বীরভূমের শহীদ রাজেশের কফিন-বন্দী দেহের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে বেলঘরিয়া

সামীরুল ইসলাম,নতুন গতি,রামপুরহাট:-

    সিউড়ি থেকে রামপুরহাট যেতে খয়রাকুড়ি লোকাল ষ্টপেজ। সেখান থেকে আর একটু এগিয়ে বাম দিকে এক কিমি কাঁচা রাস্তা ধরে হেঁটে গেলে রাজেশের গ্রাম। আমরা যখন ৬০ জাতীয় সড়ক থেকে গ্রামের রাস্তায় বাঁক নিচ্ছিলাম দুইজন সিভিক পুলিশ এসে আঁটকাল। বলল “দাদা হেঁটে যেতে হবে”। নরম সুরে আরও যোগ করল, “আসলে দাদা গাড়ি ঢুকতে দিলে ভিতরে জ্যাম হয়ে যাব, সংকীর্ণ রাস্তা বুঝতেই পারছেন”।

    অগত্যা অনতিদূরে একটি ফাঁকা জায়গায় গাড়ি রেখে আমরা জনা কয়েক হাঁটতে শুরু করলাম। আরও কয়েকজন গ্রামবাসী ছিল হাঁটার সঙ্গী। পথ চলতে চলতে ওরাই বলছিল গ্রামের এই কাঁচা রাস্তাটিতে বর্ষাকালে যাবার উপায় নেই। বৃষ্টি হলে রাস্তাটি এক প্রকার নো-এন্ট্রি হয়ে যায়। আদিবাসী গ্রাম কিনা, দুয়ো রাণীর সন্তান, তাই সরকারের তেমন ভ্রুক্ষেপ নেই। রাস্তা সারাইয়ের জন্য এর আগে বারবার ছোট বড় মেজো নেতাদের বলা হয়েছে। ভোটের আগে খুচরো মৌখিক প্রতিশ্রুতি ছাড়া লাভ কিছু হয় নি।

    রাজেশের নিহতের খবর গ্রামে আসতেই গ্রামবাসীরা আর কারুর উপর ভরসা করেন নি। নিজেরাই উদ্যোগ নিয়ে ব্ল্যাক ডাষ্ট ফেলে সাময়িক পাকা রাস্তার মত বানিয়ে নিয়েছেন। গ্রামের বীর সন্তানের মৃতদেহ নিয়ে আসা গাড়িটির গ্রামের ভিতরে ঢুকতে যাতে কোন অসুবিধা না হয়। এই পথ ধরেই আমরা হাঁটছিলাম। দুইপাশে সবুজ ক্ষেত। প্রকৃতিক সৌন্দর্য্যে পরিপূর্ণ গ্রামটিতে কাঁচা বাড়ির সংখ্যা সাকুল্যে ১৫ থেকে ২০ টি। প্রকৃতির কোলে কোলে জায়গা করে নেওয়া মাটির বাড়ি গুলো শহুরে কোলাহল থেকে মুক্ত। শান্ত নিরিবিলি মায়ামাখা ছোট্ট আদিবাসী গ্রাম বেলঘরিয়া। পশ্চিম দিকে তাকালে সবুজ সবুজ। এই সবুজে ঘেরা পরিবেশেই বড় হয়েছে রাজেশ। মূলনিবাসী প্রয়াত বীর সেনা রাজেশ ওরাং।

    রাজেশের পরিবারে মা বাবা ও দুই বোন। বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট বোন উচ্চ মাধ্যমিক পাশ। মা শোক-বিহ্বল। পাথর হয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে আছেন। মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছেন না। অঝোরে কেঁদে যাচ্ছেন। নিজের উপার্জন দিয়ে এক তলা পাকা বাড়িও তৈরি করছিল রাজেশ। মা-বাবাকে ভাল রাখবে কি আপ্রান চেষ্টা দাদার। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে বলছিল বোন। ভাল শিক্ষিত ছেলে দেখে বোনের বিয়ে দেবে বলে পাত্রের খোঁজও চলছিল। রাজেশের নিজের বিয়েও সামনের মাসে হওয়ার কথা। সব ঠিকঠাক ছিল। শুধু দিনক্ষন বাকি। ওর বাগদত্তা ফুটফুটে অষ্টাদশী এই দিন গুলোতে কত স্বপ্ন বুনেছিল রাজেশকে নিয়ে। সব ভেঙে চুরমার।

    একদিকে মা-বাবা-বোন ও বাগদত্তার বুকফাটা কান্নার রোল আর অন্যদিকে বীর সেনানীকে গান স্যালুট দেওয়ার রাষ্ট্রীয় তোড়জোড়। বাড়ির কাছে সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠটি ইঁটের বিছানায় লাল হয়ে উঠেছে। উপরে নীল-সাদা চাদরের ছাউনি। খাঁকি পোশাকের পুলিশে ছয়লাপ। আসতে আসতে বাড়ছে জনসমাগম। মাঝখানের কয়েক পশলা বৃষ্টিতেও দর্শনার্থীরা বাড়ির অভিমুখ হন নি। শেষ বারের মত রাজেশকে দেখবার আশায় বেলা দুটো থেকে বিকেল ৫ টা অব্দি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে গেছে।

    শেষমেস এদিন দর্শনার্থীদের ইচ্ছা পূরণ হয় নি। সন্ধ্যা ৬ টা বেজে গেলে গান স্যালুট দেওয়া হয় না। রাজেশের মরদেহ এমন সময় অন্ডাল এয়ারপোর্টে নেমেছে বলে খবর সেই দুরত্ব অতিক্রম করে ঠিক টাইম মত রাজেশের গ্রামের বাড়িতে পৌঁছানো সম্ভব নয়। মরদেহ আজ তাই থাকছে পানাগড়ের সেনা ছাউনিতে। আগামীকাল সকাল সকাল রওনা হবে মহঃবাজারের বেলঘরিয়া গ্রামের উদ্দেশ্য।

    বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চের পক্ষ দিকে এদিন বেলঘরিয়ায় উপস্থিত ছিলেন আশরাফুল আমীন সম্রাট, সেখ গিয়াসুদ্দিন প্রমুখ। পুলিশের কাছে পুরো বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে বাড়ির পথে আমরা পা বাড়ালাম। যাওয়ার আগে রাজেশের এক চিলতে মাটির বাড়ির খোলা দরজায় মিনিট দশেক দাঁড়িয়ে আবার চলতে শুরু করলাম। এক পুলিশ অফিসার জানালেন আগামীকাল সকাল ১০ টায় গান স্যালুটের আয়োজন হবে।

    জয় ভারতবর্ষ
    জয় জওয়ান
    জয় বাংলা
    জয় ভীম