আমার পরিবার বিজেপি পরিবার — প্রচার এবং উদ্দেশ্য

সুমন সেনগুপ্ত ,কলকাতা বিশ্ববিদ‍্যালয় : ১৯৩৩ সালে জার্মানি তে প্রথম নাগরিক দের চিহ্নিত করার কাজ শুরু হয়, IBM এই কাজ টা শুরু ক্রে।সম্ভবত নাতসি বাহিনী বুঝতে পেরেছিল তথ্য কতটা জরুরী সে যুগেও,যার ফলে কিভাবে ইহুদী দের চিহ্নিত করে মেরে ফেলা যায় , তার জন্যই এই প্রক্রিয়া। কিভাবে ইহুদী দের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা যায়, তার জন্যই এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল সেই সময়ে ইহুদী দের নাম, গোত্র, থিকানা, কর্মস্থল, পেশা, বাসস্থান, সম্পত্তি সমস্ত কিছু সংগৃহীত হয়েছিল বহু বছর ধরে, চাহিদা মতো তা পাঠিয়ে দেওয়া হতো নাৎসি বাহিনীর হাতে…তারপর টা তো ইতিহাস। সেই মেশিন যার সাহায্যে এই তথ্য সংগৃহীত হয়েছিল তার নাম হলেরিথ মেশিন, যা আজও সংরক্ষিত আছে আমেরিকার হলোকাস্ট মিউজিয়াম এ।কিভাবে এই মেশিন এর সাহায্যে হল্যান্ড, ফ্রান্সে ইহুদী দের সম্পত্তি দখল করা হয়েছে তা সহজেই অনুমেয়। ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ এর মধ্যে খুব সুনির্দিষ্ট এবং সুচারু ভাবে এই কাজ টা করা হয়েছিল যাতে ইহুদিদের কোনও ঘেঁটোতে সরিয়ে দেওয়া যায় এবং চিহ্নিতকরণ করা যায়। শুধু ইহুদিদের নয়, কমিউনিস্ট, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট, ট্রেড ইউনিয়ন কর্মীদেরও আলাদা করে চিহ্নিতকরণ করা হয়েছিল। শুধু জার্মানি কেন, আফ্রিকার রাওয়ান্ডা তে ১৯৯৩ সালে যে ব্যাপক গণহত্যা হয়েছিল…সেটাও এরকমই বেশ কিছু তথ্যের সাহায্যে। আমাদের দেশেও গুজরাটে যে গণহত্যা চালানো হয়েছিল তাও আজকে পরিষ্কার যে গুজরাট তার নিজস্ব তথ্য ভাণ্ডার তৈরি করেছিল। চিহ্নিত করা হয়েছিল মুসলিম দের অঞ্চল , বাসস্থান, তারপর বেছে বেছে মারা হয়েছিল সেটা আজকে সবাই জানে।

    সারা দেশে একটা প্রচার বিজেপি শুরু করেছে যে বাড়ির দরজায় কিংবা গাড়িতে স্টিকার লাগাতে হবে যে “ আমার পরিবার বিজেপি পরিবার”। আপাতত এটা কর্মী সমর্থকদের মধ্যে সিমাবদ্ধ থাকলেও অচিরেই এটা একট উন্মাদনার চেহারা নেবে। যে কেউ এই স্টিকার লাগাতে অস্বীকার করবে তার উপরেই আক্রমণ নেমে আসবে।এর মধ্যে দিয়ে চিহ্নিতকরণের প্রাথমিক কাজটা শুরু হবে,কিন্তু এই কাজটা বহুদিন আগেই শুরু হয়ে গেছে আধারের মাধ্যমে। একজন মানুষের নাম দেখেই বোঝা সম্ভব সে কোন ধর্মের মানুষ, কোন জাতি সেটা জানাও এমন কিছু কঠিন বিষয় নয় ,সুতরাং যদি কেউ অন্যান্য ধর্মের এবং জাতির মানুষদের আলাদা করতে চায় এটা কি খুব কঠিন কাজ ? এরপর যদি জার্মানি বা রাওয়ান্ডার মতো কোনও গণহত্যা সংঘটিত করা হয় তাহলে কি খুব অবাক হবেন। যদিও বাঙলার বিজেপি নেতারা বলেছেন তৃণমূলের সন্ত্রাসের মুখে এটা করা কার্যত কঠিন, যদিও সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর ব্যাখ্যা, ‘একই পরিবারের মধ্যেও তো ভিন্ন রাজনৈতিক মতের মানুষ থাকতে পারেন। আমার পরিবার, বিজেপি পরিবার স্টিকার সাঁটলে তা এক ধরনের জবরদস্তি। তৃণমূল যে-রকম জবরদস্তির রাজনীতি করছে বাংলায়, এটা যেন পাল্টা একটা জবরদস্তি রাজনীতির প্রতিফলন। এটা ঠিক না। বিজেপির এই কর্মসূচি বাংলায় কোনওদিন কার্যকরী হবে না।’ এটা কি এতো সহজে ব্যাখ্যা করা যায় ? এই ফরমানের মধ্যে যদি ফ্যাসিবাদের পদচিহ্ন না শোনা যায় তাহলে আর কবে শোনা যাবে? ঠিক যেভাবে একজন মানুষ কি খাবেন, কি পড়বেন সেটা যেমন ওরা ঠিক করে দিতে চাইছে ঠিক সেই জন্যই এই চিহ্নিতকরণ। তার মানে যারা বিজেপির এই আমার পরিবার বিজেপি পরিবার এর বাইরে যারাই থাকবেন তারা অন্যদিক দিয়ে চিহ্নিত হলেন সুতরাং মুসলমান, কমিউনিস্ট , মানবাধিকার কর্মীরা সবাই লক্ষ্যবস্তু আজ না হয় কাল। হয় তুমি দেশভক্ত নয় তুমি দেশদ্রোহী। ঠিক যেভাবে সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে আজকে, আগামিকাল যারাই এই স্টিকার লাগাতে অস্বীকার করবে সেই হয়ে যাবে দেশদ্রোহী।
    সুমন সেনগুপ্ত
    কলকাতা বিশ্ববিদ‍্যালয়
    ৯৮৩০০১০৯৬৩