ফ্লিপকার্টের নাম করে প্রতারণা, গ্যাং-এর ৬ সদস্যকেই গ্রেপ্তার করল কলকাতা পুলিশের অ্যান্টি ফ্রড সেকশন।

নতুন গতি নিউজ ডেস্ক। গত ৬ মার্চ, হেয়ার স্ট্রিট থানায় একটি গুরুতর অভিযোগ দায়ের হয়। ফ্লিপকার্ট সংস্থার একজন উচ্চপদস্থ আধিকারিক জানান, সংস্থার নাম ও খ্যাতির সুযোগ নিয়ে তাদের অনেক ক্রেতার সঙ্গে প্রতারণা করছে অজ্ঞাতপরিচয় কয়েকজন। মূলত ফ্লিপকার্টের পুরনো এবং নিয়মিত ক্রেতারাই টার্গেট হচ্ছেন প্রতারকদের।

    নিজেদের ফ্লিপকার্টের সেলস ও প্রোমোশন ডিপার্টমেন্টের সদস্য হিসেবে পরিচয় দিয়ে প্রতারকরা প্রথমে ফোন করত ক্রেতাদের। তারপর ক্রেতাদের বলা হত, তাঁরা নাকি ফ্লিপকার্টের ‘লাকি প্রাইজ স্কিম’-এ পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন। এই সুযোগ কেবলমাত্র ফ্লিপকার্টের নিয়মিত ক্রেতাদের জন্যই। অ্যাপেলের আই ফোন এক্স, ডেল ল্যাপটপ, সোনি ব্র্যাভিয়া এলইডি টিভি, এলজি রেফ্রিজারেটর, ব্লু স্টার এসি—কী নেই সেই পুরস্কারের তালিকায়! তবে, এই পুরস্কার পেতে গেলে একটা শর্ত মানতে হবে। ফ্লিপকার্টের তালিকা থেকেই ৪,৯৯৯ টাকার বা তার থেকে বেশি মূল্যের কোনএকটি দ্রব্য বেছে নিয়ে তাদের কাছে অর্ডার দিতে হবে। তারপর টাকা পাঠাতে হবে তাদের দেওয়া নির্দিষ্ট একটি অ্যাকাউন্টে। ব্যস, তাহলেই হাতে চলে আসবে পুরস্কার।

    মাত্র ৪,৯৯৯ টাকার বিনিময়ে এত লোভনীয় পুরস্কারের প্রলোভন এড়াতে পারতেন না অনেক ক্রেতাই। এরপর, টাকা পাঠিয়ে দেওয়ার পরেও যখন পুরস্কার আসত না, তখন অভিযোগ জানাতেন সংস্থায়। এমন একাধিক অভিযোগই জমা পড়ছিল ফ্লিপকার্টে।

    হেয়ার স্ট্রিট থানার থেকে এই কেসের দায়িত্বভার গ্রহণ করে কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা দপ্তরের অ্যান্টি ফ্রড সেকশন। অভিযোগ শুনেই মনে হচ্ছিল, এটা একটা সংগঠিত গ্যাং-এর কাজ। প্রাথমিক তদন্তও সেইদিকে ইঙ্গিত করছিল।

    ক্রেতাদের থেকে টাকা আদায়ের জন্য বিভিন্ন ব্যাঙ্কে একাধিক অ্যাকাউন্ট খুলেছিল গ্যাং-এর কুশীলবরা। তদন্তকারী অফিসারেরা সেইসব অ্যাকাউন্টে টাকা লেনদেনের সমস্ত হিসেব খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে শুরু করেন। দেখা যায়, একটি অ্যাকাউন্টের সঙ্গে লিঙ্ক করা মোবাইল নম্বর তখনও চালু। প্রযুক্তি-প্রহরার সাহায্য নেওয়া হয়। খবর দেওয়া হয় সোর্সদেরও। প্রতারকরা চিহ্নিত হতেই ২২ জুলাই, চিংড়িঘাটা ও শ্যামবাজার অঞ্চলের একাধিক ডেরায় তল্লাশি চালায় অ্যান্টি ফ্রড সেকশনের বিশেষ টিম। গ্রেপ্তার করা হয় ৪ জনকে। গুলরাজ আহমেদ ওরফে নিহাল, বিশাল শর্মা, মহম্মদ সাদিক এবং কিষাণ শ ওরফে রাজ, প্রত্যেকেই ঐ গ্যাং-এর সদস্য।

    ধৃতদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ২৪ জুলাই এসপ্ল্যানেড চত্বরে ফের তল্লাশি চালানো হয়। ধরা পড়ে এই চক্রের মূল দু’জন চাঁই। মহম্মদ জিশান এবং আনন্দ কুমার মিশ্র। প্রতারণার এই গোটা চিত্রনাট্য তাদেরই সাজানো। প্রতারণার স্বার্থে একাধিক ছদ্মনাম নিয়েছিল তারাও।

    পেশাদার সংস্থার মতোই প্রত্যেকের নির্দিষ্ট দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া থাকত এই গ্যাং-এ। ৩টি আলাদা আলাদা গ্রুপে ভাগ হয়ে সেই দায়িত্ব পালন করত গ্যাং-এর ৬ সদস্য। প্রথম গ্রুপের দায়িত্ব ছিল, ফ্লিপকার্টের ক্রেতাদের অনলাইন কেনাকাটার তথ্য-সহ অন্যান্য যাবতীয় তথ্য জোগাড় করা। দ্বিতীয় গ্রুপের সদস্যরা ক্রেতাদের ফোন করে লোভনীয় পুরস্কারের টোপ দিত। আর তৃতীয় গ্রুপের কাজ ছিল ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা আর ক্রেতাদের পাঠানো টাকা তুলে নেওয়া।

    যাতে তাদের চিহ্নিত না করা যায়, তাই ক্রেতাদের ভিওআইপি (Voice Over Internet Protocol) প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফোন করত প্রতারকরা। সিম কার্ড নেওয়া থেকে শুরু করে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা—সবটাই হত নকল পরিচয়ে। সাজানো চিত্রনাট্যে কোনও ফাঁক ছিল না। কিন্তু এত দ্রুত ধরা পড়ে যাবে, ভাবতে পারেনি গ্যাং-এর কেউই।

    বাগুইআটি এবং বেলঘরিয়ায় দু’টি ভুয়ো কল সেন্টারের অফিস খুলে, সেখান থেকেই প্রতারণার গোটা কারবার চালাচ্ছিল এই গ্যাং। অফিস দু’টিতে তল্লাশি চালিয়ে একাধিক হার্ড ডিস্ক, কম্পিউটার-সহ নানা নথি বাজেয়াপ্ত করেছেন তদন্তকারী অফিসারেরা। ক্রেতাদের নানা তথ্য সংগ্রহ করে ঐ হার্ড ডিস্কগুলিতে জমা করে রাখত প্রতারকরা। কম্পিউটার মূলত ব্যবহৃত হত ভিওআইপি ফোন কলের জন্য। ধরা পড়ার আগে অবধি প্রায় ৫ লক্ষ টাকার প্রতারণা করে ফেলেছিল এই গ্যাং। ধরা না পড়লে সেই প্রতারণার পরিমাণ যে বহুগুণ বাড়ত, লেখা বাহুল্য।

    ছবি রইল অ্যান্টি ফ্রড সেকশন, ডিটেক্টিভ ডিপার্টমেন্ট এর তদন্তকারী দলের, বাজেয়াপ্ত হওয়া সামগ্রী এবং অভিযুক্তদের। ছবিতে দাঁড়িয়ে, বা দিক থেকে, অ্যাসিস্টেন্ট সাব ইনস্পেক্টর শেখ জামিরুদ্দিন, সাব ইনস্পেক্টর সুরজিৎ বণিক ও সুপ্রতিভ সিকদার, কনস্টেবল দীনেশ রাই, সাব ইনস্পেক্টর সৈকত চন্দ, কনস্টেবল বীরেন রায়চৌধুরী, দেবব্রত মিত্র ও শুভদীপ চক্রবর্তী। বসে, ওসি অ্যান্টি ফ্রড সেকশন, ইনস্পেক্টর কৃষ্ণেন্দু দাস।