা হচ্ছে (অবাধ্য কিছু জনগণ বারবার বেরিয়ে আসা সত্ত্বেও, এমনকি বিভিন্ন জায়গায় জায়গায় পুলিশ আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও)! যেভাবে হাওড়া হাসপাতাল থেকে হাওড়ার প্রতিটি অলিগলি কড়া নজর রেখে আটকে দেওয়া হলো, যেভাবে কলকাতার বিভিন্ন ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে আটকে দেওয়া হয়েছে,যেভাবে বারাসাত মধ্যমগ্রাম নিউ ব্যারাকপুর বিরাটি, বেলঘড়িয়া বেলগাছিয়া আটকে দেওয়া হয়েছে, তাতে কেউ বলতে পারবে রাজ্য সরকার ঢিলেমি দিয়েছে? কোনখানে কি সদিচ্ছার কোন অভাব দেখা গেছে? না।

     

    তাহলে রাজ্য সরকারের এই হাত তুলে দেওয়ার পিছনের কারণটা কি?।

     

    তথ্যসূত্র বার্তা সাম্প্রতিক