কালি পুজোয় হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির ঐতিহ্য

নতুন গতি নিউজ ডেস্ক: ঠিক কত বছরের পুরনো কালী পুজো? কে শুরু করেছিল? এ সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন না এলাকার প্রবীণতম মানুষেরাও। শুধু জানেন, বহু জনশ্রুতি আর লোকবিশ্বাস মাখা কালীপুজোয় মিশে রয়েছে এলাকার আবেগ। মুর্শিদাবাদের রানীনগর ব্লকের ইসলামপুর ঋষিপুর গ্রামের বড়মা-র পুজো। আজও বয়ে নিয়ে চলছে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির ঐতিহ্য।

    এই পুজোকে ঘিরে একাধিক গল্প কথা, নানান লোকবিশ্বাস। কারও মতে ছ’শো বছরের প্রচীন পুজো ডাকাত কালী নামেই পরিচিত। সে সময় ঘন জঙ্গলে ঘেরা জায়গায় ডাকাতেরা কালী সাধনা করত। তারপর ডাকাতি করতে বের হতো। আবার অনেকের মতে মন্দিরের সামনে বিশাল বিল। জেলেরা মাছ ধরতে নামার আগে দেবী কালিকাকে তুষ্ট করে তবে নামত জলে। কিন্তু, যা-ই হোক না কেন, এক রাতের মধ্যে মূর্তি তৈরি করে রাতেই বিসর্জন দেওয়া হতো বিলের জলে। সকালে গ্রামবাসীরা প্রাচীন বট গাছের নীচে ফুল, বেলপাতা, সিঁদুর পড়ে থাকতে দেখেছেন। কিন্তু, মুর্তি কেউ দেখতে পাননি।

    কেউ বলেন ডাকাত কালী। কারও কারও মতে বিল কালী— নাম যাই হোক না কেন আজও চলেছে সেই পুজো, কার্তিকী অমাবস্যায়। কোনও আড়ম্বর শোভাযাত্রা ছাড়া গভীর রাতে বিলের জলে বিসর্জন দেওয়া হয় ঋষিপুরের কালীমূর্তি। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী দেবীর গায়ের গয়না-সহই বিসর্জন হয়।

    ঋষিপুরে কালীপুজোর রাতে এক সঙ্গে পুজো হয় একাধিক মূর্তির। মূল মূর্তি বড়মা। আর ঋষিপুর ও সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দারা পুজো দেন অন্য মূর্তি। সাধারণত কারও কোনও মনোবাঞ্ছা পূরণ হলে তিনি মানসিকের পুজো দেন। এ বছর মূল মূর্তির সঙ্গে একই বেদীতে পুজো হবে ২৪টি প্রতিমা। বড়মার পুজো করবেন যে পুরোহিত, তাঁর রীতি মেনেই পুজো করবেন বাকি ২৪ জন পুরোহিতও। এমনটাই নিয়ম। এলাকার বাসিন্দারা জানান, সর্বোচ্চ ৩৩ টি প্রতিমা একসঙ্গে পুজো করার ইতিহাস রয়েছে এই এলাকায়। বড়মার পুজো হয় চাঁদা তুলে। বাকি সব মূর্তিই মানসিকের। গ্রামবাসীদের দাবি, কালী মাহাত্ম্য এখন দেশ বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। পুজোর রাতে কলকাতা, দিল্লি, মুম্বই, চণ্ডীগড় থেকেও ভক্তরা আসেন মানসিক নিয়ে।

    এ পুজোর বিশেষত্ব সম্প্রীতিতে। কথিত আছে, একবার মুসলিম সম্প্রদায়ের এক আখের গুড় বিক্রেতা বটগাছ তলায় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। সে সময় স্বপ্নাদেশ পান বড়মা গুড় খেতে চেয়েছেন। তারপর থেকে আজও সেই মুসলিম পরিবার আখের গুড় পাঠায় পুজোর সময়। উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই বড়মার পুজোয় উৎসবে মাতেন। এলাকার বাইরে থেকেই মানুষ আসেন পুজো দেখতে। তাঁদের থাকার ব্যবস্থাও করা হয় পুজো কমিটির তরফ থেকে।

    বলা হয়, প্রতি বছর মূর্তির গায়ে যে গয়না থাকে তা খোলা হয় না বিসর্জনেরপ সময়। অনেকই মনোষ্কামনা পূরণের পর দেবীকে কোনও গয়না দেন। সব শুদ্ধুই বিলের জলে বিসর্জন হয়। এমনকী, পরেও জলে নেমে সে সব তুলে আনেন না কেউ। এখানেও রয়েছে লোকবিশ্বাসের আখ্যান। কোনও এক বছর বিসর্জনের সময় দেবী মূর্তির গা থেকে গয়না খুলে নিতে গিয়েছিলেন পুরহিত। সে সময় কালী মূর্তিতে আগুন ধরে যায়। তারপর থেকে আর কেউ অলঙ্কার খোলার সাহস দেখাননি। সোনার জিহ্বা, খড়গ, বা গয়না অনেকেই উৎসর্গ করেন। সে সব বিসর্জন হয়ে যায়। পুজোর কোনও উপকরণও পুরিহিত বাড়ি নিয়ে যেতে পারে না।