করোনা কালে উচ্চশিক্ষা: সংকট ও উত্তরণ

অতিথি লেখক – ডঃ শান্তনু পান্ডা:

    বিশ্বজুড়ে নোভেল করোনা ভাইরাস মানব জাতির উপর ভয়, ভীতি ও আতঙ্ক ছড়িয়েছে। “করোনা” শব্দের বাংলা অর্থ জ্যোতিবলয়। সূর্য থেকে ছিটকে পড়া আলোক রশ্মির মত হওয়ায় এই ভাইরাসটির এরূপ নামকরণ।
    চতুর্দশ শতাব্দীতে প্লেগের আক্রমনে মারা গিয়েছিল প্রায় ছয় কোটি মানুষ। গোটা ইউরোপের জনসংখ্যা প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছিল। ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে স্প্যানিশ ফ্লু প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ এর প্রাণ নিয়েছিল। এছাড়াও হয়েছিল অনেক মহামারী- কলেরা, টাইফয়েড, কালাজ্বর, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি।এইগুলোর জন্য ইংরেজ আমলে তৈরি হয়েছিল Epidemic Diseases Act of 1897। এই আইনে রাজ্য সরকারকে মহামারী রোধে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা আছে এবং বিধিভঙ্গ করলে দণ্ডবিধি আইনের 188 ধারায় শাস্তিযোগ্য হবে।
    যাইহোক লকডাউন.(Lockdown) ও কোয়ারেন্টাইন
    (Quarantine) শব্দ গুলো খুবই অপরিচিত। লকডাউন অর্থাৎ ট্রেন , বাসের চাকা বন্ধ , কলকারখানা বন্ধ,দোকান,বাজার, হাট বন্ধ , স্কুল কলেজে সহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। মানুষের সঙ্গে মানুষের, গ্রামের সঙ্গে শহরের রাজ্যের সঙ্গে রাজ্যের , দেশের সঙ্গে দেশের ফিজিক্যাল মিট বন্ধ। বিনোদন, পার্ক, মল, সিনেমা হল, চিড়িয়াখানা, জাদুঘর,কোচিং সবকিছুই বন্ধ। তার একটাই কারণ মৃত্যু আতঙ্ক, যা গোটা বিশ্বকে জব্দ করেছে।

    ২০২০ সালের ৩ মার্চ গোটা বিশ্বের বিভিন্ন আদিবাসী ও জনজাতিদের উপস্থিতিতে নিউইয়র্ক এ অনুষ্ঠিত একটি আলোচনা সভায় তারা বলেছিলেন, করোনা ভাইরাস সংক্রমণের মূল কারণ জীব বৈচিত্র্য, অরণ্য ও জলাভূমির দুর্নিবার ধ্বংস সাধন। এই ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করে বাঁচার একমাত্র উপায় হল ‘একা থাকা’। মানুষের থেকে মানুষের দূরত্ব বজায় রাখা, মুখ নাক ভালো করে ঢেকে রাখ, জনবহুল জায়গায় না যাওয়া, সাবান দিয়ে হাত ধোয়া ও স্যানিটাইজার করা, সর্বোপরি সরকারি ও WHO এর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। বহু বছর আগে চার্লস ডারউইন তার Origin of Speech গ্রন্থে বলেছিলেন, “নিজস্ব অন্তর্নিহিত শক্তির দ্বারা নিজস্ব সমতা বৃদ্ধি পাবে”। বিখ্যাত ইংরেজ দার্শনিক হারবাট স্পেন্সার বলেছিলেন, ” সংগ্রামের মধ্যে আছে অন্ত: প্রকৃতি সংগ্রাম ও পরিবেশের সঙ্গে সংগ্রাম” “Survival of the fittest” is a phrase that originated from Darwinian evolutionary theory as a way of describing the mechanism of natural selection.” (Wikipedia).

    বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়াই হল- সংগ্রামী জীবন। তাই মানুষ এখন শারীরিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে বিপর্যস্ত ।অর্থনৈতিক অবস্থাও খুব খারাপ। শিক্ষাব্যবস্থা উঠেছে শিকেয়। ৬ মাস হলো সরকারি শিক্ষা অবস্থা চলছে টালবাহানার মধ্য দিয়ে। কৃষি নির্ভর গ্রামীণ ভারত টেকনোলজিতে উন্নত নয়। উচ্চশিক্ষা আমাদের দেশে পরিচালিত হয় ugc মাধ্যমে । তারা রুট ম্যাপ করে দেন কিভাবে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠন পাঠন ও পরীক্ষা ব্যবস্থা চলবে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (UGC) উচ্চশিক্ষার মাথা।

    এই বছর কোভিড ১৯ এর করাল গ্রাসে গ্রামের শিক্ষাব্যবস্থা ডামাডোল চলছে। ক্লাস বন্ধ, ভার্চুয়াল ক্লাস হচ্ছে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রাইভেট বিদ্যালয়গুলিতে। যারা স্নাতক পরীক্ষা দেবে তাদের বলা হলো আগের পরীক্ষার থেকে আশি শতাংশ নম্বর এবং কুড়ি শতাংশ অ্যাসাইনমেন্ট লেখার উপর ভিত্তি করে। তো ছাত্রছাত্রীরা সেটা করল। কলেজগুলির নম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা পড়ল। রেজাল্ট বেরোলো ৪ঠা সেপ্টেম্বর ২০২০। স্নাতকোত্তর ভর্তির বিজ্ঞপ্তি হল ২৪ তারিখ থেকে । কিন্তু তার আগে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (UGC) বলল না পুরো ১০০ নম্বরের পরীক্ষা নিতে হবে। ছাত্র-ছাত্রীদের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। পরীক্ষা নিতে হবে অনলাইনে অর্থাৎ বাড়িতে বসে লিখে সময়ের মধ্যে তা সংশ্লিষ্ট পরীক্ষা নিয়ামক দপ্তরে জমা করতে হবে। ভারতের বেশিরভাগ কলেজগুলির গ্রামীণ ছাত্রছাত্রীরা ডিজিটাল মাধ্যমে ঠোটস্থ নয়। বহু ছাত্রছাত্রীর ইন্টারনেট ব্যবস্থা নেই।আবার অনেকের অ্যান্ড্রয়েড মুঠোফোন নেই। বাড়ি থেকে সাইবার ক্যাফে অনেক ধুরে। আবার অনেকে আর্থিক স্বচ্ছলতাও দুর্বল । সাইবার ক্যাফেতে বসে অনলাইন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ডাউনলোড করে তার উত্তর লিখে স্ক্যান করে পিডিএফ তৈরি করে সংশ্লিষ্ট ইমেইল আইডিতে পাঠানো- একটা মোটা টাকা খরচ হয়েছে । ছাত্র-ছাত্রীদের এই পরীক্ষার রেজাল্ট এখনও প্রকাশিত হয়নি। বহু ছাত্র-ছাত্রী নির্দিষ্ট সময়ে সাবমিট করতে পারেনি। তারা বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে কীভাবে উত্তরপত্র জমা করবে তার পরামর্শ নিয়েছে।

    এবার আসি বিদ্যালয় শিক্ষা – সরকারি বিদ্যালয়গুলিতে খুব কম অনলাইন ক্লাস হচ্ছে। যে সমস্ত সরকারি বিদ্যালয় শহরে অবস্থিত সেগুলিতে মোটামুটি অনলাইন ক্লাস হচ্ছে কিন্তু গ্রামীণ বিদ্যালয় গুলির অবস্থা খুবই খারাপ। মিড ডে মিল এর চাল, ডাল আলু দেওয়া ছাড়া কোন ক্লাস হচ্ছে না । তার প্রধান কারণ গ্রামাঞ্চলে বহু মানুষ অর্থাৎ গার্ডিয়ানরা ডিজিটাল মাধ্যম গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়। তাদের সেই জ্ঞান বা টেকনোলজি হ্যান্ডেলিং করার ক্ষমতা নেই।

    একটি উদাহরণ: গ্রামীণ ভারতকে ডিজিটাল ভারতে পরিণত করতে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর ২৪পরগনা জেলার গাইঘাটা ব্লকের অনলাইন টিচিং নামক একটি সংস্থায় অনলাইন টিচিং প্রশিক্ষণ কর্মশালা শুরু করেছে এপ্রিল ২০২০ থেকে। যার মূল কান্ডারী অরূপ মজুমদার। একজন নৃতাত্ত্বিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক। উনার উদ্যোগে প্রথমে ব্লকের সমস্ত শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় কিভাবে তারা এন্ড্রয়েড সেট এর মাধ্যমে অ্যাপ ডাউনলোড করে ক্লাস নেবেন । এটা করার পর ঐ শিক্ষকদের নিয়ে একটি কবিতা,অঙ্কন, ও টিচিং প্রতিযোগিতা শুরু করেন কিন্তু খুব একটা সাড়া পড়ে নি । বহু ছাত্রছাত্রী অংশগ্রহণ করতে পারেনি। কারণ তাদের পিতামাতা টেকনোলজির বিষয় জানেন না। তাই ছেলেমেয়েদের অংশগ্রহণ করাতে পারেন নি। তারপরে সংস্থা বিভিন্ন গ্রামে প্রায় ৫০০ ছাত্রছাত্রীর মধ্যে অনলাইন ও অফলাইনে পাঠদান শুরু করেন আদিবাসী, মুসলিম ও অন্যান্য পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর ছাত্রীর মধ্যে ।পাশাপাশি ১৫০জন মাকে অনলাইন টেকনোলজি প্রশিক্ষণ দিয়ে বর্তমান টেকনোলজি সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা। অত্যাধুনিক মুঠো ফোন থাকা সত্বেও তার ব্যবহার জানে না সেটাই কাটিয়ে তোলার পক্ষে এগিয়ে চলছে অনলাইন টেকনোলজি সংস্থা।

    এই ব্যবস্থা সরকার যদি প্রতিটি গ্রামের বিদ্যালয়ের শিক্ষককে ও পিতা-মাতাকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত করতে পারে তাহলে এ ভারত অনেকটা এগিয়ে যাবে। যাইহোক অনলাইন টিচিং, স্মার্ট ক্লাস, ভার্চুয়াল ক্লাস, ভিডিও কনফারেন্স, ওয়েবিনার মডার্ন টেকনোলজি না জানলে সম্ভব নয়। হাতের লেখা অথবা বই হারিয়ে যাবে না কোনদিন। প্রকৃত শিক্ষা অর্জনের জন্য মনীষীদের বই ও লেখা পড়তে হবে। বর্তমানে হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতি ও সাহিত্যকে ধরে রাখতে হাতে লেখা খুবই জরুরি । কিন্তু গোটা বিশ্বের সঙ্গে তাল দেওয়ার জন্য Modern technology is the most essential.

    এই ধরনের মহামারীর কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য শিক্ষা জগতে এই মডার্ন টেকনোলজি মোস্ট ইম্পরট্যান্ট। সবকিছুই মনুষ্যসৃষ্টি। তাই পৃথিবীতে মানুষের প্রয়োজন অনেক বেশি। এই করাল গ্রাস থেকে মানুষ করবে জয় নিশ্চয়।

    অতিথি লেখক – ডঃ শান্তনু পান্ডা, (গবেষক, নৃতত্ত্ববীদ, প্রাবন্ধিক)