|
---|
একজন ভাবুক শিক্ষক -কবির কাছে ফেল করা ছাত্র গিয়েছিল, পাশের সাজেশান নিতে, তিনি বললেন, ওঠো, জাগো, লক্ষ্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত থেমো না, মাস্টারের কথায় সে হাঁটতে থাকলো, হাঁটতে..হাঁটতে সে পথেই লুটিয়ে পড়ল। কিন্তু পথ ফুরালো না। কাল প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, তিনি অর্থনীতির দর্শনের ক্লাস নিচ্ছেন, আর আজ তাঁর অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাব শুনে মনে হলো আমাদের অর্থনীতির অবস্থা বিপন্ন পরিযায়ী শ্রমিকদের মতন না হয়! বাড়ি ফেরার পথ খুঁজতে খুঁজতে বেঘোরে প্রাণ না যায়!! দেশের অর্থনীতির বৃদ্ধির হার তো এখন শূন্যে এসে ঠেকেছে, এর পর ঘুরে দাঁড়ানোর দূরের কথা, যে হারে ঘাটতি বাজেট বাড়ানো হচ্ছে অথচ চাহিদা বাড়ানোর ঠিকানা নেই কাজ তৈরি করবার কোন দিশা নেই, এসবের সম্মিলিত যোগফল হল অর্থনীতির কাঠামোটা ই বেহাল হয়ে যাওয়া।
তাই মনে ভাবছি, পাশ করা তো দূরের কথা, শেষ পর্যন্ত প্রাণটা থাকবে তো?
করোনা আক্রান্ত অর্থনীতিকে বাঁচাতে প্রধানমন্ত্রীর বিশ লাখ কোটির দাওয়াই কে বলা যেতে পারে জরিবুটি টোটকা। টাকার অঙ্কে খারাপ নয়। এর চাইতে বেশি প্রত্যাশাও কেউ করবে না।কিন্তু যাকে প্রাণ দায়ী ওষুধ দেওয়া দরকার তাকে যদি কেউ মুসম্বির জুস দেয়, সেই মরণাপন্ন রোগীর কি হাল হতে পারে? হাতুড়ে চিকিৎসা বলতে যা বোঝায়।
এইভাবে ভারতীয় অর্থনীতি কে ঘুরিয়ে দাঁড় করানো অসম্ভব।
প্রশ্ন উঠবে কেন?
টাকা ঢাললেই হয় না, কোথায় ঢালতে হবে সেটা জানা চাই, সবার আগে প্রয়োজন অর্থনীতির বুনিয়াদ শক্ত করা, সেই সঙ্গে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সেই হিসেবে খরচ করতে জানা চাই ।
প্রশ্ন উঠবে টাকা ঢালছে সরকার !!! তাতে কি এগুলো হচ্ছে না? না হচ্ছে না। বাচ্চার খিদে পেলে কেউ যদি বাজার করতে যায় , তাতে যেমন খিদে মেটে না। তেমনি এই মুহূর্তে দেশে দরকার গরিব মানুষের হাতে কাজ দেওয়া।১০০দিনের কাজের মত একের পর এক প্রকল্প সৃষ্টি করা। অর্থনীতিতে এখন চাহিদার আকাল। প্রধানমন্ত্রীর উচিত ছিল সকল শ্রেণীর মানুষের হাতে যাতে টাকা আসে..! তার জন্য করে সুবিধা না দিলে ভালো করতেন।কারণ সরকারের নিজের কোষাগারে ঘাটতি । তবু ঘাটতি বাড়িয়ে হাত খুলে টাকা দিলেন, কিন্তু সংকট কাটবে না।কারণ এই অর্থের সত্তর শতাংশ যাচ্ছে শিল্পের পুঁজি যোগানে ঋণ হিসেবে, তাতে চাকরি তৈরি হচ্ছে না।এতে আমজনতার চাহিদা মিটবে না।
না মিটবে না। স্পষ্ট করেই বলছি, ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্পেও তেমন কোনো কর্মসংস্থান তৈরি হবে না।কিন্তু সমস্যা বাড়বে আমজনতার।কারণ, ঘাটতি বাড়বে, দাম বাড়বে জিনিসের।
প্রথম কথা বুঝতে হবে দেশের কোষাগারে এত টাকা ঢালবার মতো অবস্থায় নেই। জিডিপির সাড়ে ৩ শতাংশ পর্যন্ত খুব বেশি হলে আর্থিক ঘাটতি মেনে চলা যায়, সেখানে এই মুহূর্তে তা গিয় পৌঁছে গেছে ৬ শতাংশের বেশি
। এরপর যদি আরও ২০ লক্ষ কোটি টাকা সরকার খরচ করে কিন্তু ২০ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান যদি তাতে না তৈরি হয় , তাহলে এভাবে আরো লক্ষ কোটি টাকা দিলেও মিটবে না। উল্টে জিনিসের দাম তরতর করে বেড়ে যাবে। কঠিন সংকটে পড়বে গরিব মানুষ এবং মধ্যবিত্ত, দেশের অন্তত অর্ধেক মানুষের চরম দুর্দিন সমাগত।
তিন মাস ধরে মানুষকে খাওয়ানোর জন্য আপাতত বরাদ্দ হয়েছে প্রায় সোয়া দুই লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে আছে এক লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার অন্নপূর্ণা যোজনা, আছে পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দ রেশনের জন্য। সাকুল্যে দু লাখ কুড়ি কোটি টাকা আর আগামী তিন মাসের মধ্যে খেতেই চলে যাবে। এই টাকা সম্পূর্ণ অনুৎপাদক ব্যয়। যদি ভাবা যায় এটা বরাদ্দ হয়েছে ত্রাণ এর কথা ভেবে, তাহলে কিছু বলার নেই। সে ক্ষেত্রে বলব, এটা দ্বিগুণ হলে আরো ভালো হতো।
কিন্তু যদি বলা যায় যাদের জন্য ত্রাণ তাদেরকে বাঁচানোর জন্য? না চার মাস পর তাদের খাবার যখন আর সরকার দেবে না তাদের হাতে আর টাকাও থাকবে না কেনার। সরকারের ঘোষণায় তাদের বেঁচে থাকা বা নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। অন্তত আজকের প্রথম কিস্তিতে অর্থমন্ত্রীর ভাষণ রূপরেখা তেমন কোন ইঙ্গিত দিচ্ছে না। আজকের হিসেবে কেবল মাত্র ৫২ হাজার কোটি টাকা আছে সরাসরি ৫২ কোটি মানুষকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। যাদেরকে পৌঁছে দেওয়া হবে জনধন প্রকল্পে তাদের সংখ্যাটা এরকমই। সেই হিসেবে ভাবা যেতে পারে যে মাথাপিছু হাজার টাকা তারা পাচ্ছেন। সেটাও তো সাময়িক বন্দোবস্ত। তারপর? তেমন কোন আয়ের এর সূত্রে যদি আয়ের পথ তৈরি হতো,তাহলে তারা পরের বাসগুলোতে বাঁচার একটা ঠিকানা পেত। এই করো না গত দু’মাসে কাজ হারানো প্রায় ৫০ কোটি মানুষের কাছে এখন সেটাই সবচাইতে বড় প্রশ্ন। অর্থনীতির কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক সংস্থা cmir যার আছে গত দু’মাসে১১ কোটি ৪০ লক্ষ মধ্যবিত্ত চাকরি হারিয়ে এখন নিম্নমধ্যবিত্তের মতন দিন গুজরান করছে।দিন আনা দিন খাওয়া তাদের সমস্যা। অন্যদিকে দেশের প্রায় ৪৭ কোটি অসংগঠিত কর্মচারীর মধ্যে লকডাউন উঠে যাওয়ার পর কাজে ফিরে ফের আই এর পথে ফিরতে পারবে হয়তো মেরে কেটে ২৭ কোটি। তাঁদের ফিরে আসার জায়গাটাও খেয়ে নিয়েছে অনেক ছোট দোকানদার ব্যবসায়ী। যে কাজ করবার জন্য একসময় তারাই ছোট ছোট দোকানে কাজ করতো, এখন সংকটে পড়ে এসব দোকানে কাজ করছে মালিক নিজেই। শুধু তাই না, নানাভাবে তাদের বিকল্প খুঁজে নেওয়া হচ্ছে, কাজ তৈরি হওয়ার জায়গাটা কমে যাচ্ছে। অর্থনীতির মূল সংকটের জায়গা এখন এইটা। গত দুই আড়াই মাসের লকডাউনে বৃহৎ পুঁজি তার সমাধান করে নিতে পারবে, কিন্তু ক্ষুদ্র পুঁজির আর দিন আনা দিন খাওয়া অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মীরা এতটাই কোণঠাসা যে তারা তাদের লোকসান কেন ভবিষ্যৎ কে অনেকেই নতুন করে খুঁজে পাবে না।
প্রধানমন্ত্রীর আত্মনির্ভর যোজনায় আজ অর্থমন্ত্রী এসে যে ১৫ টা নানা রকমের ব্যবস্থার কথা বললেন, তাতে কিন্তু এইসব সমস্যা সমাধানের কথা বলা নেই। এমনকি যদি ধরে নেওয়া যায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য সরকারের ঋণদান প্রকল্প বা নতুন করে ২০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজে সমস্যা মিটবে তাহলে সেটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। কারণ, এই সুযোগ সুবিধা এবং ঋণ নিয়ে ভুগতে থাকা মোট ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প কবে ঘুরে দাঁড়াবে তা দেব না জানন্তি কুতো মনুষ্যা।
শুনতে এইসব কথা খুব ভালো,কিন্তু ব্যাংকে গিয়ে এই সব টাকা আসবে সেই টাকার লগ্নি হবে, কিন্তু তার জন্য এমন কোনো বড় মাপের কাজ শুরু হবে যে তার জন্য নতুন লোক নিতে হবে, তা কিন্তু বাস্তবে হবে না। উল্টে এই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের সংজ্ঞা বদলের খেলায় নেপোয় দই মারবে শতকোটি টাকার মালিক রা। তাদেরকে বিনা বন্ধকী ঋণ দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। কেন? এই টাকা যদি বিনা বন্ধকী ঋণ দিতে রপ্তানিখাতে ব্যবহৃত হতো, তাহলে বরং বলা যেত যে টাকা আদায়ের অন্য পথ খোলা আছে , কিন্তু একজন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প সংস্থা র মালিক যদি ডোবেন, তার কাছ থেকে সরকারের পাওনা কতটুকু থাকবে? ঘোর অনিশ্চিত এই ঋণ দানে তবুও কিছুটা হয়তো উপকার পাবে সাধারণ মানুষ, সেটাও তো বড় সামান্য। সত্যি কথা বলতে গেলে এখনো পর্যন্ত তিন কোটি ৬০ লাখের হিসেব পাওয়া গেল, কিন্তু বাকি ? প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রী বলেছেন ২০ কোটি লাখ টাকা বরাদ্দ করছেন, তাহলে বাকি১৬ কোটি ৪০লাখ ??? প্রশ্ন তুলেছেন কংগ্রেস নেতা প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী চিদাম্বরম নিজেও। তাঁর কথায়, “সরকার নিজেই নিজের অজ্ঞতা আর ভয়ের কারাগারে বন্দি। ”
বিরোধী দলের কোনো নেতা কিছু বললেই সেটা গ্রহণ করতে হবে তার কোনো মানে নেই, কারণ তারা বিরোধী রাজনীতি করেন অকারণে সমালোচনা করবেন সেটা ভেবে নেওয়া যেতেই পারে, চিদাম্বরমের কথাকে গুরুত্ব না দিয়ে যদি শুধু ওই কথাটাই ভাবা হয় যে যে ৩৫ কোটি মানুষ কাজ হারালো, তারা শেষ পর্যন্ত কাজ ফিরে পাবে কি করে? তারা যদি ফিরে আসতে না পারে কর্মক্ষম হয়ে, তাহলে বাজার থেকেও তো কমে যাবে ক্রেতা, শুধুই লগ্নিকারীকে লোন দিয়ে উৎপাদন হতে পারে। কিনবে কে? বাজারে চাহিদার আকাল হলে উন্নয়নেরপথ দেখাবে কে?
গতকাল প্রধানমন্ত্রী নিজেই বারবার বলেছেন চাহিদা বাড়াবেন। কিন্তু সেই চাহিদা বাড়াবার দাওয়াই কোথায়? সরকারের কোন প্যাকেজ এই তো মানুষের পকেটের টাকা বাড়ছে না! অর্থনীতি তাহলে ঘুরে দাঁড়াবে কি করে?
সরকার নিজেই যে প্রশ্নটা খুঁজছেন, অর্থমন্ত্রীর আজকের প্রস্তাবে তার উত্তর নেই। কর কিছু কম দিলে বা বিদ্যুৎ বন্টন কোম্পানিকে কিছু ছাড় দিলে অর্থলগ্নি সংস্থা গুলোকে কিছু দান খয়রাতির মতো সাহায্য করলে সাধারণ মানুষের প্রকৃত কি উপকার হয়? কর্মসংস্থান বাড়াবার দাওয়াই কোথায়? ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প? লগ্নি করার ঋণ দিলে কি উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা কি বাজারে বাড়ে? তেজী বাজারে সেটা যতটা কাজে দেয়, অর্থনীতির মন্দায় সেটা ততটাই ব্যর্থ হয়। এই সরকার সেটা বুঝতে পারছে না।
মানুষের হাতে খরচ করার জন্য টাকা বাড়বে কিসে?
সরকারের আরও প্রস্তাব দেওয়া বাকি আছে।
আমরাও তাকিয়ে আছি এই কথা ভেবে যে সরকার নিশ্চয়ই এই কাজ হারানো প্রায় ৩৫ কোটি মানুষের কথা ভাববে?
ক্রমশঃ, সরকার আরও নানা প্রস্তাব আনবে। আমরা অপেক্ষায় থাকছি। তবে একটা কথা মনে হচ্ছে, জরিবুটি দিয়ে জ্বর সারতে পারে, জাত হাকিম ছাড়া মরণাপন্ন রোগী বাঁচানো। এই সময় রঘুরাম রাজন কে দরকার ছিল।আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার পর্যন্ত বিশ্ব অর্থনীতিকে করোনা সংকট থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য তাঁর কাছে পরামর্শ চাইতে পারে , শুধু আমরা তাঁকে আমন্ত্রণ জানাতে পারিনা।
তথ্যসূত্র বার্তা সাম্প্রতিক