|
---|
প্রান্তিক ঘোষ , কলকাতা:
তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে অবিভক্ত থাকার দিন থেকে আজ অবধি, ভারতের ইতিহাস বড় নিষ্ঠুররকমের রসিক এবং বড় নির্মম দৃষ্টান্তের দিশারী। সে দু’ধরনের মানুষকে বড় অদ্ভূত বৈপরীত্যের ব্যঞ্জনায় পাশাপাশি কোলে করে বয়ে চলেছে আজীবন।
একদল নিজের পোশাকী ধর্মের মোহ আবরণ খুলে বেশি করে মানুষের মধ্যে মিশে গেছেন। দেশের স্বার্থ, দশের স্বার্থকে নিজের প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম বিশ্বাসের ওপরে বলে বিশ্বাস করেছেন। মনে করেছেন এ দেশের মানুষ মাত্রেই তাঁর আত্মীয়-সাথী। আগে মানুষ, আগে দেশ, তারপর ধর্ম। যেমন ধরুন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ধর্মবিশ্বাসে নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ, আবার মৌলানা আবুল কালাম আজাদ পাঁচ-ওয়াক্ত নমাজী। অথচ দেশের মানুষকে ভালোবাসতে কোনোদিন ধর্মের সীমানা মানেননি। সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িক বিভেদের উর্দ্ধে দাঁড়িয়ে, ধর্ম পরিচয় তুচ্ছ করে চিরকাল লড়ে গেছেন দেশবাসীর সম্প্রীতির স্বপক্ষে, সমাজহিতের লক্ষ্যে।
দ্বিতীয়দলটিতে আছেন মহম্মদ আলি জিন্না, যিনি ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মবিশ্বাসী নন। জিন্নার জীবনীকার লিখেছেন- শুয়োরের মাংস আর শেরি’র মদ্য ছিল তাঁর প্রিয় ও প্রায় রোজকার সকালের জলখাবারের অঙ্গ। সাথে এই দলে আছেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। যিনি ছিলেন একইরকম চরম নাস্তিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ঈশ্বরবাদে চূড়ান্ত অবিশ্বাসী। অথচ ইতিহাসের নির্মম রসিকতা দেখুন – প্রথমজন হয়ে গেলেন এক মৌলবাদী মুসলিমরাষ্ট্র পাকিস্তানের অবিসংবাদিত জনক, আর দ্বিতীয়জন প্রতিষ্ঠা পেলেন এক ভন্ড হিন্দু জাতীয়তাবাদী দলের ধর্মভিত্তিক বিভেদকামী নায়ক হিসেবে। দুজনেই প্রমাণ করতে চাইলেন দেশের মানুষের জীবনের চেয়েও বড় হল অসহিষ্ণু ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতা। সাম্প্রদায়িকতাই হল তাঁদের সামাজিক মন্ত্র।
তাই হিসেবটা বড় গোলমেলে বন্ধু। এদেশে মানুষে মানুষে বিভেদ-বিদ্বেষের বীজ পোঁতার কাজটা ধর্মের আড়ালে আসলে হয়েছে নোংরা রাজনীতি আর শাসকের ক্ষমতালোভের হাত ধরে। হয়েছে মানুষের গরিবী, তার অশিক্ষার সুযোগ নিয়ে। হয়েছে তার সরল ধর্মবিশ্বাসে সুরসুরি দিয়ে তাকে অন্যের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলার লক্ষ্যে। কারণটা সহজ – মানুষ যত বিভাজিত, তত দুর্বল, তাকে দাবিয়ে রাখা শাসকের পক্ষে ততই সুবিধাজনক।
সেভাবেই মানুষকে আলাদা করে, ধর্মে ধর্মে লড়িয়ে দিয়ে এ দেশের সমাজ ও মানুষের ওপর প্রভুত্ব কায়েম রাখতে চেয়েছিল ইংরেজ শাসকও। পারে নি। হেরে গেছে আমাদের সচেতনতার কাছে। তবে আজ স্বাধীন দেশের বাসিন্দা হয়েও কেন আমরা হেরে যাব এক অপদার্থ সুবিধাবাদী দেশশাসকের বিভাজনের চক্রান্তের সামনে?
আমরা হারবো না। বরং আমরা মাথা উঁচু করে, কাঁধে কাঁধ আর পায়ে পা মিলিয়ে, হাতে হাত ধরে এগিয়ে যাবো সব ধর্ম নির্বিশেষে এই বাংলার এই ভারতের বুকে শাসকের সব চক্রান্তের বিরুদ্ধে, শুভবুদ্ধির আলো নিয়ে, সম্প্রীতির পথ বেয়ে। আমরা থাকবো ওই প্রথম দলে, দ্বিতীয়টিতে নয়।
সেই শুভবোধের আলো দিকে দিকে জ্বেলে দিতে এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির শপথকে বাস্তবায়িত করতে আবারও এগিয়ে এসেছে #বাংলা_সংস্কৃতি_মঞ্চ।
সংগঠন হিসেবে আমাদের সামাজিক দায়িত্বপালনে আমরা ঠিক করেছি জেলায় জেলায় আমরা পৌঁছে যাবো মানুষের কাছে। তাদের পাশে দাঁড়াবো। তাদের ভরসা দেবো, জোটবেঁধে ধর্ম-জাত-পাত ভুলে সব সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে, সমস্ত ধর্ম-ভাষা-লিঙ্গ-বর্ণ ভিত্তিক বিভাজনপন্থার বিপক্ষে আপোষহীন লড়াইয়ে ব্রতী হতে। আজ দেশের এই দুর্দিনে এ ছাড়া বাঁচার পথ নেই।
আমাদের পরিকল্পনা, প্রথম পর্যায়ে, বাংলার প্রতিটি জেলায় এক এক জন ভারতীয় মনীষী’র স্মরণে, তাঁদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি’র বোধ, বার্তা এবং বাস্তব সার্থকতা নিয়ে মানুষের কাছে গিয়ে দাঁড়াবো। সামর্থ্য সীমিত হোক, কিন্তু সদিচ্ছায় আমরা দুর্বল নই।
ঠিক করা হয়েছিল প্রথম অনুষ্ঠান দুটিতে বিধৃত হবে কাজী নজরুলে’র সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বার্তা। জেলা হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে #মালদা এবং #বীরভূমকে। চুরুলিয়া যে স্বয়ং বিদ্রোহী কবির জন্মভূমি। যে কবি সব ধর্মের, জাতের বজ্জাতির বিরুদ্ধে মানুষের স্বপক্ষে অনায়াসে গলা তুলে বলতে পারেন –
“গাহি সাম্যের গান –
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান,
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম-জাতি
সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।……. ”
যিনি ধর্ম পরিচয়ে মুসলিম হয়েও লিখতে পারেন অজস্র বিখ্যাত শ্যামা-সঙ্গীত। কারণ শ্যামাঙ্গী মা যে তাঁর কাছে শুধু হিন্দু মন্দিরের পাথুরে বিগ্রহ নন, মা যেন তাঁর গ্রামেরই মেয়ে, তাঁর মানবজন্মের নাড়ির টান, তাঁর মুখের ভাষার প্রথম প্রতিশ্রুতি।
২৪.০১.২০১৯ মালদার অনুষ্ঠানটি সুষ্ঠুভাবে সারা হল। সংগঠনের স্থানীয় সদস্যদের সাথে অনুষ্ঠানটি সুসম্পন্ন করার দায়িত্বে সফল সংগঠনের বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চের সক্ষম কর্মকর্তা ড. নুরুল আলম , ড. মহ. ইসমাইল, নাজিবুর রহমান। মানুষ সমর্থনে এগিয়ে এসেছেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে।
এরপরের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে বীরভূমের #নলহাটি তে । ২৬.০১.২০১৯, আগামী শনিবারে।
বন্ধু, এরপরে অন্যান্য জেলাতেও আমরা আসবো আপনার কাছে। আসবো বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথকে পাথেয় করে, আসবো দেশনায়ক সুভাষচন্দ্রের আলোয় আমাদের সমাজকে চিনে নিতে। আমাদের দেশকে চিনিয়ে দিতে। আসবো আমাদের সবার সামাজিক সম্প্রীতি রক্ষার দায়িত্বকে অধিকার হিসেবে রক্ষা করতে।
একটু সময় করে আপনিও আসুন বন্ধু, আমাদের সাথে। আসুন আমরা গড়ে তুলি সেই সচেতন সমাজ, যেখানে আমাদের মানুষ পরিচয়টাই প্রথম, মানুষ পরিচয়টাই পল্লবিত, মানুষ পরিচয়টাই প্রবলতম প্রাণশক্তি। যে পরিচয় কোনো বিভাজননীতির পণ্য নয়।