অনশনের ১৪ দিন পর এক অনশনকারী চাকুরি প্রার্থীর ” মন কি বাত “

বিশেষ বার্তা : বেলা তিনটের দুপুররোদে মেয়োরোডের পিচের রাস্তা যে’খানে তীব্র দহনে ধুঁকছে, ঠিক সেখানেই কলকাতা প্রেস ক্লাব থেকে ঢিল ছোঁড়া দুরত্বে ফুটপাথ আর রাস্তার  একফালির উপর ত্রিপল, বস্তা, সতরঞ্চি বিছিয়ে বসে আছেন ওঁরা। গত দু’সপ্তাহ ধরে। টানা। ভয়াবহ রোদের ভ্রুকুটি বা হঠাৎ বৃষ্টির ঝাপটা থেকে বাঁচতে বাড়ি থেকে আনা ওই ছাতা গুলোই সম্বল। মেলেনি মাথাটুকু ত্রিপলে ঢাকার অনুমতিও! মলিন মুখের প্রায় শ’চারেক যুবক, যুবতী ওই ভাবেই পড়ে আছেন ও’খানে। না খেয়ে। হ্যাঁ, না খেয়েই। দিন দশেক রিলে অনশনের পর গত চারদিন হ’লো অনির্দিষ্টকালীন অনশন শুরু করেছেন ওই ২৫ থেকে ৩৫ এর দল। বলা ভালো বাধ্য হয়েছেন, এই পথ বেছে নিতে।

    হঠাৎ, মহানগরের রাস্তায় অনশন কেনো? দাবিটা চরম ন্যায্য। ওঁরা প্রত্যেকে রাজ্য সরকারের স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষার সফল পরীক্ষার্থী। আজ্ঞে, হ্যাঁ, সফলই। ওয়েটিং লিস্টে নাম আছে প্রত্যেকের। স্কুল সার্ভিস কমিশনেরই গেজেটের সংজ্ঞা অনুযায়ী এঁরা প্রত্যেকেই সফল।নিয়ম অনুযায়ীই এঁরা কেউই অকৃতকার্য নন। কিন্তু, মেলেনি চাকরি! এঁরা প্রত্যেক ২০১৬ সালের এসএসসি পরীক্ষার কোয়ালিফায়ার।২০১৭ সালের ইন্টারভিউ পরবর্তী অন্তিম তালিকা অনুযায়ী এঁরা প্রত্যেকেই ওয়েটিং লিস্ট ভুক্ত। খুব সাধারণ লজিকেই যাঁরা ওয়েটিং লিস্ট ভুক্ত,  মূল তালিকায় থাকা প্রার্থীদের নিয়োগের পর যদি শূন্যস্হান থাকে , তাঁরাই সেই চাকরির যোগ্য প্রার্থী হন। এ’ক্ষেত্রে তাহলে প্রথম প্রশ্ন, এমপ্যানেলড প্রধান তালিকার প্রার্থীদের নিয়োগের পর বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী হিসাবে শূন্যস্হান কি রয়ে গেছে? এই প্রার্থীরা যে বহু আরটিআই করেছেন তার একটির রিপোর্ট বলছে, শুধুমাত্র বাঁকুড়া জেলাতেই মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্কুল মিলিয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের শূন্যস্থানের পরিমাণ ১৪০০! এ’বার দার্জিলিং বাদ দিয়ে বাকি জেলাগুলোর কথা ভাবুন, যদি জেলা প্রতি শূন্যস্হান খুব কম করে ৫০০ -ও হয়, তাহলে সংখ্যাটা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় একবার ভেবে দেখুন! রেজাল্ট বেরোনোর আগে পর্যন্ত ভেকেন্সি ছিলো, রেজাল্ট বেরোবার পর হঠাৎ করেই শোনা গেলো সেই ভেকেন্সি হাওয়া!  যদিও, আবারও , আরটিআইয়ের রিপোর্ট একেবারে অন্য কথা বলছে, বারবার।

    এখানেই শেষ নয়, ওয়েটিং লিস্টের যে তালিকাটি বের হয়েছে, সেটিও বড়ই অদ্ভুত, হাস্যকরও! এর আগে পর্যন্ত অন্তিম তালিকায় (এমপ্যানেলড+ ওয়েটিং লিস্ট) যাঁদের নাম থাকতো , তালিকায় তাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, রিটেন টেস্ট, ভাইভা, প্রত্যেকটিতে প্রাপ্ত নম্বর আলাদা করে উল্লেখ করে মোট যোগফল স্পষ্ট দেখানো হোত। এখন সেই সবের বালাই নেই! পুরোটাই শুধু নামের তালিকা! কীসের ভিত্তিতে ক্রমানুসারে এই তালিকা তৈরি হয়েছে, তালিকাটি দেখে সে সব বোঝার কণা মাত্র জো নেই!

    গত দু-আড়াই বছর ধরে ন্যায্য চাকরির দাবিতে প্রশাসনের এক দরজা থেকে আরেক দরজায় ঘুরেছেন এই প্রার্থীরা। এই দফতর থেকে সেই দফতরে একের পর এক ডেপুটেশন জমা পড়েছে। ভেকেন্সি প্রচুর। ডিআই অফিস থেকে সাফ জানিয়ে দেওয়ার পরেও বদলায়নি দুরাবস্থার রোজনামচা! একেতো গত আট বছরে রাজ্যে একদা নিয়মিত এসএসসি পরীক্ষা অনিয়মিত হওয়ার দৌড়ে সবাইকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে, ওই ‘ওয়ান্স ইন আ ব্লু মুন”- এ হওয়া পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়েও মিলছে না হকের চাকরি! বিকাশ ভবন জানাচ্ছে শূন্যস্হান অন্তত ১০০০, তালিকায় নাকি পাঠানো হয়ে গেছে আচার্য সদনে! আচার্য সদন জানাচ্ছে তাদের হাতে কোনও তালিকায় নেই! পিংপং বলের মত একবার এ দফতর থেকে সে দফতরে ঘুরে শেষ পর্যন্ত নিরুপায় হয়েই মহানগরের রাস্তায় অনশনে বসেছেন অন্তত ৪০০ জন মানুষ!

    গত মঙ্গলবার শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকও করে ছিলেন তাঁরা। “সমস্যা মিটবে” এই রকম ছেঁড়া প্রতিশ্রুতি ছাড়া মেলেনি কিছুই! নাহ, আর এই সব মুখের কথায় ভরসা করতে পারছেন না আন্দোলনকারীরা। কেনই বা করবেন? কেন নিয়মিত নয় এসএসসি পরীক্ষা? কয়েকদিন আগে এই প্রশ্নের উত্তরে আমাদের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর জবাব ছিলো ‘এসএসসি দুর্গাপুজো নাকি যে প্রত্যেক বছর হতে হবে?”!

    এই ওয়েটিং লিস্টের প্রার্থীদেরওতো তিনি প্রথমে অকৃতকার্য বলে দাগিয়ে দিয়েছিলেন, নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে! পরে অবশ্য ঢোক গিলতে বাধ্য হন! এই তো কয়েক দিন আগেই দাবিও করে ছিলেন ওয়েটিং লিস্টের প্রার্থীদের চাকরি দিলে নাকি পরের বছর ভেকেন্সি থাকবেই না অন্যদের জন্য! অথচ বাস্তব নাকোচ করছে তাঁর এই দাবিকেও! লিখিত কোনও ডকুমেন্ট ছাড়া কেনো বিশ্বাস করবেন তাঁকে আর মানুষ? কীসের ভিত্তিতে? আড়াই বছরেও যে’খানে সমস্যার সমাধানে প্রশাসন বিন্দুমাত্র কোনও সদর্থক পদক্ষেপই গ্রহণ করে না, সেখানে এই ধরণের ভাসা ভাসা উড়ো প্রতিশ্রুতির মূল্য আদতে কী,কতটুকু?

    না, ওঁরা স্বাভাবিকভাবেই আর এ’সবে ভুলছেন না।”আগেতো  তাও বছরে একবার পরীক্ষা হতো, এক বছর না হলে পরের বছরের জন্য কোমর বাঁধা যেত, এখন তো সে’সবের বালাই নেই” তাই জীবন বাজি রেখেই  বেছে নিয়েছেন অনশন আন্দোলনের পথ। হকের দাবি আদায়