রাঢ় বাংলার মকর ও টুসু পরব

কেশপুর: দক্ষিন পশ্চিম সীমান্ত ও রাঢ় বাংলার এক অন্যতম বৃহৎ উৎসব, এর মাহাত্য দুর্গাপুজাকেও হার মানায় ।

    প্রাচীন মকর সংক্রান্তি পালন করা হয় রাঢ় বাংলার পৌস মাসের সংক্রান্তির দুদিন আগে থেকে চাষি পরিবারে নতুন ধানের চাল থেকে পিঠে তৈরির আনন্দ পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায়। ঝাড়গ্রাম, বেলপাহাড়ি, গোপীবল্লভপুর, কেশিয়াড়ি, ডেবরা, মাদপুর, জামবনি, নয়াগ্রাম, বিনপুর প্র্ভিতি ব্লকের গ্রাম গুলোতে চোখে পড়ার মতো । পশ্চিমবঙ্গের মালভূমি অঞ্চলের নদীতীরবর্তী অঞ্চল গুলোতে প্রধান ফসল হিসেবে ধান অধিক উৎপাদন হয়। অগ্রহায়ন-পৌষ মাষে আমন ধান চাষে সারাবছর ধরে যুক্ত থাকায় নতুন ফসল ঘরে তোলা থেকে শুরু হয় নবান্ন‌ উৎসব। আর এই উৎসবের পরই পৌষ সংক্রান্তির দিন পালিত হয় ‘মকর পরব’। এই পরবের মূল আকর্ষণ হলো চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি নানান পিঠে ও পুলি। চালের গুড়ি তৈরি হয় নানা ভাবে ঢেঁকি কোটা গুড়ি, মেশিনে কোটা গুড়ি ও বর্তমানে বাজারে চালের গুঁড়ো কিনতে পাওয়া যায়। “মকর কুড়িয়া” বা “মকর কুমা” তৈরি করে সংক্রান্তির দিনে ভোরে ঐ ‘কুমা” জালান হয়। কুমা তৈরি হয তাল পাতা, খেজুরপাতা, বাবলাগাছ, শালগাছের ডাল সহ পাতা ও খড় দিয়ে হতো “মকর কুড়িয়া”। সব কুড়িয়া পোড়ানো শেষ হতে হতে সূর্য উঠে যেত। সেখান থেকে স্নান করে বাড়ি ফিরে নতুন জামাকাপড় পরার রীতি রয়েছে । ঐ দিন “মকর” খাওয়া রীতি ও আছে চালের বাটা, আখের কুচি, নানা ফলের কুচি, দুধ, গুড় দিযে তৈরি মাখা যকে বলে “মকর” ওটা খাওয়ার পর নারকেল পুরের পিঠা খাওয়া। তারপর দুপুরে খাসীমাংস / হাসমংস চালের রুটি খাওযা হতো। স্থান বিশেষে নানান ধরনের পিঠে হয় চালগুঁড়োর সঙ্গে নানা রকমারি পিঠে। যেমন- দুধ পুলি, জ্লে ভাপা পুর পিঠা, ছাঁকা পিঠা, ফুলুরি, গোকুল পিঠা, আসকা পিঠা, খোলাজালি পিঠা, হাঁড়িমোহা পিঠা, চিতো পিঠা, ক্ষীরকুলি পিঠা, সুজি পিঠা, চালের রুটি, পাটিসাপটা, বিরির তৈরি কড়া পিঠা, বিড়ির বড়া, বিরির সরু চকলি, বিরির তেলে ছাঁকা পিঠে ইত্যাদি। শীতকালে তৈরি হ‌ওয়ায় পিঠে থেকে যেত চার-পাঁচ দিন বাড়ির লোকজন ঐ কদিন ভাত খেত না, পিঠে খেয়ে থাকে। ঐ দিন বিকেলে মকর মেলা হয়। পিঠের জন্য ঢেঁকির সাহায্যে গুঁড়ি তৈরী করার কাজে মা ঠাকুমার ব্যস্ত থাকতেন মাস খানেক ধরে। ।এই সময় আবার অনেক জায়গায় “মোরগ লড়াই” এর আসর বসে। আদিবাসী, বৈগা, ভূমিজ ও মাহাতো সম্প্রদায়ের মানুষরা মেতে ওঠেন তুসু গনে। টুসু গান গাইতে গাইতে বাড়ী ঘোরেন চাল, পিঠা ও পয়সা চাইতে। কোন সম্প্রদায় আদিবাসী গান গাইতে গাইতে নাচ করেন চাল ও পয়সা চাইতে। রাঢ় অঞ্চলের আদিম জনজাতি মানুষদের পিঠে তৈরি করার সামর্থ থাকত না, তারা চাষি বাড়ী থেকে পিঠে চেয়ে খেতো।

    আগেকার দিনে পিঠে তৈরির জন্য ব্যবহার করা হতো মাটির তৈরি পাত্র। মকর পরবের ঠিক আগে গ্রামীণ হাট থেকে কেনা হতো মাটির তৈরি পাত্র। বর্তমানে শহর বা শহরতলীতে পিঠে তৈরি খুব কম হলেও নজরে পড়ে । মকর সংক্রান্তির এই বিশেষ দিনে পিঠে তৈরি বা খাওয়ার রীতি শহর ও গ্রামে আজ ও টিকে আছে। প্রতি বছর ৩১ ডিসেম্বর মেদিনীপুর শহরে পিঠে মেলা ও প্রতিযগিতা হয়। বিগত 2 বছর ধরে করোনার জন্য বন্ধ আছে। অনেক মকর মেলা ও বন্ধ আছে। বিভিন্ন জায়গাতে পৌস সংক্রান্তির দিনে মাটির হাতি ঘোড়া কে পুজো করা হয় ছাগল ও মুরগি বলি হয় । অনেকে মানত রাখেন এই বলির জন্য, এই ঠাকুর বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন নামে পরিচিত গ্রামদেবি, কুন্দ্রীবুড়ি, কলাইচন্ডী, নাকুর্সিনি, বনদেবী, শীতলাবুড়ি । গৃহস্থ বাড়ির মায়েরা “মকর” তৈরি করে মাটির হাতি ও ঘোড়া নিয়ে লাইন দিয়ে পুজো দেন।

    লেখক : শান্তুনু পাণ্ডা, গবেষক ও ফ্যাকাল্টি কেশপুর কলেজ: