|
---|
নিজস্ব সংবাদদাতা:একজন ঝাপসা দেখেন। আর একজন কিছুই দেখেন না। দুজনেই ধূপকাঠির ব্যবসায়ী। ধূপকাঠির মাথায় যে ক্ষীণ আলো জ্বলে, অনেকটা সেরকম আলো চোখে নিয়ে ঝাপসা লোক পথ দেখান দৃষ্টিহীনকে।
দুজনেই বন্ধু। চোখে আলো নেই, তবু আলোর পথযাত্রী। যিনি ঝাপসা দেখেন তাঁর নাম অভয় মাহিলি। দৃষ্টিহীনের নাম মিন্টু রায়। দুজনে পাশাপাশি চলেন। কখনও ঝাপসার ভরসায় আঁধার। কখনও আঁধারের ভরসায় ঝাপসা। রোদ-বৃষ্টি-জলে একে অন্যের আঙুল ছুঁয়ে থাকেন। চোখে দেখেন না তো কী, মনের ভিতর যে কথার আঁকিবুকি চলে তা ঠিক ঠাহর করতে পারেন দুজনেই। ৯ বছরের বন্ধুত্ব। মান-অভিমান যে হয়নি তা নয়। কিন্তু ওই ছুঁয়ে থাকা আঙুল ছাড়াছাড়ি হয়নি। ছোটবেলায় টাইফয়েডের কারণে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন বছর বত্রিশের মিন্টু। নিজের জীবনকে যখন বোঝা মনে হচ্ছে, তখনই বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেন অভয়, যিনি শুধু ঝাপসা রাস্তা দেখতে পান, ঝাপসা দেখেন আকাশ-নদী। শুরু হয় বন্ধুর হাত ধরে ধূপকাঠি বিক্রি। রোজ তাঁরা কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ির বিভিন্ন বাজারে ছুটে যান ধূপকাঠি বিক্রি করতে। তাঁদের এই বন্ধুত্বের কাহিনী গল্পকেও হার মানায়।
কোচবিহারের পেস্টারঝাড় এলাকার বাসিন্দা মিন্টু। কিশোর বয়সেই শিলিগুড়ির একটি ব্লাইন্ড স্কুলে পড়ার সময় পরিচয় হয় বানারহাট ব্লকের গ্যান্দ্রাপাড়া চা বাগান এলাকার বাসিন্দা অভয়ের সঙ্গে। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর মিন্টু রায়ের জীবনে হতাশা নেমে এসেছিল। ঠিক সেই সময় হাত বাড়িয়ে দেন অভয়। তিনি বলেন, আমি তো তবু ঝাপসা দেখতে পাই। ওতেই হবে। ওই দিয়ে শুরু হবে ধূপকাঠির ব্যবসা। কারও কাছে হাত তো পাততে হবে না। শুরু হল ধূপকাঠি বিক্রি। এখন তাঁরা বিভিন্ন বাজারে, দোকানে দোকানে ধূপকাঠি বিক্রি করেন। আয় মন্দ নয়। মিন্টু বিয়ে করেছেন বছর কয়েক আগে। একটি সন্তানও আছে। এখন তিনি অভয়ে বিয়ে কথা ভাবছেন।
মিন্টু বলেন, বন্ধু অভয় না থাকলে হয়তো আমি হারিয়ে যেতাম। বাজারে বাজারে ঘুরে ধূপকাঠি বিক্রি করতে পারতাম না। আর অভয়ের কথায়, সবকিছু পরিষ্কার দেখতে না পেলেও আমি ঝাপসা আলোয় রাস্তা চিনতে পারি। এভাবেই দুজন দুজনের হাত ধরে বাজারে বাজারে ছুটে যাই ধূপকাঠি বিক্রি করতে। দুজনে ঠুকঠুক করে হাঁটছেন। আঙুল ছুঁয়ে আছেন একে অন্যের। আঙুলের মাথায় ধূপের আলোর মতো টিমটিম করছে ভালোবাসা। ঝড়-বৃষ্টি হয় বটে, কিন্তু আলো নেভে না।