পেগাসাস: বাহরিনের ৯ জন উচ্চপদস্থ কর্তা-ব্যক্তির আইফোন হ্যাক করতে ইজরায়েলি এনএসও গ্রুপের তৈরি পেগাসাস স্পাইওয়্যার ব্যবহার করা হয়েছে

নতুন গতি ওয়েব ডেস্ক: মঙ্গলবার সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ক রিপোর্টে উঠে এসেছে, পেগাসাস স্পাইওয়্যার নিয়ে চাঞ্চল্যকর এক তথ্য। পেগাসাসের আঁচে এখন সরগরম বিশ্ব-রাজনীতি। তার মধ্যেই এই রিপোর্ট যে নতুন করে আগুনে ঘি ঢালবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কী বলা হয়েছে সেই রিপোর্টে? রিপোর্টে বলা হয়েছে বাহরিনের ৯ জন উচ্চপদস্থ কর্তা-ব্যক্তির আইফোন হ্যাক করা হয়েছিল। এবং তাঁদের আইফোন হ্যাক করতে ইজরায়েলি এনএসও গ্রুপের তৈরি পেগাসাস স্পাইওয়্যার ব্যবহার করা হয়েছে।

    জুন, ২০২০ থেকে ফেব্রুয়ারি, ২০২১ সময়কালের মধ্যে তাঁদের আইফোনগুলি হ্যাক করা হয়েছিল বলে রিপোর্টে দাবি, করা হয়েছে। যে নয়জন উচ্চপদস্থ আধিকারিকের আইফোন হ্যাক করা হয়েছিল তাঁদের মধ্যে রয়েছেন বাহরিনের সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটসের এক সদস্য, বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা এবং একাধিক সরকারি আধিকারিকও রয়েছেন এই তালিকায়। রিপোর্টে উঠে এসেছে আরও এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। উচ্চ নিরাপত্তা বলয়ে থাকা একসঙ্গে চারজন সরকারি আধিকারিকের ফোনও এই ম্যালওয়্যারের স্বীকার। সিটিজেন ল্যাব জানিয়েছে, এই কাজ সম্পূর্ণ ভাবেই সেদেশের সরকারের নির্দেশেই হয়েছে।

    যেসমস্ত কর্তা-ব্যক্তির আইফোন হ্যাক করা হয়েছিল তাঁদের মধ্যেই একজন মোসা মহম্মদ। তাঁর কথায়, ২০১২ সালের মাঝামাঝি সময়ে তিনি নিজেও এই স্পাইওয়্যারের হানায় পড়েছিলেন। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “যখন আমি বাহরিনে নির্যাতন ও নিপীড়ন থেকে পালিয়ে এসেছিলাম, তখন আমি ভেবেছিলাম আমি লন্ডনে নিরাপত্তা পাব। কিন্তু বাহরিনের সরকারের হাত থেকে নিস্তার পাইনি”। “তারা আমাকে না পেয়ে আমার ফোন হ্যাক করেছিল এবং আমার চলাফেরা, গতিবিধির ওপর সরকারের সতর্ক নজর ছিল”। তিনি আরও বলেন, “বাহরিনের সরকারের দীর্ঘ দমননীতির এক ইতিহাস রয়েছে। সেদেশে সরকারের বিরুদ্ধে কোনও কথা বলা মানেই সরকারের রোষানলের মুখে পড়া।”

    এদিকে এই রিপোর্টে জবাবে এনএসও গ্রুপ এক বিবৃতিতে বলেছে রিপোর্টটি তারা এখনও হাতে পায়নি। একইসঙ্গে সিটিজেন ল্যাবের কাজের ধরণ এবং উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে ইজরায়েলি এই সংস্থা। যদিও সংস্থা দাবী করেছে এই পেগাসাসের অপব্যবহার যদি সত্যি হয় তাহলে তার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করবেন তারা।

    সিটিজেন ল্যাব তাদের গবেষণায় লক্ষ করেছে, অনেক ক্ষেত্রেই এই স্পাইওয়্যারকে উদ্দেশ্যবিহীন ভাবেই কেবল সন্দেহের বশে কোনও কোনও ব্যক্তির ফোন হ্যাকিং-য়ের কাজে ব্যবহার করা হয়েছিল। যা অনেকটা শূন্যে গুলি ছোঁড়ার শামিল। সিটিজেন ল্যাবের পক্ষ থেকে বিল মার্কজাক বলেন, “ আইফোনের অপারেটিং সিস্টেমের সাম্প্রতিক সংস্করণও এই স্পাইওয়্যারকে কোনভাবেই আটকাতে পারেনি। পেগাসাস্ স্পাইওয়্যারকে ফোনে প্রবেশ করাতে কোনও বাধা পেতে হয়নি”।

    যদিও এব্যাপারে অ্যাপল সিকিউরিটি ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড আর্কিটেকচার বিভাগের প্রধান ইভান ক্রস্টিক বলেন, “এই স্পাইওয়্যার অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং এর মেয়াদ ফোনে খুব বেশিদিন নয়”। তিনি এক বিবৃতিতে বলেন, “অ্যাপল আইফোন ব্যবহারকারীর সিংহভাগই এখনও সুরক্ষিত রয়েছে। আমরা প্রতিনিয়ত ডিভাইস এবং ডেটার জন্য নতুন সুরক্ষার দিকে সতর্ক নজর রেখে চলেছি”।

    তিনি বলেন, “নতুন এই প্রতিবেদনটি এনএসও গ্রুপের জন্য সর্বশেষ অপ্রীতিকর খবর, মুলত এই স্পাইওয়্যার মানবাধিকার কর্মী,গুরুত্বপূর্ণ সরকারি আধিকারিক, রাজনৈতিক ব্যক্তি-সহ ভিআইপিদের ফোনে বিশেষ উদ্দেশ্যে প্রবেশ করানো হয়েছিল”।

    প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃক ফাঁস হওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ইজরায়েলি এনএসও গ্রুপকে ব্যাপক সমালোচনা এবং নিন্দার মুখে পড়তে হয়। পেগাসাস ইস্যুতে সরগরম হয়ে উঠেছিল ভারত-সহ বিভিন্ন দেশের রাজনীতি। গত মাসেই হাঙ্গেরির রাজধানীতে পেগাসাস ইস্যুতে হাজার হাজার মানুষ সেদেশের ডানপন্থী সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিদ্রোহ দেখায় এবং পেগাসাস নিয়ে সরকারের কাছে জবাবদিহি দাবি করে।

    ভারতেও পেগাসাস নিয়ে ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয় নরেন্দ্র মোদীর সরকারকে। লোকসভায় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি পেগাসাস ইস্যুতে মোদী সরকারকে একহাত নেয়। বিষয়টি দেশের সর্বচ্চ আদালতের নজরে আনা হয়। সুপ্রিম কোর্টও সাধারণের মৌলিক অধিকার এবং ব্যক্তি স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখার প্রশ্নে সরকারি হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করে এবং পেগাসাস নিয়ে সরকারের কাছে জবাবদিহি চায়।

    ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ এবং তাঁর সরকারের সদস্যরা ২০১৯ সালে এই স্পাইওয়্যারের শিকার হয়েছেন বলে দাবি করেন। অভিযোগের তির মরক্কোর দিকে। যদিও ফ্রান্সের প্রধান মিত্র মরক্কো সেইসব রিপোর্ট অস্বীকার করেছে এবং স্পাইওয়্যার কেলেঙ্কারিতে উত্তর আফ্রিকার দেশকে জড়িত করার অভিযোগের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ে নেমে পড়েছে।

    এদিকে ফেসবুক তার ইউজারদের নিরাপত্তার প্রশ্নে ইতিমধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল আদালতে এনএসও গ্রুপের বিরুদ্ধে একটি মামলাও করছে। অভিযোগ, Whatsapp-এর প্রায় ১৪০০ ইউজারকে টার্গেট করা হয়েছিল এই স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে। ফেসবুকের তরফে এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, “১৪০০ Whatsapp ইউজারের মধ্যে বেশ কয়েকজন বাহরিনের ইউজারও রয়েছেন এই তালিকায়”।

    রাষ্ট্রসংঘের সঙ্গে যুক্ত মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা সম্প্রতি দেশগুলিকে স্পাইওয়্যার এবং অন্যান্য নজরদারি প্রযুক্তির বিক্রয় এবং হস্তান্তর বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন। মানবাধিকার যাতে কোনও ভাবেই লঙ্ঘিত না হয় সেব্যাপারেও বিভিন্ন দেশেরর তরফে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।