নরেন্দ্র মোদির যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত, ৬৯ বছর পর বাতিল ৩৭০ ধারা, কাশ্মীর আর রাজ্য নয়

জাকির হোসেন সেখ, ৫ আগস্ট, নতুন গতি: ঝুলি থেকে বিড়াল বেরিয়ে পড়ল। যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বাতিল করা হল সংবিধানের ৩৭০ ধারা, যা জম্মু-কাশ্মীরকে বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা দিয়েছিল। শুধু তাই নয়, জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যকে দু টুকরোও করে দেওয়া হল। রাজ্য থেকে লাদাখকে আলাদা করে তৈরি করা হলো নতুন এক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল, যার কোনো বিধানসভা থাকবে না। জম্মু-কাশ্মীরের পূর্ণাঙ্গ রাজ্যের মর্যাদাও কেড়ে নেওয়া হল। এখন থেকে তার পরিচিতি হবে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে। যদিও তার বিধানসভা থাকবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন অমিত সাহ। নতুন দু’টো কেন্দ্র-শাসিত অঞ্চল পরিচালনা করবেন দুই লেফটেন্যান্ট গভর্নর।

    সংবিধানের ৩৫ (ক) ধারাও বাতিল হয়ে গেল কি না, তা নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। কংগ্রেস নেতা গুলাম নবি আজাদ সাংবাদিকদের বলেছেন, বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ৩৫ (ক) ধারাও বিলোপ করে দেওয়া হলো। জম্মু-কাশ্মীরের জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করল বিজেপি সরকার। এর পরিণাম ভালো হতে পারে না।

    সংবিধানের ৩৭০ ধারায় জম্মু-কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল। পররাষ্ট্র, যোগাযোগ এবং প্রতিরক্ষা ছাড়া বাকি সব ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ছিল ওই রাজ্যের। একসময় তাদের আলাদা পতাকা ছিল। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ছিল সংবিধান। কালে কালে সব হারিয়ে অবশিষ্ট ছিল শুধু ৩৭০ ধারা ও কিছু বিশেষ ক্ষমতা। সেটাও আজ কেড়ে নেয়া হল।

    কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ আজ সোমবার প্রথমে রাজ্যসভা ও পরে লোকসভায় এই ঘোষণা দেন। বিরোধীদের প্রবল প্রতিরোধের মধ্যে রাষ্ট্রপতির নির্দেশনামা তিনি পড়ে শোনান। তিনি বলেন, ৩৭০ ধারা কাশ্মীরকে দেশের অন্য অংশের সঙ্গে একাত্ম করতে পারেনি।

    এমনটাই যে ঘটতে চলেছে, কয়েকদিন ধরেই তার আঁচ পাওয়া যাচ্ছিল। গত ২৭ জুলাই একশো কোম্পানি সশস্ত্র বাহিনী পাঠানো হয় উপত্যকায়। পরের দিন ২৮ জুলাই রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি কেন্দ্রীয় সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা নষ্ট হলে দেশের পক্ষে অমঙ্গলজনক হবে।
    ২৯ জুলাই জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের পক্ষ থেকে রাজ্যের সব মসজিদ ও তাদের পরিচালন সমিতি সম্পর্কে রিপোর্ট তলব করা হয়। সেদিন থেকেই রটে যায়, কেন্দ্র ৩৭০ ও ৩৫ (ক) ধারা বাতিল করার রাস্তায় হাঁটছে।
    পরের দিন ৩০ জুলাই রাজ্যের রাজ্যপাল সত্যপাল মালিক এক বিবৃতিতে রাজ্যের মানুষকে গুজবে কান না দিতে অনুরোধ করেন।
    ৩১ জুলাই মেহবুবা মুফতি কুলগাম, সোপিয়ান ও পুলওয়ামা জেলায় গিয়ে বিভিন্ন সভায় ৩৫ (ক) ধারা ব্যাখ্যা করেন। এই ঘটনা জানাজানি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রাজ্যের ভারপ্রাপ্ত বিজেপির সর্বভারতীয় সম্পাদক রাম মাধব সমালোচনা করে বলেন, এই ভাবে মানুষের মনে ভয় ঢোকানো উচিত নয়।
    তারপর ১লা আগস্ট প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দেখা করেন ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতা ফারুক ও ওমর আবদুল্লা। তাঁরা প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, ৩৫ (ক) ধারা বাতিল করে দিলে গোটা উপত্যকায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলবে। ঠিক সেদিনই কাশ্মীরে ১০ হাজার বাড়তি সেনা পাঠানো হয়।
    ২ আগস্ট বাতিল করে দেওয়া হয় অমরনাথ যাত্রা। সব পর্যটককে দ্রুত উপত্যকা ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। সে জন্য রাজ্য ও কেন্দ্র সরকার বাস, ট্রেন ও বিমানের বিশেষ ব্যবস্থাও করে।
    ৩ আগস্ট নিয়ন্ত্রণ রেখায় ৫ জন পাকিস্তানি নিহত হয়। ৪ আগস্ট স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা, গোয়েন্দা প্রধান ও রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিটিক্যাল উইংয়ের প্রধানদের সঙ্গে। তখনই সরকারিভাবে জানানো হয়, সোমবার সকালে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা বিষয়ক কমিটির বৈঠক বসবে। সেইমত
    আজ সকাল সাড়ে ন’টায় সেই বৈঠক বসে। বেলা ১১টায় রাজ্যসভায় অমিত শাহ ঘোষণা করেন, জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ ক্ষমতা আর থাকছে না। রাজ্যও ভাগ হচ্ছে দুটি ভাগে।
    এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে আজ অতিরিক্ত আরও ৮ হাজার আধা-সামরিক সেনা পাঠানো হয় উপত্যকায় ।

    গতকাল রবিবার গভীর রাতে গৃহবন্দী করা হয় ফারুক-ওমর আবদুল্লা, মেহবুবা মুফতি, সাজ্জাদ লোন সহ উপত্যকার সমস্ত সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের। বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয় ইন্টারনেটসহ বিভিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা। জায়গায় জায়গায় জারি করা হয় ১৪৪ ধারা ও কারফিউ।
    এই সিদ্ধান্তের পরিণাম কী হবে, এখনই তা বোঝা যাচ্ছে না। কারণ, গোটা উপত্যকা এই মুহূর্তে থমথমে।
    সরকারের সমর্থকেরা এই সিদ্ধান্তকে প্রবলভাবে সমর্থন জানালেও বিরোধীরা সংসদের কক্ষে বসে প্রতিবাদ জানান। কংগ্রেস নেতা পি চিদম্বরম জানান, সরকার যা করেছে, তা দেশ ও গণতন্ত্রের পক্ষে চরম বিপজ্জনক। এই সিদ্ধান্ত দেশকে টুকরো টুকরো করে দেওয়ার প্রথম পদক্ষেপ। ইচ্ছে করলেই সরকার এখন যে কোনো রাজ্যকে তার ইচ্ছেমতো ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিতে পারে। দেশের পক্ষে এটা প্রকৃত কালো দিন।

    বিজেপির শরিক সংযুক্ত জনতা দল এই সিদ্ধান্তে শরিক হয়নি। দলের নেতা কে সি ত্যাগী বলেছেন, তাঁরা এই সিদ্ধান্তের বিরোধী। এটা এনডিএরও অ্যাজেন্ডা ছিল না।

    অন্য রাজনৈতিক দল থেকে বিজেপি নিজেদের আলাদা দাবি করে এসেছে বরাবর। তিনটি বিষয়ে তারা কখনো তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি থেকে সরেনি। এক: ৩৭০ ধারা বাতিল, দুই: সারা দেশে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির প্রচলন এবং তিন: অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির প্রতিষ্ঠা।

    দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসেই জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ অধিকার বাতিল করে দিয়ে সেই তিনটে লক্ষ্যের একটা আজ পূরণ করল বিজেপি।

    মঙ্গলবার থেকে অযোধ্যা মামলার দৈনন্দিন শুনানি শুরু হচ্ছে সুপ্রিম কোর্টে। বিজেপির বিশ্বাস, অতি দ্রুত সেই শুনানি শেষ হবে। এবং অযোধ্যায় মন্দির প্রতিষ্ঠা করার সব বাধা দূর হবে।

    বাকি থাকল শুধু অভিন্ন দেওয়ানি বিধি। সেটা করার আগে তিন তালাক বিল পাস করে কেন্দ্র সরকার বুঝিয়ে দিয়েছে যে, অভিষ্ট লক্ষ্যেই এগোচ্ছে বিজেপি।

    কাশ্মীর এই মুহূর্তে থমথমে। কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সুপ্রিম কোর্টের শরণাপন্ন হওয়ার কথা ভাবছে বলে শোনা যাচ্ছে।