|
---|
নতুন গতি নিউজ ডেস্ক: হাসপাতালে ভর্তি হয়েও ছেদ পড়েনি সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের কর্মকাণ্ডে। উডবার্ন ওয়ার্ডে চেয়ারে বসেও করেছেন দফতরের ফাইলে সই। সেই ছবিও সামনে এসেছে। তারপরই হঠাৎ থেমে গেল সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের হৃদযন্ত্র। সমাপ্তি ঘটল এক কর্মময় জীবনের।
গত ২৪ অক্টোবর নিয়মিত শারীরিক পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে গিয়েছিলেন রাজ্যের পঞ্চায়েত মন্ত্রী। সেইসময় শ্বাসকষ্টের সমস্যা দেখা দেওয়ায় তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাঁকে রাখা হয়েছিল আইসিসিইউতে। এসএসকেএমের উডবার্ন ওয়ার্ডের আইসিসিইউ-তে তাঁকে রাখা হয়েছিল। অসুস্থ পঞ্চায়েত মন্ত্রীর চিকিত্সারর জন্য ৭ সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছিলেন তিনি। মেডিক্যাল পরীক্ষায় তাঁর হৃদযন্ত্রে ব্লকেজ পাওয়া যায়। শারীরিক অবস্থার উন্নতি হওয়ায় কয়েকদিন আগেই তাঁর অ্যাঞ্জিওপ্ল্যাস্টি করা হয়।
অস্ত্রোপচার হওয়ার পর যেদিন কার্ডিওলজির বিভাগের কেবিনে দেওয়া হল তারপর থেকেই স্বচ্ছন্দ বোধ করতে শুরু করেছিলেন। কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফাইলও আনিয়েছিলেন। মাঝেমধ্যেই কিছু ফাইলে চোখ বোলানো, সই করার কাজ সেরে ফেলছিলেন বলে এসএসকেএম (SSKM) সূত্রে খবর।
কিন্তু স্টেন্ট বসানোর পরেও অবস্থার অবনতি হয় তাঁর। গতকাল হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় বর্ষীয়ান রাজনীতিকের। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৭৫। সেইসঙ্গে বাংলার রাজনীতিতে এক বর্ণময় চরিত্রের দীপাবলির রাতে জীবনাবসান ঘটে।
দীর্ঘ ৫০ বছরের রাজনৈতিক জীবন সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের। বহু উত্থান-পতনের সাক্ষী ছিলেনতিনি। ছিলেন ইন্দিরা গাঁধীর প্রিয়। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, দুই জমানাতেই সামলেছেন মন্ত্রিত্বের গুরুদায়িত্ব। ছিলেন কলকাতা পুরসভার মেয়র।
আদতে দক্ষিণ ২৪ পরগনার বজবজের সারেঙ্গাবাদের ছেলে।৬-এর দশকে পড়তে এলেন কলকাতায়।ভর্তি হলেন বঙ্গবাসী কলেজে।তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আর্কিওলজি-তে মাস্টার্স।সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের পরিবারের কেউ কোনওদিন রাজনীতির ধারেকাছে ছিলেন না৷ বাবা ছিলেন শিক্ষক৷ বঙ্গবাসী কলেজে পড়তে এসে প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির সঙ্গে আলাপ৷ তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দু’জনের ঘনিষ্ঠতা গাঢ় হয়৷ সুব্রত মুখোপাধ্যায় যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকছেন, তখন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ হচ্ছে৷
সেই রাজ্যে নকশাল আন্দোলন শুরু হয়েছে৷ রাজনীতির উল্টো মেরুতে প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি…তাঁর ছায়াসঙ্গী হয়ে উঠলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়….একসঙ্গে থাকা…একসঙ্গে খাওয়া….৷ সুব্রতর জীবনের মোড় ঘোরানো সময় এল ১৯৭১-এর বিধানসভা নির্বাচনে।
বালিগঞ্জ কেন্দ্র থেকে ওয়ার্কার্স পার্টির ২ বারের বিধায়ক জ্যোতিভূষণ ভট্টাচার্য হেরে গেলেন কংগ্রেসের নবাগত সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের কাছে।
জীবনের প্রথম ভোট-যুদ্ধে বাজিমাৎ। বিধায়ক হয়ে বিজয়ীর হাসি।পরের বছর আবার ভোট।আবারও জিতে বিধায়ক হলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। বয়স তখন সবে ছাব্বিশ! সুব্রত মুখোপাধ্যায় হলেন সিদ্ধার্থশঙ্কর মন্ত্রিসভার তথ্য-সংস্কৃতি দফতরের প্রতিমন্ত্রী। পশ্চিমবঙ্গের সর্বকনিষ্ঠ মন্ত্রী।ততদিনে ইন্দিরা গান্ধীরও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়।জরুরি অবস্থার পরে কংগ্রেস ছাড়েন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি৷ কিন্তু, ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গ ছাড়েননি সুব্রত মুখোপাধ্যায়।১৯৭৭-এর নির্বাচনে দেশজুড়ে কংগ্রেস বিরোধিতার হাওয়ায় বালিগঞ্জ কেন্দ্র থেকে হেরে গেলেন সুব্রত।
পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচন অর্থাত ১৯৮২ সালে বালিগঞ্জের বদলে জোড়াবাগান থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হলেন তিনি। ১৯৮২ থেকে ১৯৯৬ জোড়াবাগান ছিল তাঁর কেন্দ্র।
১৯৯৬ থেকে ২০০৬ তাঁর কেন্দ্র ছিল চৌরঙ্গী। ১৯৯৯ সালে কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে যোগ দেন সুব্রত। ২০০০ সালে মেয়র হন কলকাতা পুরসভার। মেয়র হয়ে একের পর এক উড়ালপুলের নির্মাণের প্রকল্প…কিংবা বুস্টার পাম্পিং স্টেশন করে জলে ডুবে যাওয়া কলকাতাকে জলমগ্ন অবস্থা থেকে মুক্ত করার তার উদ্যোগ…সব মহলে প্রশংসিত হয়েছে! কিন্তু, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে মতপার্থক্যের জেরে ২০০৫ সালে পুরভোটের ঠিক আগেই তৃণমূল ছাড়েন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। তৃণমূল ছেড়ে ঘড়ি প্রতীকে লড়াই করেন তিনি। তাঁর নেতৃত্বে তৈরি হয় নতুন মঞ্চ। পশ্চিমবঙ্গ উন্নয়ন মঞ্চ। যদিও নির্বাচনী ময়দানে সেভাবে দাগ কাটতে পারেনি সেই মঞ্চ।
২০০৬-এর বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের টিকিটে চৌরঙ্গী থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। কিন্তু ফল হয় শোচনীয়।২০০৯ -এ কংগ্রেসের প্রতীকে বাঁকুড়া লোকসভা কেন্দ্র থেকে লড়াই করে পরাজিত হন সুব্রত। এরপর ফিরে আসেন তৃণমূলে। ২০১১-তে বালিগঞ্জ কেন্দ্র থেকে জয়ী হন তিনি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্ত্রিসভায় জনস্বাস্থ্য ও পঞ্চায়েত দফতরের মন্ত্রী হন সুব্রত মুখোপাধ্যায়।ফের ২০১৬-য় বিধানসভা নির্বাচনে বালিগঞ্জের বিধায়ক নির্বাচিত হন সুব্রত। ২০১৯ সালে বাঁকুড়া কেন্দ্র লোকসভার প্রার্থী হন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। তবে পরাজিত হন তিনি।
২০২১ সালে সেই বালিগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্র থেকেই জয়ী হয়ে ফের মন্ত্রী হন তিনি।
জাতীয় এবং রাজ্য–রাজনীতির বহু উত্থান–পতনের সাক্ষী ছিলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়–পাঁচ দশকেরও বেশি তাঁর রাজনৈতিক কেরিয়ার৷ সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী। সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে অন্যতম ভরসার মুখ৷