নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ কী প্রভাব পড়ুয়া, শিক্ষকদের মধ্যে

নিজস্ব সংবাদদাতা : দিনকয়েক আগের কথা।
গোয়ালতোড়ে একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে গিয়েছেন এক পার্শ্বশিক্ষক। আত্মীয়দের সঙ্গে কুশল বিনিময় পর্ব শেষ হয়েছে। ওই পার্শ্বশিক্ষক শুনলেন, পিছন থেকে কে যেন বললেন, ‘‘ওই যে এসে গিয়েছে পার্থশিক্ষক।’’দিন সাতেক আগের কথা।
মেদিনীপুরের একটি স্কুলে আলোচনায় ব্যস্ত কয়েকজন শিক্ষক। ‘টিচার্স রুমে’ই জোর জমেছে আলোচনা। প্রসঙ্গ রাজনীতি। একজন শিক্ষক ঢুকতেই আলোচনার তীব্রতায় যেন একটু ভাটা পড়ল। কেউ বিদ্রুপ সহকারে হেসে উঠলেন। কেউ ফেললেন দীর্ঘশ্বাস। এ সব যাঁকে উদ্দেশ্য করে বর্ষিত হল সেই শিক্ষক বছরখানেক আগে বদলি হয়ে এসেছেন ওই স্কুলে। ‘ট্রান্সফার অন স্পেশাল গ্রাউন্ড’ অর্থাৎ বিশেষ কারণ দেখিয়েই হয়েছে বদলি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে স্কুলে সহকর্মীদের কাছেই সন্দেহের চোখে তিনি! আড়ালে আবডালে তাঁর বদলি নিয়ে নানা চর্চা। সহকর্মীদের চর্চা কানে আসে তাঁরও। শুনতে পান এদিক-ওদিক থেকে উড়ে আসা মন্তব্য, ‘‘ওই সে স্পেশাল কেস!’’ ওই শিক্ষক বলছিলেন, ‘‘স্টাফরুমে এখন আমাকে নিয়ে চর্চা হয়। কয়েকজন সহকর্মীই চর্চা করেন। বুঝতে পারি। খারাপ লাগে। কিছু বলি না। বলতে গেলেই তো গন্ডগোল হবে!’’ ওই শিক্ষক বলছিলেন, ‘‘সহকর্মীদের ধারণা, আমি মনে হয় মোটা টাকা ঘুষ দিয়ে বদলি নিয়েছি। পার্টির কোনও দাদাকে ধরে। না হলে না কি বিশেষ কারণে বদলি সম্ভব হত না।’’ সত্যিই কিছু দেননি? ওই শিক্ষকের মন্তব্য, ‘‘কোথায় কাকে বলেছি, এখন সে সব খুলে নাবলাই ভাল!’’
দিন পনেরো আগের কথা।
স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার জন্য কোলাঘাট স্টেশনে অপেক্ষা করছিলেন কার্তিক হালদার (নাম পরিবর্তিত)। দীর্ঘ কুড়ি বছর ধরে একটি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করছেন। হঠাৎই তাঁর কানে এল দুই অপরিচিত ব্যক্তির কথোপকথন। তাঁরা বলছিলেন, ‘‘শিক্ষকের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিচ্ছো। হবু জামাইয়ের চাকরির কাগজপত্রগুলো ভাল করেদেখে নিও।’’
দিন কুড়ি আগের কথা।
ঝাড়গ্রাম শহরে একটি প্রতিলিপি তৈরির দোকানে ভিড়। তিনজন ব্যক্তি নয়া বিদ্যুতের অফিসে দরখাস্তের জন্য বিভিন্ন নথির প্রতিলিপি করাচ্ছেন। পাশাপাশি একাধিক দরখাস্তে কখনও ডানহাতে আবার কখনও বাঁ হাতে সই করছিলেন ওই তিনজন। পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন এক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। তিনজন চলে যেতেই ওই অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক দোকানের মালিকের কাছে জানতে চাইলেন, ওই তিনজন কি জমি-বাড়ির দালালি করেন? দোকানের মালিক জানালেন না। তিনজনই শিক্ষক। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ওই অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। বললেন, ‘‘কিছুই বলার নেই। শিক্ষকরাই সইজাল করছেন!’’
এ সবই টুকরো ঘটনা। সামগ্রিক ছবিটা হয়তো বা ভিন্ন। কিন্তু রাজ্য রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহ যে তাঁদের সার্বিক অসম্মান, অমর্যাদার মুখে দাঁড় করাচ্ছে তা নিয়ে দ্বিমত নেই শিক্ষকমহলের একাংশের।
তবে এসব ঘটনার মাঝেও এখনও অনেকেই রয়েছেন যাঁরা অন্য পেশা ছেড়ে শিক্ষকতা করছেন। বেশি ছুটি। বেশি বেতনের জন্য নয়। পেশাকে ভালবেসে। মানুষ তৈরি করতে।
বছর সাতেক আগে আদালতের সরকারি কাজ ছেড়ে শিক্ষকতার পেশায় এসেছিলেন গড়বেতার গড়ঙ্গা অঞ্চলের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক। সেই শিক্ষককে গ্রামের মানুষ এখনও শ্রদ্ধা করেন। পেশাবদলের জন্য কৃতজ্ঞতা জানান। ওই শিক্ষক বলেন, ‘‘শিক্ষকতার মহান পেশায় আসতে পেরে গর্ব তো হয়ই। যখন গ্রামের অনেকেই তাঁদের ছেলেমেয়েদেরকে মানুষ করে দেওয়ার আবদার করেন।’’ বেলপাহাড়ি ব্লকের কাঁকো অঞ্চলের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক রেলের চাকরি ছেড়ে শিক্ষকতায় যোগ দিয়েছেন। ওই শিক্ষক বলছেন, ‘‘পড়াতে ভালবাসি বলেই শিক্ষকতায় এসেছি। কিন্তু কিছু ঘটনার জন্য সমগ্র শিক্ষকের বদনাম হচ্ছে।’’ আবার পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতার এক শিক্ষক নেতার প্রাথমিক স্কুল অনগ্রসর সম্প্রদায়ভুক্ত এলাকায়। পার্থ-কাণ্ডের পর কয়েকদিন আগে ওই শিক্ষককে স্কুল থেকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন পাড়ার অনেকেই। প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেলেও, পরে গ্রামবাসীদের আপ্যায়ণে তৃপ্ত হয়েছিলেন ওই শিক্ষক। তিনি বলছিলেন, ‘‘গ্রামের এক পরিবারে বিয়ে বাড়ির অনুষ্ঠানে নতুন বর-কনেকে আশীর্বাদ করতে আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন। আশীর্বাদ করার পর সেখানে উপস্থিত গ্রামের অনেকেই বলেছিলেন – এইসব পিছিয়ে পড়া এলাকার ছেলেমেয়েদের শিক্ষার আলোয় আনতে শিক্ষকদের অবদান ভোলার নয়। তাঁদের মতো বেশিরভাগ মানুষই কিন্তু এখনও শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। বর-কনেকে আশীর্বাদ করতে না গেলে অবশ্য সেটা বুঝতে পারতাম না।’’ অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো। সেই তোতোমার আলো।