প্রয়াত হলেন তমলুকের বিয়াল্লিশের বিপ্লবী সূর্য কুমার q

নিজস্ব সংবাদদাতা ,তমলুক : বয়স হয়েছিল ৯৪ । জীর্ন শরীর নিয়ে একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিলেন । বার্ধক্যজনিত রোগ ও কিডনির সমস্যায় দীর্ঘদিন ভোগার পর শহীদ মাতঙ্গিনী ব্লকের বল্লুক গ্রামের ‘বিয়াল্লিশের বিপ্লবী’ সূর্য কুমার আদক আজ সকাল ৭টা নাগাদ পরলোক গমন করলেন ।

    বিপ্লবী সূর্যবাবু মাত্র ১৬ -১৭বছর বয়সে স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন । সালটা ছিল ১৯৪২ । গান্ধীজী ডাক দিলেন ব্রিটিশ ভারত ছাড়ো ।সমগ্র ভারত ব্যপী শুরু হয় আন্দোলন ।তমলুকে অজয় মুখোপাধ্যায় ও সতীশচন্দ্র সামন্তের নেতৃত্বে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ২৯ সেপ্টেম্বর থানা,আদালত, সরকারি দপ্তর আক্রমণ করে দখল নেওয়া হবে ।পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী ২৯শে সেপ্টেম্বর বিকাল ৩টার সময় বিপ্লবী জনতা তমলুক থানার দেওয়ানী আদালত দখলের জন্য শহরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে ।বিপ্লবীদের মুখে ধ্বনি ওঠে বন্দেমাতরম্ ‘ইংরেজ ভারত ছাড়ো’ , গান্ধীজী কি জয় ইত্যাদি।তমলুক শহরের উত্তরে রূপনারায়ণ নদীর বাঁধ ধরে খারুই , বল্লুক , নুননান, আলিনান, জামিত্যা , সোয়াদীঘি, বিশ্বাস, মথুরী, শিউরী প্রভূতি অঞ্চলের নারী-পুরুষ, ছাত্র-যুব, হিন্দু-মুসলিম সবাই অংশ নেয় ।পায়রাটুঙ্গি খালের ওপারের ডাক বাংলোর সামনে কংগ্রেস নেতা প্রফুল্ল কুমার বসু জনগনকে উজ্জীবিত করতে জ্বালামুখী ভাষন দেন ।এর পর মিছিল অগ্রসর হয় ।বানপুকুর পাড়ে সংকীর্ণ রাস্তায় উপর মিলিটারি পুলিশ বাহিনী পথ আটকে দেয় । বাধা উপেক্ষা করে আন্দোলনকারীরা এগিয়ে এলে ব্রিটিশ পুলিশ বন্দুক উঠিয়ে তাড়া করে ।মিছিলের সামনের কিছু লোক কিছুটা পিছু হটতে বাধ্য হলেও সেদিন হার না মানা মনোভাবের মানুষ এগিয়ে আসে । সবার সামনে ছিলেন মথুরী গ্রামের ১৩ বছরের বিপ্লবী লক্ষীনারায়ন দাস ।তিনি পুলিশের রাইফেল ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে ব্রিটিশ পুলিশ তাকে রাইফেলের পেছন দিয়ে থেতলে হত্যা করে । এরপরই আলিনান গ্রামের ৭৩ বছরের বীরাঙ্গণা মাতঙ্গিনী হাজরার নেতৃত্বে মিছিল এগিয়ে এলে কোন রকম সতর্কবার্তা ছাড়াই ব্রিটিশ পুলিশ গুলি চালায় ।পরপর তিনটি গুলি খাওয়ার পর মাতঙ্গিনী মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ।শহরের উত্তর, দক্ষিণ, পশ্চিম দিক থেকে আসা মিছিলের উপর গুলি চলেছিল নির্মমভাবে ।মাতঙ্গিনী সহ ১০ জন বিপ্লবী সেদিন শহীদ হয়েছিলেন ।গুলি ও লাঠির আঘাতে আহত হয়েছিল অগণিত মানুষ ।যাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বল্লুক গ্রামের ১৭ বছরের যুবক সূর্য কুমার আদক । সেদিন তিনি মাতঙ্গিনী হাজরার নেতৃত্বে মিছিল অভিযানে যোগ দিয়েছিলেন ।পুলিশ গুলি চালালে গুলি লাগে তাঁর ডান পায়ের হাঁটুর বেশ কিছুটা উপরে। তখনও মনোবল ধরে চলছে বন্দেমাতরম্ ধ্বনি দেওয়ার কাজ ।অনেক রক্ত ক্ষরন হলে তমলুকের বানপুকুর পাড়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন ।রক্তাক্ত হয়ে যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে একসময় জ্ঞান হারিয়েছিলেন। এরপরই সূর্যবাবুকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তমলুক রামকৃষ্ণ মিশন পরিচালিত হাসপাতালে ।দীর্ঘ যন্ত্রণা ভোগার পর সুস্থ হলেও মুক্তি পায়নি ।এরপর বৈপ্লবিক কাজের জন্য ব্রিটিশ পুলিশ গ্রেফতার করার নির্দেশ দিলে কিছুদিন আত্মগোপন করেন ।অবশেষে ধরা পড়েন ব্রিটিশ পুলিশের হাতে ।মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলে ৬ মাসের জন্য করাবাস হয় ।

    জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি হোমিওপ্যাথি প্যাকটিস শুরু ক‍রেন । তমলুক শহরের শংকরআড়াতে দীর্ঘদিন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার চেম্বার চালিয়েছেন ।এরপর বয়স বাড়লে ক্যাকটিয়া বাজারে চেম্বার করেন ।এলাকার মানুষের কাছে তিনি বিপ্লবী ডাক্তার নামেও পরিচিত ছিলেন ।দীর্ঘদিন কয়েক মাস তিনি কিডনির সমস্যায় ভুগছিলেন । বেশ কয়েকবার কখনো নার্সিং হোম কখনো হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন । অবশেষে ক্যাকটিয়ার বল্লুক গ্রামে নিজ বাসভবনে শুক্রবার সকালে পরলোক গমন করেন । এই ঘটনা জানার পর পরিবহন ও পরিবেশ মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী শ্রদ্ধা জানিয়ে শোক বার্তা পাঠান সংশ্লিষ্ট এলাকার জেলা পরিষদ সদস্যা মামনি জানার মারফত । দাহ কার্য সম্পন্ন হয় নিজ বাসভবনের নিকট ।এই সময় উপস্থিত ছিলেন সংশ্লিষ্ট এলাকার জেলা পরিষদ সদস্যা মামনি জানা , রূপক কর , অপূর্ব জানা সহ শহীদ মাতঙ্গিনী গ্রাম পঞ্চায়েত সমিতির অন্যান্য সদস্যবৃন্দ ।এ ঘটনায় এলাকার পাশাপাশি বিদ্যালয় সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান শ্রদ্ধা জানায় ।