পুলওয়ামা পরবর্তী উগ্র জাতীয়তাবাদী জাঁতাকলের দৌরাত্ম্য

পুলওয়ামা পরবর্তী উগ্র জাতীয়তাবাদী জাঁতাকলের দৌরাত্ম্য

    সুমন সেনগুপ্ত

    কাশ্মীরের পুলওয়ামা জেলায় সাম্প্রতিক মারাত্মক  সন্ত্রাসবাদী হামলার জেরে মেঘালয়ের রাজ্যপাল তথাগত রায় প্রকাশ্যে কাশ্মীর  এবং কাশ্মীরীদের ‘বয়কট’ করার একটি প্রস্তাব সমর্থন করেন। টুইটারে একটি পোস্ট করে তিনি জানান, এক অবসরপ্রাপ্ত কর্নেলের “কাশ্মীর এবং যা কিছু কাশ্মীরী” তা বর্জন  করার প্রস্তাব  সমর্থন করেন তিনি। ওই কর্নেলের বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করে  তথাগত রায়  জুড়ে দেন, “ আমি সহমত।”

    এদিকে যত দিন যাচ্ছে, দেশের বিভিন্ন জায়গায় বসবাসকারী কাশ্মীরী ছাত্রছাত্রী, ব্যবসায়ী, এবং অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত মানুষজন তত বেশি নানারকম হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের নিগ্রহের শিকার
    হয়ে চলেছেন। সুপ্রিম কোর্ট একটি রায়ে জানিয়েছে যে, নানা রাজ্যে বিভিন্ন কারণে আসা কাশ্মীরের মানুষদের নিরাপত্তা দিতে হবে । সুপ্রিম কোর্ট বললেও মধ্য কলকাতা নিবাসী ডঃ আবদুল সফি ( নাম পরিবর্তিত ) বা তার পরিবারের সমস্ত কিছু কি আবার আগের মতো হয়ে যাবে ? না, তাঁর সন্তানদের সঙ্গে আবার আগের মতো মিশবে তাদের বন্ধুরা ? ব্যক্তিগত ভাবে যেহেতু এই লেখক ডঃ সফির বাড়িতে গিয়েছিলেন, তাই এই কথাগুলো বলা।

    প্রশাসন কি ব্যক্তিগত সমস্যা বা এই ধরনের ছোট ছোট অনুভুতিগুলোকে বুঝতে পারে,বা বোঝার চেষ্টা করে ? যদি পারত, তাহলে আদালত নিশ্চিতভাবে মেঘালয়ের রাজ্যপালকে বলতেন যে, তাঁর এই বক্তব্যে আরও হিংসা ও বিদ্বেষ বাড়বে। আসলে জাতীয়তাবোধ এমন একটা জিগির, যা দিয়ে সবাইকে সবকিছু ভুলিয়ে দেওয়া সম্ভব । আদালত কি সেই বিষয়ে কোনো নির্দেশ দিয়েছে ?

    যখন চারিদিকে জঙ্গী দমনের নামে ‘দেশদ্রোহী’ খোঁজার চেষ্টা চলছে, তখন আদালত চুপ কেন ? যদিও প্রধান বিচারপতি কোথাও কোন সংখ‍্যালঘু মানুষ  সামাজিক বয়কট বা হুমকির মুখে পড়লে দ্রুত এবং তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন । কিন্তু তবুও কি চিন্তাটা চলে যায় একেবারে ? বারেবারে ডঃ সফিকে নিয়ে নানা খবর রটছে যে, ‘উনি কলকাতা থেকে চলে যাচ্ছেন। উনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন।’ এটাও ভয় পাওয়ানোর একটা পদ্ধতি। যে মানুষটি আক্রান্ত, তাঁকেই আরো ভয় পাইয়ে দাও। যাতে সেই মানুষটি একদিন মাথা নীচু করে চলে যায়।

    পুলওয়ামা কাণ্ডের পরবর্তী ঘটনায় সরকার নিস্পৃহ থেকেছে, যেন কোথাও কিছুই হয়নি! আসলে ঘুরিয়ে সরকার এই উগ্র জাতীয়তাবাদী বোধকেই প্রশ্রয় দিয়েছে। যার মধ‍্যে দিয়ে যে বা যারা এই জঙ্গীহানাকে নিয়ে একটুও কোনো প্রশ্ন তুলেছে তাঁদেরকেই আক্রমণ করা হয়েছে। কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। তাঁদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে, ‘দেশপ্রেম’ মানেই ‘জাতীয়তাবোধ’। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরাও বারবার বলে গেছেন, কোথাও কিছু হয়নি। কিন্তু তাঁদের কথা যে ঠিক নয়, তা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা এইরকম অত‍্যাচারের খবর থেকেই বোঝা যায়। কতিপয় জঙ্গীর জন‍্য পুরো একটা ধর্মীয় সম্প্রদায়কে দায়ী করতে পারলেই যেন সব সমস‍্যার সমাধান হয়ে যাবে। আসলে ভারতরাষ্ট্র কোথাও হয়তো এই হারটা মেনে নিতে পারছেনা যে, ‘ মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও কি করে এতো বড় হামলা হলো ?’ এই হেরে যাওয়া মানুষগুলোর মধ‍্যে কোথাও যেনো একটা জাতীয়তাবোধ কাজ করছে। যে জাতীয়তাবোধের মধ‍্য দিয়ে আমাদের চাকরি না পাওয়ার দুঃখ, কৃষক আত্মহত‍্যার দুঃখ, শ্রমিকদের কাজ চলে যাওয়ার কথা ভুলিয়ে দেওয়া যায়। শান্তি এবং কল‍্যাণের কথা বলা এখন দ্বেষ এবং প্রতিহিংসাকে চাগাড় দেওয়ার নামান্তর। ফলে এখন বহু ক্ষেত্রেই হিংসা ন‍্যায়বিচারের জায়গা নিচ্ছে।  জাতীয়তাবোধ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ  বহুদিন আগেই লিখে গেছেন –

    “আমি যাহা করিব সকলকেই তাহা করিতেই হইবে, আমি যাহা বলিব সকলকেই তাহা বলিতেই হইবে। এইরূপ বলপ্রয়োগে দেশের সমস্ত মত, ইচ্ছা ও আচরণ-বৈচিত্র্যের অপঘাত মৃত্যুর দ্বারা পঞ্চত্ব লাভকেই আমরা জাতীয় ঐক্য বলিয়া স্থির করিয়া বসিয়াছি। মতান্তরকে আমরা সমাজে পীড়ন করিতেছি, কাগজে অতি কুৎসিতভাবে লিখিতেছি, এমনকি, শারীরিক আঘাতের দ্বারাও বিরুদ্ধ মতকে শাসন করিব বলিয়া ভয় দেখাইতেছি..”(পথ ও পাথেয়)।
    ১৯০৮ সালে লেখা এই প্রবন্ধ ১১১ বছর পরেও
    এদেশে এখনও কী ভয়ংকর প্রাসঙ্গিক!

    আমাদের দেশের মানুষ এগোচ্ছে , রোজ এগোচ্ছে। তারা  ডিজিটাল হচ্ছে , স্মার্ট থেকে আরো স্মার্ট হচ্ছে । দামীদামী ফোন ব‍্যবহার করছে। দামীদামী মলে সময় কাটাচ্ছে । পোষাকে আধুনিক হচ্ছে, কিন্তু মননে ক্রমশ পিছোচ্ছে।  মানুষ থেকে সংখ‍্যাতে পরিণত হচ্ছে, আধারের মধ‍্যে দিয়ে। তাই প্রশ্ন করতে ভুলে যাচ্ছে সাধারণ কিছু কথা। ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ‍্যালয়ের মনস্তত্ব বিভাগের অধিকর্তার ভাষায়, প্রত‍্যেকটি দেশ তার কোনো একটি বিপর্যয়কে বেছে নেয়। যাকে বলা যায় “চোজেনট্রমা”। সেই দেশের প্রজন্মের পর প্রজন্ম সেই বিপর্যয়কে জাতিগতভাবে একাত্ম করে নেয়। সেখান থেকেই হয়তো তৈরী হয় প্রতিশোধ চেতনা।  ভারতের ক্ষেত্রে তা হয়তো দেশভাগ। সেখান থেকেই  অবচেতনে তৈরী হয় জাতীয়তাবোধ।

    “পিছনের দিকে এগিয়ে চলুন ” এই মানসিকতা নিয়েই কি ভারত এগোবে? না ভালবাসা , সৌহার্দ্র বা ভালবাসার  সহমন নিয়ে ভারত এগোবে, সেটা সময় বলবে। কিন্তু তাঁর জন্য দরকার ভালবাসা। মুসলমানকে পর বানানোর যে প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে আমাদের দেশ চলছে টা সত্যিই আজ প্রশ্নের মুখে।।

    (লেখক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট বাস্তুকার,
    লেখকের মতামত নিজস্ব )