সুন্দরবনের নদীবাঁধ ও বিশ্ব উষ্ণায়ন

সেখ শামসুদ্দিন: ডাকিছে ঘর ছাড়া ঝড়েরও বাঁশি- অশনি আঘাত হানে পূবালী আসি’– ‘পরিমিত বৃষ্টি’র মেঘ দেখে সুন্দরবনী’রা যেমন হাসে তেমনি কখনো কখনো ‘নীড় ভাঙা ঝড় আর মেঘ ভাঙা’ বৃষ্টির তান্ডবে ‘ঘর ছাড়া’ জঙ্গুলেদের চোখের পাতা অনির্দিষ্টকালের জন্য মৌনতায় জড়িয়ে যায় অনেকটা মাদকের নেশার মতো, হয়তোবা জলও পড়ে বৃষ্টির মতো ।

    এমনিতে কোটলের জলস্ফীতি, নিম্ন বা অতিগভীর নিম্নচাপের প্রভাবে প্রবল বর্ষণ এবং দুরন্ত গতির ঝড় কিংবা ধেয়ে আসা সুপারসাইক্লোন সুন্দরবন এলাকার জোড়াতালি দেওয়া ‘নদীবাঁধ’ যত্রতত্র ভাঙছে বা উপচে পড়া নোনাজল প্লাবিত করছে নগরকূল । কৃষি জমি, ঘর বাড়ি- এক চিলতে আশ্রয় হারানো সুন্দরবনীরা জীবনের চেনা ছন্দে ফিরতে না ফিরতে আবার অশনিগ্রাস ।

    ওঁরা বুঝেছেন, পা না ভিজিয়ে হয়তো সাগর পাড়ি দেওয়া যায়, কিন্তু চোখ না ভিজিয়ে জীবনের তরী বাওয়া যায় না । সুন্দরবনী’রা হয়তোবা অনুধাবন করেছেন, ‘তলানির শেষ স্তরে অবস্থান করে নূন্যতম স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজতে খুঁজতে একদিন মৃত্যুর কাছে পৌঁছে যাওয়ার নামই হয়তো জীবন’।

    রুপোলি ফসল- ‘মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া’, উৎকৃষ্ট মানের মধু সঙ্গে সদ্য উৎপাদিত অঢেল অক্সিজেন আর আছে বিকশিত পর্যটন শিল্প ।

    আমরা অনেক কিছু নিচ্ছি ‘সুন্দরবন আর নদীখাল’ থেকে কিন্তু খ্যাপা মাতলা, বিদ্যাধরি, কালিন্দি, ঝিলা, রায়মঙ্গলপ্রমুখ নদীগুলোর জলস্ফীতি আটকানোর মতো ‘নদীবাঁধ’ তেমনভাবে তৈরি হয়নি বা পরিকল্পনার কথা শোনাও যায় না ।

    আয়লা, বুলবুল, আমফন বা ইয়াস বিধ্বস্ত সুন্দরবনীদের ত্রাণ দিতে গিয়ে জীবনরেখার এপারে সাধারণ মানুষের মনের কথা শুনেছি । বিশ্বাস করুন, সোঁদা গন্ধ মাখা মানুষগুলো চরম বিপর্যয়ে পড়েও ‘ত্রাণ’ চায় না, ওঁরা চান একটা ‘নদীবাঁধ’ যে বাঁধ ভেঙে বা উপচে সাগরের নোনাজল ওঁদেরকে ভাসাবে না- করবে না গৃহহারা ।

    ‘একা রামে রক্ষে নেই সুগ্রীব দোসর’- পরিবেশ দূষণ এবং বিশ্ব উষ্ণায়ন এর ফলে বর্তমানে পৃথিবী মহাসংকটের মুখে । কিন্তু, পরিবেশবিদগণের পরামর্শ নিয়ে যাঁদের চিন্তা ভাবনা করার কথা তাঁরা তো রাজনৈতিক কচকচানিতে ব্যস্ত । মানবকূলের সর্বাঙ্গীন উন্নতির ভাবনা চিন্তা ছেড়ে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী মানুষ দেশের ‘প্রতিরক্ষা’র দোহাই দিয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ‘মানুষ’ মারার জন্য বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় করছেন ।

    রথী মহারথীরা ক্লাস্টার, পারমানবিক ও আনবিক বোমাসহ অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র তৈরিতে ব্যস্ত । এছাড়া, লক্ষ লক্ষ লিটার প্রেট্রল, ডিজেল এবং কেরোসিন তেলের দহন তো আছে । ফলস্বরূপ- কার্বন ডাই-অক্সাইডের সঙ্গে কার্বন মনোক্সাইড, ক্লোরোফ্লুরো কার্বন এবং সালফার ডাই অক্সাইডের মতো বিষাক্ত গ্যাসগুলো নির্মল বাতাসকে দূষিত তো করছেই সঙ্গে বাড়িয়ে তুলছে পৃথিবীপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ।

    পরিবেশ বিজ্ঞানীরা পরিস্থিতি বিবেচনায় ক্রমবর্ধিত এই তাপমাত্রার সর্বোচ্চ বিপদসীমা নিরূপণ করেছেন ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস অবধি । ইতিমধ্যে আমরা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করলেও বিজ্ঞানীরা ১.৫ ডিগ্রির মধ্যে তাপমাত্রা বেঁধে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন যা কিন্তু ভয়াবহ বিপদেরও কারণ । সম্প্রতি রাষ্ট্র সঙ্ঘের সাধারণ সচিব আন্টিনিও গুটেরস এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, চলতি শতকের শেষের দিকে উষ্ণায়নের এই তাপমাত্রা বেড়ে ২.৭ ডিগ্রি হওয়ার সম্ভবনা বেশি ।

    ২০১৪ সালে জাপানের ইয়োকাহামায় আবহাওয়া বিজ্ঞানীদের এক পর্যালোচনা সভায় ব্লুমিন্টনের ‘ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটির পাবলিক এভায়রনমেন্টাল আফেয়ার্স’ এর অধ্যাপক রাফায়েল রুবিনী আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন- ‘ক্রমবর্ধিত বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে উভয়মেরুর জমাকৃত বরফ গলে যে হারে সমুদ্রপৃষ্ঠের জল স্তর বাড়ছে তাতে আগামী ৮৬ বৎসরের মধ্যে কোলকাতা এবং মুম্বই শহর ঘুমিয়ে থাকবে ৫/৬ ফুট জলের তলায় আর উপকূলীয় অঞ্চলের ৫ কোটি মানুষ গৃহহারা হবেন । বাংলাদেশি আবহাওয়াবিদ ডঃ আতিক রহমান আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন- বাংলাদেশের ১৭% ভূমিসহ সুন্দরবনের সমগ্র এলাকা জলমগ্নের কারণে সম্পদহানী তো হবেই সঙ্গে ১ কোটি ৮০ লক্ষ মানুষ গৃহহারা হবেন । অন্তরবর্তীকালীন সময়ে সতর্কতা অবলম্বন না করলে অদূরের পরিস্থিতি কিন্তু অতি ভয়াবহ ।
    অতি বাস্তব, সমগ্র নদীবাঁধ কংক্রিটের তৈরি হওয়া অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং সময় সাপেক্ষ । কিন্তু বারংবার জোড়াতালি দেওয়া অপেক্ষা যদি সুদূরপ্রসারী স্থায়ী নদীবাঁধের চিন্তা ভাবনা কিংবা কংক্রিটের লক্ষ্যে দফায় দফায় পরিকল্পনামাফিক কাজ শুরু করা যায় , তাহলে কয়েক লক্ষ্য আস্থাহীনতায় ভোগা জঙ্গুলে মানুষ অবশ্যই ফিরে পাবে জীবনের দিশা ।