|
---|
মহঃ রিপন : রাজা যায় রাজা আসে কিন্তু সভ্যতাকে যারা দিনরাত শ্রম দান করে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাদের কোনো পরিবর্তন হয়েছে কি? প্রতিদিন কর্পোরেট দুনিয়ায় শ্রমিকরা শোষিত, লাঞ্ছিত,নিপীড়িত হচ্ছে। ভোরের মসজিদের আজানে, রেল গাড়ির আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গে সুরমা, বিপুল মাল, আজিজদের, সূর্যের আলো তখনও এসে পৌঁছায় না তাদের বাড়ির উঠোনে ঠিক তার আগেই অন্নর খোঁজে পাড়ি দিতে হয় এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রাম, এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তরে। সব কিছুই আগের মত ঠিকঠাক চলছিল কিন্তু ২০২০ সালে করোনা ভাইরাস জীবনটাকে যেন এলোমেলো করে দিয়ে চলে গেল। বিপুল ,আজিজ, সুরমারা ঠিক তখনও বুঝে উঠতে পারেনি কি আসতে চলেছে ভারতবর্ষের বুকে। গ্রামে অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না থাকার জন্য বেশি অর্থের জন্য তারা পাড়ি দিয়েছিল চেন্নাইয়ে কিন্তু তিন মাস কাজ করার পর করোনার কারনে লকডাউন ঘোষণা করে চেন্নাই সরকার, লকডাউনে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন তারা কাজ বন্ধ, গৃহবন্দী, খাবারের সংকট সবকিছুই এখনো দগদগে ক্ষত হয়ে আছে তাদের মনে।
বিপুল, আজিজের বেড়ে ওঠা বীরভূম জেলার পাইকর থানার উত্তর রামচন্দ্রপুর গ্রামে। সেখানেই তারা ছোট থেকে বড় হয়েছে কোন ধর্মীয় বিভাজন এখনো তাদের বন্ধুত্বে আঁচ লাগাতে পারেনি। নদীর ধারে অবস্থিত ছোট্ট গ্রামটি প্রতি বছর বন্যার জলে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় । তারা প্রতি বার দেখে বন্যার জলে বাড়িঘর ভেঙ্গে দিতে কিন্তু আর কতদিন এভাবে চলবে? কথাটা বলতে বলতে বিপুলের মুখটা যেন শুকিয়ে আসছিল , কান্না ভরা কন্ঠে আকাশের দিকে মুখ তুলে ভাগ্যের উপর সবকিছু কে ছেড়ে দিল।
ঠিক বাংলা সাহিত্যে “তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে অদ্বৈত মল্ল বর্মণ লিখেছিলেন”কোনো রাতে ঝড় আরম্ভ হইলে সহজে কমিতে চায় না৷ সারারাত্রি চলে পাপসংহার৷ কোনো কোনো সময় প্রতি রাতে ঝড় আসে৷ সারাদিন খায় দায়, সন্ধ্যার দিকে আসন্ন ঝড়ের জন্য প্রস্তুত হয়৷ ঈশান কোণের কালো মেঘ সারা আকাশে ধোঁয়ার মতো ছড়াইয়া গিয়া হু হু করিয়া বাতাসে আসে৷ তারপর আসে ঝড়৷”
ঈশান কোণের কালো ঝড় তাদের জীবনে প্রতিবছরের ক্ষতি বার্তা নিয়ে আসে। নদীর জলে একদিকে যেমন বাড়িঘর ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায় অন্যদিকে ফসলেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়। চাষ করতে ভয় পায় তারা। মেঠো মাঠ যেন দুহাত বাড়িয়ে ডাকছে তাদের কিন্তু প্রকৃতির তাণ্ডবের কাছে তারা বড় অসহায়। তাই বাধ্য হয়ে হাতে তুলে নিয়েছে রাজমিস্ত্রির সামগ্রী। প্রকৃতির তান্ডব থেকে বাঁচতে টাকা ইনকামের উদ্দেশ্যে ভিন রাজ্যে পাড়ি দেওয়া ছাড়া তাদের কাছে আর কোন উপায় নেই তাদের।তিন মাস কাজ করার পর আজিজ, বিপুলরা একমাস চেন্নাইয়ে গৃহবন্দি ছিল। বন্ধুদের কাছ থেকে জানতে পারে বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চ নামক একটি সংগঠন পরিযায়ী শ্রমিকদের পাশে দাঁড়িয়েছে, তাদের হয়ে কাজ করছে। দেরী না করেই তারা যোগাযোগ করে বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চ নামক সংগঠনের হেল্পলাইন সেন্টার। প্রাথমিক অবস্থায় তাদের কাছে সেখানকার প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ করে কিছু খাবার পৌঁছে দেয়া সম্ভব হয়েছিল পরে তাদেরকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনা হয়। বাড়িতে এসে কিছুদিন কর্মহীন থাকার পর, অন্যের জমিতে ঠিকা শ্রমিক হিসাবে কাজকর্ম করত কিন্তু আবার করোনা বৃদ্ধির জন্য সবকিছু থমকে গেছে। আগের মত আর কাজ নেই বলে জানান তারা ।
প্রশ্ন করলাম লকডাউন পরবর্তী সময়ে সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে গেলে কি আবার বাইরে যেতে চান?
বিপুল মৃদু হেসে উত্তর দিলো কাজ না করলে খাব কি। তারা জানান ভিন রাজ্যে ভয় লাগছে। চোখের সামনে দেখেছি এক টুকরো রুটির জন্য কিভাবে হাহাকার করতে হয়েছে, চেন্নাইয়ের থাকাকালীন কয়েকজন বন্ধু মিলে শুধু চাল ফুঁটিয়ে খেয়েছি।পথে অনেক বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়েছে যারা দিনের পর দিন রাতের পর রাত পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরেছে, পুলিশি অত্যাচার, রাস্তার মধ্যে অনেক জায়গায় ক্ষত বিক্ষত দেহ পড়ে থাকতে দেখেছি। অভিশপ্ত জীবনের দিনগুলোকে যতবার ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছি ঠিক ততোবার যেন আঁকড়ে আসছে আমাদের মনে।
অন্যদিকে ওই গ্রামেরই হাসিনা বিবি,সম্পা মাল,রেজো মাল জানান তাদের স্বামী এখন ভিন রাজ্যে কর্মসূত্রে। শুনেছি দিল্লিতে আবার লকডাউন ঘোষণা করেছে সরকার কাজ-কর্ম সবকিছুই বন্ধ হয়ে গেছে, ঠিকাদার বাড়ি ফিরে যেতে বলেছে কিন্তু টিকিটের দাম আকাশছোঁয়া। 1000 টাকার টিকিট ব্লাকে 3000 টাকায় কিনতে হচ্ছে সেই সামর্থ্য টুকুও নেই এখন তাদের। আমরা গরীব মানুষ ঘরের হাঁস, মুরগি, গরু -বাছুর এমনকি অনেক সময় কানের গয়না পর্যন্ত বন্ধক রেখে টাকা নিয়ে বেশি ইনকাম এর আশায় স্বামী-সন্তানদের বিদেশে কাজ করতে পাঠিয়েছি কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সবকিছুই যেন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। স্কুল-কলেজ বন্ধ ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার থমকে গেছে, লকডাউন এর জন্য কাজ থমকে গেছে আমরা কি করে সংসার চালাবো কথাটা বলতে বলতেই শুকনো চোখের কোনায় দুফোঁটা জল দেখা গেল হাসিনার। দিল্লি থেকে চলে এসে নিজ রাজ্যে ও সেরকম ভাবে কাজ পাচ্ছেনা শ্রমিকরা এত কষ্ট এত অত্যাচার এত লাঞ্ছনা সহ্য করার পরেও সেই বিদেশের উপরেই ভরসা করে থাকতে হচ্ছে আমাদের। অনেক সময় দুর্ঘটনাজনিত কোন কারণে স্বামী-সন্তানদের মুখ পর্যন্ত দেখতে পাই না। সরকার আমাদের উপর মানবিক হোক আমাদের নিজ রাজ্যে কাজের ব্যবস্থা করে দেয়া হোক তাহলে হয়তো বিদেশে যেতে হবে না।আগেরবারও লকডাউন এর সময় হাসিনার স্বামী বাইরে ছিল পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরেছিলেন তিনি, গ্রামে কাজ না থাকার জন্য পুনরায় পাড়ি দিতে হয়েছে বিদেশে।
রাজ্য সরকারের ভূমিকা কেমন জানতে চাইলে হাসিনা জানান?
শুনছি নভেল করোনা ভাইরাস ফুসফুসে আক্রমণ করে কিন্তু, ফুসফুস নয় আমরা চিন্তিত খালি পেট নিয়ে। কারণ, একমুঠো ভাতের পরিবর্তে মিলছে শুধুই আশ্বাস।ভিন রাজ্যে আটকে পড়েছেন বিপুল সংখ্যক শ্রমিক। তারা প্রত্যেকেই নিজের রাজ্যে কাজ না পায়নি বলেই পেটের টানে পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে দিল্লি, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, হরিয়ানা, কেরালা, কর্ণাটক ও তামিলনাড়ুসহ বিভিন্ন রাজ্যে পাড়ি দিয়েছেন। আমাদের বিধানসভা এলাকার কোন জনপ্রতিনিধির কাছ থেকে আমার স্বামী সন্তানের জন্য সহযোগিতা পাইনি। বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চের ছেলেরা আমার স্বামীদের কাছে খাবার পৌঁছে দিয়েছিল, বাড়িতে আসতেও সহযোগিতা করেছিল। পশ্চিমবঙ্গ সরকার বিভিন্ন রাজ্যকে চিঠি দিয়েছিল শুনেছিলাম কিন্তু সেই চিঠিতে আদ্য কতটা কাজ হয়েছিল জানিনা। চিঠিতে যদি কাজ হতো তাহলে এতো এতো শ্রমিককে পায়ে হেঁটে বাড়ি আসতে হতো না। কেন্দ্র সরকারের খামখেয়ালীপনা ও রাজ্য সরকারের পরিযায়ী শ্রমিক নিয়ে নীরবতা অনেক শ্রমিককে বিপদে ফেলে দিয়েছিল। তখন টিভিতে দেখেছিলাম কিভাবে পুলিশ শ্রমিকদের উপর অত্যাচার করছে, হাজার হাজার শ্রমিক পায়ে হেঁটে বউ বাচ্চা নিয়ে ঘরে ফিরছে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছি এবার যেন সেই দৃশ্য আর না দেখতে হয়। পরিযায়ী শ্রমিক রাখরে না ফেরা পর্যন্ত যেন বাস-ট্রেন বন্ধ না করা হয়।
পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন এবং বারবার তাদের অধিকার নিয়ে সরব হয়েছেন এমন একটি সংগঠন বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চ। বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চের রাজ্য সভাপতি অধ্যাপক সামিরুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান বর্তমানে দৈনিক সংক্রমণ তিন লক্ষ অতিক্রম করেছে, করোনাভাইরাসের ঊর্ধ্বমুখী গ্রাফের জন্য বেশিরভাগ রাজ্যে লকডাউন ঘোষণা করতে বাধ্য হচ্ছে এর ফলে বেশির ভাগ পরিযায়ী শ্রমিকরা সমস্যায় পড়েছে। আমাদের কাছে খবর আছে বেশকিছু ট্রেন বন্ধ হয়েছে এর ফলে ঘরে ফেরার জন্য ট্রেনের টিকিটে আকাল দেখা দিয়েছে যদিও বা টিকিট পাওয়া যাচ্ছে সেগুলো চড়া দামে অত চড়াদামে টিকিট কেটে বাড়ি ফেরা শ্রমিকদের পক্ষে দুর্বিষহ ব্যাপার। গতবছর মে জুন মাসে অনেক শ্রমিককে আমরা বাড়িতে ফিরিয়ে এনেছিলাম। তারপর থেকেই শ্রমিকরা কর্মহীন ছিল গ্রাম্য এলাকায় যদিও বা কিছু জন কাজ করতো কিন্তু যথেষ্ট নয়। নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে করোনা গ্রাফ কমতে থাকলে অনেক শ্রমিক আবার ভিন রাজ্যে পাড়ি দিয়েছিল কাজের আশায় কিন্তু আবার হিতে বিপরীত হলো। এখন যা মনে হচ্ছে ইচ্ছা থাকলেও আর ভিন রাজ্যে যেতে পারবে না শ্রমিকরা যতদিন না সবকিছু আবার আগের মতো ঠিকঠাক হয়ে যাচ্ছে।দুশ্চিন্তা ও অর্থসংকট গ্রাস করেছে তাদের। আগেরবার আমরা লকডাউন এর সময় পরিযায়ী শ্রমিকদে জন্য সারা রাজ্য জুড়ে ছয়খানা হেল্পলাইন সেন্টার চালু করেছিলাম যেখানে শ্রমিকরা ফোন করে সরাসরি তাদের অভাব অভিযোগ সমস্যার কথা বলতো। শ্রমিকদের ঠিকানাগুলো নিয়ে উক্ত রাজ্যের অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের কাছে যোগাযোগ করে শ্রমিকদের কাছে খাবার পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলাম আমাদের সহযোদ্ধাদের মাধ্যমে কিন্তু সেটা যথেষ্ট ছিল না। 34 হাজার শ্রমিকের কাছে খাবার পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছিল বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চ এবং অনেক শ্রমিকদের সেই সময় বাড়িতে ফিরিয়ে এনেছিলাম। সেই সময় কাজ করতে গিয়ে আমাদের সহযোদ্ধারা অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় লাভ করেছিল গুজরাটের সুরাতে থাকা দিপু খাবারের জন্য বারবার আমাদের ফোন করতো সেখানকার প্রশাসনকে জানালে সহযোগিতার হাত সেরকমভাবে ভাবে বাড়িয়ে দেয় নি অন্যদিকে কেরালায় থাকা আলাম, শান্তিরা ফোন করলে তাদের আর্জি নিয়ে কেরালা সরকারকে জানালে যথেষ্ট হারে চাল,আটা তাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছিল। ধর্মের জিকির তোলে যে সমস্ত ঠিকাদাররা আজকে বাংলাকে ক্ষতবিক্ষত করছে সেই ঠিকাদারদের জেনে রাখা উচিত বাংলার বাইরে বাঙালিরা কতটা কোণঠাসা? বাঙালি শ্রমিক হওয়ার অপরাধে কতটা লাঞ্ছনার শিকার হতে হয় তাদের সেটা হয়তো সেই সমস্ত ঠিকাদারদের জানা নেই। শুধুমাত্র বাঙালি হওয়া অপরাধে অনেক শ্রমিককে ঘর থেকে বার করে দেওয়া হয়েছিল, বাঙালি হওয়ার অপরাধে অনেক শ্রমিকের কাছে খাবার পৌঁছে নি। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে একটাই অনুরোধ এবং আমাদের দীর্ঘদিনের দাবির পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য একটি নির্দিষ্ট দপ্তর খুলতে হবে এবং প্রতিটি পরিযায়ী শ্রমিকের নাম সরকারিভাবে লিপিবদ্ধ করতে হবে। যাতে বাংলার কোন পরিযায়ী শ্রমিক ভিন রাজ্যে বিপদে পড়লে সহজেই তাদের ট্র্যাক করে ফিরিয়ে আনা যায়।