সংখ্যালঘু দপ্তরের খাবার টেবিল চেয়ার নিয়ে বিজ্ঞপ্তি এবং বিতর্কের নেপথ্যে আসল কাহিনী, লিখছেন সমাজকর্মী মোহাম্মদ জিম নওয়াজ

তিনি/উনি কিংবা তাঁরা কী বলবেন সেটির উপর নির্ভর করলে বিপদ বাড়বে বৈ কমবে না। সরকারি / বেসরকারি যেকোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে সব সময় অ্যাপোলজিস্ট হওয়ার দরকার নেই। যৌক্তিকভাবে ফেক নিউজ ও অপপ্রচারকে তাড়া করাও সময়ের দাবি। নিচের লেখাটি লিখেছেন সমাজকর্মী মহম্মদ জিম নওয়াজ ( Md Zim Nawaz )
=========================================

    লেখাটি একটু বড় হয়ে গেল, তবে জরুরিঃ

    “পশ্চিমবঙ্গ সরকার Circular পাঠিয়েছে, যে সমস্ত স্কুলে 70% এর বেশি মুসলীম ছাত্র-ছাত্রী আছে সেখানে Dining Hall এবং টেবিল বানাতে হবে। শিক্ষা বিভাগে হিন্দু মুসলমানের ভেদাভেদ কেন?”

    গতকাল রাতে, বিজেপির রাজ্যসভাপতি শ্রী দিলীপ ঘোষ মহাশয় নিজের ফেসবুকে পেজ-এ উপরের লেখাটি পোষ্ট করেছেন। প্রামাণ্য দলিল হিসেবে কোচবিহার জেলা শাসকের দপ্তর থেকে জারি করা সার্কুলারের একটি ছবি আপলোড করেছেন। দিলীপবাবুর পোষ্টটি হাজার হাজার শেয়ার হয়েছে এবং হচ্ছে । (চিত্রঃ 1)

    দিলীপবাবুর পোষ্টের পরে পরেই সর্বভারতীয় ইংরেজি সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডে-র খবরেও একই কথা প্রচার করা হয়। এছাড়া আরও কিছু ওয়েবপোর্টাল বেশ গুরুত্বের সাথেই খবরটি প্রচার করেছে। সরকারের এই সার্কুলারকে অনেকেই মুসলিম তোষণ হিসেবে দেখছেন। এমনকি এই সার্কুলারকে কেন্দ্র করে মুসলিমদেরও একটি অংশ সোশ্যাল মিডিয়ায় রাজ্য সরকারের মুণ্ডপাত করে চলেছেন। সরকারি সার্কুলার, সার্কুলারকে কেন্দ্র করে দিলীপ ঘোষ সহ অন্যান্যদের অভিযোগ এবং বাস্তবতা একটু খতিয়ে দেখে নেওয়া যাক।

    প্রথমেই দিলীপ ঘোষ প্রদত্ত কোচবিহার জেলা শাসকের দপ্ত্র থেকে জারি করা সার্কুলারটি একবার খুঁটিয়ে দেখে নিই।
    Memo No. MS 278(3), Dated: 25/06/2019 সার্কুলারটি জারি করা হয়েছে কোচবিহার জেলা শাসকের সংখ্যালঘু বিভাগ থেকে। এই সার্কুলারটি জারি করা হয়েছে ‘নবান্ন’-এর MA(Minority Affairs) & ME(Madrasah Education) দপ্তরের স্পেশাল সেক্রেটারির পক্ষ থেকে জারি করা একটি সার্কুলারের ভিত্তিতে, রেফারেন্স নং- 1173-MD/15011/10/2017, Dated: 14.06.2019। (চিত্রঃ 2)

    নবান্ন এবং কোচবিহার জেলা শাসকের সংখ্যালঘু দপ্তর থেকে জারি করা দুটি সার্কুলারেই বলা হয়েছে, যেসমস্ত স্কুলে ৭০% বা তার বেশি ‘সংখ্যালঘু'(Minority) শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে, সেইসমস্ত স্কুলে সংখ্যালঘু দপ্তরের পক্ষ থেকে Dining Hall বা মিড ডে মিল খাওয়ার ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হবে। লক্ষণীয় বিষয় হল, সার্কুলার দুটিতে Minority অর্থাৎ সংখ্যালঘু শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, কোথাও ‘মুসলিম’ শব্দ ব্যবহার করা হয়নি। এখন প্রশ্ন হল, দিলীপবাবু তাঁর পোষ্টে এবং ইন্ডিয়া টুডে-র মতো সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যম তাদের খবরে সংখ্যালঘু শব্দের পরিবর্তে ‘মুসলিম’ শব্দটি ঠিক কোন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করলেন? সংখ্যালঘু এবং মুসলিম- দুটি শব্দের অর্থ কি একই?

    আসুন, ভারতের সংবিধান অনুযায়ী, সংখ্যালঘু শব্দের পরিভাষা একবার দেখে নেওয়া যাক। সংবিধানের ৩০ নম্বর ধারা(মৌলিক অধিকার) অনুযায়ী সংখ্যালঘু বলতে ১) ভাষাগোষ্ঠী এবং ২) ধর্মীয় জাতিগোষ্ঠী-র কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
    ১) সংখ্যালঘু ভাষাগোষ্ঠীঃ ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার উর্দু, হিন্দি, নেপালি, উড়িয়া, সাঁওতালি এবং গুরুমুখী- এই ছয়টি ভাষাগোষ্ঠীকে সংখ্যালঘু ভাষাগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছে। অর্থাৎ স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ছয়টি সংখ্যালঘু ভাষাগোষ্ঠী অনুযায়ী শুধু মুসলিম নয়, ভাষার ভিত্তিতে হিন্দু বা যেকোনো ধর্মীয় জাতিগোষ্ঠীর মানুষ সংখ্যালঘু হিসেবে গণ্য হতে পারেন।
    ২) সংখ্যালঘু ধর্মীয় জাতিগোষ্ঠীঃ ভারতে মুসলিম, খৃষ্টান, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন এবং পারসি- এই ছয়টি ধর্মীয় জাতিগোষ্ঠী সংখ্যালঘু ধর্মীয় জাতিগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। অর্থাৎ এক্ষেত্রেও শুধু মুসলিম নয়, স্বীকৃতিপ্রাপ্ত অন্যান্য সংখ্যালঘু ধর্মীয় জাতিগোষ্ঠীর মানুষও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন।

    উপরে ভারতের সংবিধান অনুযায়ী সংখ্যালঘু শব্দের পরিভাষা বিশ্লেষণে প্রশ্নাতীতভাবে প্রমাণ হল যে, সংখ্যালঘু এবং মুসলিম শব্দদুটি অভিন্ন নয়। সহজ ভাষায়- সমস্ত মুসলিমই সংখ্যালঘু, কিন্তু সমস্ত সংখ্যালঘু মুসলিম নয়। তাহলে ঠিক কোন উদ্দেশ্যে দিলীপ ঘোষ এবং সংবাদমাধ্যম সার্কুলার দুটিতে উল্লেখিত ‘সংখ্যালঘু’ শব্দের পরিবর্তে মুসলিম শব্দ ব্যবহার করে বিভ্রান্তি তৈরি করেছেন? উদ্দেশ্য সেই একটাই, মুসলিম বিদ্বেষ ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িকতার মাধ্যমে রাজনৈতিক জমি দখলই হল দিলীপবাবুদের মূল উদ্দেশ্য।

    এবার, চিত্রঃ 2 অর্থাৎ নবান্ন-এর সংখ্যালঘু এবং মাদ্রাসা শিক্ষা দপ্তর থেকে জারি করা সার্কুলারটির বয়ানের দিকে নজর দেওয়া যাক। এই সার্কুলারের প্রথম বাক্যে বলা হয়েছে, SSM অর্থাৎ সর্বশিক্ষা মিশন-এর নির্দেশ অনুযায়ী, প্রতিটি সরকারি এবং সরকার সহায়তাপ্রাপ্ত স্কুলে শিক্ষার্থীদের মিড ডে মিল প্রদানের জন্য Dining Hall নির্মাণ বাধ্যতামূলক। এখন প্রশ্ন হল, সর্বশিক্ষা মিশন প্রকল্পটি রাজ্য সরকারের নাকি কেন্দ্র সরকারের আওতাভুক্ত? সর্বশিক্ষা মিশন প্রকল্পটি কেন্দ্র সরকারের। অতএব, প্রতিটি সরকারি এবং সরকার সহায়তাপ্রাপ্ত স্কুলে শিক্ষার্থীদের মিড ডে মিল প্রদানের জন্য Dining Hall নির্মাণের নির্দেশ কেন্দ্র বা মোদী সরকারেরই। এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, মোদী সরকারের নির্দেশ তো শুধুমাত্র সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত শিক্ষার্থীদের জন্য নয়, ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সমস্ত শিক্ষার্থীদের জন্যই প্রযোজ্য। হ্যাঁ ঠিকই, মোদী সরকারের নির্দেশ ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সমস্ত শিক্ষার্থীদের জন্যই প্রযোজ্য। কিন্তু এক্ষেত্রে সার্কুলারটি জারি করেছে, নবান্ন-এর সংখ্যালঘু এবং মাদ্রাসা শিক্ষা দপ্তর। আর সংখ্যালঘু দপ্তর প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য এবং মূল কাজই হল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত জনজাতির উন্নয়ন ঘটানো। সংখ্যালঘু দপ্তরের বাজেট বরাদ্দ করা হয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত জনজাতির উন্নয়ন ঘটাতেই। ফলত, নবান্ন-এর সংখ্যালঘু এবং মাদ্রাসা শিক্ষা দপ্তর থেকে জারি করা সার্কুলারটির মধ্যে ‘মুসলিম তোষণ’ তো নেইই, বরং অত্যন্ত সদার্থক পদক্ষেপ রয়েছে। কারণ, মোদী সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী রাজ্য সরকারের শিক্ষা দপ্তর প্রতিটি সরকারি এবং সরকার সহায়তাপ্রাপ্ত স্কুলে Dining Hall নির্মাণ করতে বাধ্য। সেক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের সংখ্যালঘু এবং মাদ্রাসা শিক্ষা দপ্তর মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নের সাথে সাথে সরকারি অন্যান্য শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে অংশগ্রহণ করার ফলে রাজ্য সরকারের শিক্ষা দপ্তরের উপর থেকে চাপ অনেকটাই কমবে। একইসাথে সংখ্যালঘু দপ্তর নির্মিত Dining Hall ব্যবহারের সুযোগ সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ভুক্ত শিক্ষার্থীও পাবে যার দায় সংখ্যালঘু দপ্তরের একদমই নেই। সংখ্যালঘু দপ্তর শুধু এবং শুধুমাত্র সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উন্নয়নে উদ্যোগী হতেই দায়বদ্ধ।

    সংখ্যালঘু এবং মাদ্রাসা শিক্ষা দপ্তর সংখ্যালঘুদের উন্নয়নের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করলে যদি ‘মুসলিম তোষণ’ হয়, তাহলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য মোদী সরকারের গৃহীত প্রকল্পগুলি মুসলিম তোষণ নয় কেন, দিলীপবাবুরা কী এই প্রশ্নের উত্তর দেবেন? প্রধানমন্ত্রী জনবিকাশ কার্যক্রম(PMJVK)-এর পক্ষ থেকে কেন্দ্র সরকার সংখ্যালঘু জনজাতি সমূহের উন্নয়নের জন্য বহু প্রকল্পের উদ্যোগ নেওয়া হয় এবং সেই অনুযায়ী বাজেটও বরাদ্দ করা হয়। PMJVK-এর মাধ্যমে সংখ্যালঘু উন্নয়ন বিষয়ক প্রকল্পের তথ্যাদি পেতে pmjvk.minorityaffairs.gov.in ওয়েবসাইটটি ঘুরে আসা যেতে পারে। উল্লেখ্য, মোদী সরকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উন্নয়নের জন্য ২০১৮-১৯ সালে এক বছরে রাজ্যগুলিকে যে টাকা দিয়েছে, তারমধ্যে উত্তরপ্রদেশ সর্বাধিক(৩৭৬ কোটি ৫৩ লক্ষ) এবং দ্বিতীয় সর্বাধিক পশ্চিমবঙ্গ(২৬৯ কোটি ৬৭ লক্ষ)।(চিত্রঃ 3)


    দিলীপবাবুরা এবার কি বলবেন? মোদী সরকার ‘মুসলিম তোষণ’ করছে? রাজ্য সরকারের সংখ্যালঘু দপ্তর কেন্দ্র থেকে যে টাকা পেয়েছে, সেটা তো তারা খরচ করবেই। তাই সংখ্যালঘু দপ্তর থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য গৃহীত প্রকল্পকে ‘মুসলিম তোষণ’ তকমা দেওয়া শুধু ভুলই নয়, ঘৃণিত অপরাধও। বরং রাজ্য সরকারের কাছে আমাদের দাবি জানানো উচিত, সংখ্যালঘু উন্নয়নের জন্য প্রাপ্ত এক টাকাও যাতে কেন্দ্রে ফিরে না যায়। আমাদের আরও দাবি জানানো উচিত, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য বরাদ্দকৃত টাকার সুবিধা যথাযথভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে পৌঁছচ্ছে কিনা সেবিষয়ে রাজ্য সরকারের তরফ থেকে শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হোক অথবা পাবলিক অডিট-এর ব্যবস্থা করা হোক।

    উপরের সামগ্রিক আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যেতে পারে, বিজেপির রাজ্যসভাপতি দিলীপ ঘোষ, ইন্ডিয়া টু ডে এবং অন্যান্য সংবাদমাধ্যম প্রচারিত এই বিষয়ক বিকৃত খবর নির্ভেজাল সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক। আর যেসমস্ত মুসলিম এবং অমুসলিম ভাইরা হিন্দুত্ববাদী শক্তি প্রচারিত বিকৃত সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক খবরে প্রভাবিত হয়ে প্রতিক্রিয়াশীলতা দেখিয়েছেন, তাদের কাছে একটাই অনুরোধ-
    কোনো খবর পাওয়ার সাথে সাথে যাচাই করে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করার পরেই মতামত প্রদান করুন। তা নাহলে, আপনাদের অদূরদর্শী প্রতিক্রিয়াশীলতার কারণে সাম্প্রদায়িক শক্তির কূটকৌশল এবং কুমন্ত্রণা সফল হবে।