|
---|
খায়রুল আনাম :
বাংলা সাহিত্য জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র নুরুল আমিন বিশ্বাস (৫ অগাস্ট ১৯৫৬ – ৩০ জুন ২০২১) চলে গেলেন। উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা, সম্পাদনা সাহিত্যের প্রায় সব কাননেই ছিল তাঁর অবাধ পদচারণা। নুরুল আমিন বিশ্বাস ছিলেন চেতনা সাহিত্যের অনন্য প্রতিভার সৃজন প্রেমী মানুষ। সেই কারণে তাঁর সৃষ্টির ভাণ্ডার বিশাল। জীবনের শেষ অধ্যায়ে তিনি আর্থিক সঙ্কটের মুখে পড়েছিলেন। নতুন গতির সম্পাদক এমদাদুল হক নূর তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁর সঙ্গে শেষ দেখা কলকাতার শেষ বইমেলার শেষ দিনে।
কবি নুরুল আমিন বিশ্বাস সৃজন প্রতিভার পরিচয় রেখে গেলেন তাঁর ডজন খানেক কাব্যগ্রন্থে। যেমন, হৃদয় খোঁজে মাটি, মরুতৃষা, পরবাসে যাবে কৃষ্ণচূড়া, আদম ঈভ পদাবলি, আগুনের তৃষ্ণা, জলপোকা, নিষিদ্ধ কবিতার হাড়মাস, ঈশ্বর হস্তান্তর বিষয়ক, ঋতুবদলের ধারা ভাষ্য, সন্ধের সনেট, কলাবৌ ধানকাব্য, কবিতা সমগ্র ইত্যাদি। নুরুল আমিনের উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ গ্রন্থ নজরুল সাহিত্যের দিগবলয়, মুর্শিদাবাদের মুসলিম জনমানস, বিশ্ব পরিবেশ ভাবনা, অন্ত্যজবর্গীয় উপাখ্যান, মুর্শিদাবাদের বন্যা বন্যা ভাঙনের রূপরেখা। তাঁর জনপ্রিয় উপন্যাস হল, অসময়ের যাপননামা, দিন বদলের গান। সাহিত্যে সমাদৃত গল্পগ্রন্থ কৃষ্ণ গহ্বর রহস্য। তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা হল শাব্দিক, অন্য শাব্দিক। লিটল ম্যাগ অন্য শাব্দিক সম্পাদনার জন্য তিনি নতুন গতি পুরস্কার (১৯৯৬) পেয়েছিলেন । সম্পাদনা করেছেন একশো কবির কবিতা’র মতো কাব্যগ্রন্থ। এছাড়াও সমাজ সংস্কারক মোস্তাক হোসেনের ধর্মসংস্কৃতি ও মানবতাবাদ, বাংলার মুসলিম স্থাপত্য, মুর্শিদাবাদের পুরাকীর্তি, মুর্শিদাবাদের লোকসংস্কৃতি ও লোকসাহিত্য এর মতো বিষয়গুলোকে যন্ত্রস্থ করে তুলে ধরেছেন। নুরুল আমিন সুবক্তা ছিলেন, বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর জ্ঞানের গভীরতা প্রতীয়মান হয়ে উঠত। মুর্শিদাবাদের মানুষ নুরুল আমিন আপন প্রতিভার ঐশ্বর্যে কলকাতা তথা বাংলার সাহিত্য জগতে স্বনামধন্য হয়ে উঠেছিলেন।
প্রাবন্ধিক নুরুল আমিন বিশ্বাসের বহু গবেষণামূলক প্রবন্ধ রয়েছে । মুর্শিদাবাদের বহু তথ্য তিনি সাহিত্যের আলোয় তুলে এনেছেন। নবাব কাহিনি থেকে লুপ্ত লোকসংস্কৃতির ইতিহাস সাহিত্যের সম্পদ হিসাবে রয়ে গেল। কলকাতায় থাকলেও তাঁর সৃষ্টি, তাঁর হৃদয় খুঁজেছে মুর্শিদাবাদের মাটি। একদা বাংলা বিহার উড়িষ্যার রাজধানী মুর্শিদাবাদের মানুষের জীবন যন্ত্রণার ছবি উঠে এসেছে তাঁর সাহিত্যের ক্যানভাসে। নুরুল আমিন বিশ্বাসকে আগামী দিনের পাঠক কি হিসাবে মনে রাখবে বলবে ভবিষ্যৎ। হয়তো বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী মানুষটিকে কবিতা প্রেমী পাঠক কবি হিসাবে, প্রবন্ধ পড়তে চাওয়া পাঠক প্রাবন্ধিক হিসাবে মনে রাখবেন। কিন্তু আগামী দিনের বাংলা সাহিত্য ও সাহিত্যের ইতিহাস তাঁর সমস্ত সৃষ্টির ওপরই বিচার করবে। নুরুল আমিন তাঁর প্রায় পাঁচ দশকের সারস্বত সাধনায় যে সাহিত্য সম্পদ রেখে গেলেন তা জাতির জন্য গৌরবজনক।
প্রয়াত নুরুল আমিন বিশ্বাসের ভাষা ও শব্দ চয়নে স্বাতন্ত্রতা ছিল তাঁর সৃষ্টির মৌলিকতা। আর তার পিছনে ছিল একটা ভাবুক হৃদয়ের কবিমন। কাজী নজরুল ইসলাম যেমন নিজের সম্পর্কে বলে গিয়েছিলেন, মানুষ তার কবিতা না মনে রাখলেও মানুষ তার গান মনে রাখবেন। কারণ কালজয়ী বিদ্রোহী কবিতার কবি নজরুলের মনে হয়েছিল তাঁর কবিতা প্রাসঙ্গিকতা হারালেও সংগীতকে তিনি কিছু দিতে পেরেছেন। তাই সংগীতের মধ্যে তিনি বেঁচে থাকবেন। তেমনি নুরুল আমিন বিশ্বাসকে আমরা বেশি করে কবিতার মধ্যে পেয়েছি। নুরুল আমিন বিশ্বাস মূলত একজন কবি। অবশ্য সাহিত্যের নন্দন কাননে তাঁকে বহু রূপে দেখা গেছে। সাহিত্যের অঙ্গনে তাঁর শিল্পী হৃদয় তাঁকে অন্যদের থেকে ভিন্ন ভাবনার কারিগর বানিয়ে ছিল। আপন সৃষ্টি চেতনাই তাঁকে দিয়েছিল মানুষের প্রতি মমত্ববোধ। সেই দায়বদ্ধতা থেকেই এসেছিল আশার ভাষা। সাহিত্যের নব নিকেতনে এই মানুষটিকে আগামী দিনে খুঁজবে বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টি পাগল।
কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি আমরা। জীবনের প্রতি আস্থা ঠক্কর খাচ্ছে প্রতিপদে। মৃত্যু সত্য হয়ে উঠছে প্রতিনিয়ত । স্বজন হারানোর ব্যাথার মধ্যেই স্রষ্টাকে সম্মান জানাই তাঁর সৃষ্টি দিয়েই-
যে সব শোককথা মুক স্তব্ধ সারাদিন
জ্বলে ওঠে মধ্যরাতে –
ত্রস্ত দিনলিপি রুদ্ররোষে ফেটে পড়ে অভিমানে;
—সারাদিন চুপ থাকে শোক, রাতে সে আফিমের খেত;
সম্পর্কের সাঁতারে সব অভিমান হয়ে যায় গজলের মেয়ে!
কথা সাহিত্যিক নুরুল আমিন বিশ্বাসের ‘চেতনা সাহিত্য’ প্রজন্মের নিকট সংগ্রামী জীবনের উপলব্ধি হিসাবে মান্যতা প্রাপ্ত হবে একদিন। তাঁর সাহিত্যকৃতি শুধু আলোচনা সমালোচনা নয় রক্ষার ভার পড়ল সাহিত্য সমাজের কাঁধে। শোকাবহ আবেগের মুহূর্তে সেই দায়িত্বের সংযম ভুলে গেলে চলবে না।