|
---|
নিজস্ব প্রতিনিধি : ১৮ আগস্ট নিউ আলিপুর থানায় একটি গুরুতর অভিযোগ জানান এক তরুণী। বারাণসীর বাসিন্দা প্রিয়া ধুসিয়া জানান, প্রেমের অভিনয় করে তাঁর সঙ্গে আর্থিক প্রতারণা করেছে হেমন্ত কুমার মৌর্য নামের এক যুবক। টাকা ফেরত চাইতে গেলে দিয়েছে হুমকিও।
প্রিয়া উত্তরপ্রদেশের একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের চাকুরে। হেমন্তও আদতে বারাণসীরই বাসিন্দা। কলেজে পড়াকালীনই দু’জনের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ২০১৭ সাল থেকে নিউ আলিপুরের একটি মেসে থাকত হেমন্ত। তখন থেকেই কখনও ব্যবসা, কখনও সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার প্রস্তুতির অজুহাত দিয়ে প্রিয়ার থেকে টাকা চাওয়া শুরু করে সে। প্রেমিককে সাহায্য করতে বেশ কয়েক দফায় প্রায় ৫ লক্ষ টাকা পাঠিয়েছিলেন প্রিয়া। গোটা টাকার লেনদেনই হয়েছিল অনলাইনে।
দু’জনের ঘনিষ্ঠতার কথা জানতে পেরে প্রিয়ার পরিবার দু’জনের বিয়ের তোড়জোড় শুরু করে। কিন্তু, হেমন্ত কিছুতেই নিজের আসল ঠিকানা বা পেশা নিয়ে সঠিক তথ্য দিচ্ছিল না প্রিয়ার পরিবারকে। বাধ্য হয়েই প্রিয়া ঠিক করেন, এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসবেন। গত জুন মাসে, হেমন্তর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে দেন প্রিয়া এবং তাকে দেওয়া সমস্ত টাকা ফেরত চান।
এরপরই স্বমূর্তি ধরে হেমন্ত। শুরু হয় ফোনে হুমকি দেওয়া। হেমন্তর পাশাপাশি রাকেশ পণ্ডিত নামে হেমন্তর এক বন্ধুও ফোনে হুমকি দিচ্ছিল প্রিয়াকে। এরপরই প্রিয়া দ্বারস্থ হন নিউ আলিপুর থানার।
হেমন্ত মৌর্যর কোনও ঠিকানার সন্ধান দিতে পারেননি প্রিয়া। তথ্য বলতে ছিল একটি ফোন নম্বর আর দু’টি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট। সেই দু’টি অ্যাকাউন্টেই টাকা পাঠাতেন প্রিয়া। আর ছিল, রাকেশ পণ্ডিত নামের এক অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির নাম।
এইটুকু সম্বল করেই তদন্ত শুরু হয়। নিউ আলিপুর থানার একটি টিম হেমন্ত ও তার বন্ধুর খোঁজে রওনা দেয় বারাণসী। সেখানে পুছকোশি এলাকায় স্থানীয়দের হেমন্তর ছবি দেখিয়ে তার ঠিকানার সন্ধানও মেলে। কিন্তু সেই ঠিকানায় তখন ছিল না হেমন্ত।
যে দু’টি অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাতেন প্রিয়া, সেগুলির সমস্ত তথ্য খুঁটিয়ে দেখা শুরু হয়। জানা যায়, সেই অ্যাকাউন্ট দু’টির মালিক কৈখালির বাসিন্দা মহঃ আক্রম। তদন্তকারী অফিসারেরা দেখেন, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ই-ওয়ালেট এবং অনলাইন ব্যাঙ্কিং-এর মাধ্যমে ক্রমাগত টাকা ঢুকছে এই দু’টি অ্যাকাউন্টে। অ্যাকাউন্টের নথি থেকে পাওয়া অ্যাকাউন্ট মালিকের ঠিকানায় তল্লাশিও চালান তদন্তকারী অফিসারেরা। কিন্তু সেখানে মহঃ আক্রমের খোঁজ মেলেনি।
ওই অ্যাকাউন্টের সমস্ত লেনদেন বন্ধ করে দেওয়া হয়। পাশাপাশি, তদন্তকারী অফিসারদের পরিকল্পনামাফিক ব্যাঙ্ক ম্যানেজার ফোন করে ব্যাঙ্কে ডাকেন মহঃ আক্রমকে। হঠাৎ করে অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় খোঁজ নিতে ব্যাঙ্কে না এসে উপায়ও ছিল না আক্রমের। ব্যাঙ্কে আসতেই তাকে গ্রেপ্তার করেন তদন্তকারী অফিসারেরা। আক্রমকে জেরা করেই বারাণসীতে হেমন্তর একটি ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্টের সন্ধান মেলে। দেখা যায়, সেখানেও অসংখ্য অনলাইন লেনদেন হয়েছে। এইসব লেনদেনের সঙ্গে যে এই কেসের কোনও একটি যোগসূত্র রয়েছে, তা স্পষ্ট বুঝতে পারছিলেন তদন্তকারী অফিসারেরা।
ইতিমধ্যে জানা যায়, যে মোবাইল নম্বর থেকে প্রিয়াকে হুমকি দেওয়া হত, সেটার মালিক আদতে সুব্রত মিত্র নামের একজন। সুব্রত মিত্রর চারু মার্কেটের ঠিকানায় পৌঁছে দেখা যায়, এই ফ্ল্যাট সে বিক্রি করে দিয়েছে ২০০৯ সালেই।
শুরু হয় প্রযুক্তি প্রহরা। ওই মোবাইলের কল রেকর্ড পরীক্ষা করে সরশুনা-নিবাসী অসীম কুমার ঘোষকে চিহ্নিত করা হয়। টাওয়ার লোকেশন থেকে জানা গেছিল, দিন ১৫ আগে সরশুনায় অসীম কুমার ঘোষের বাড়িতে এক রাতের জন্য গেছিল সুব্রত। নিউ আলিপুর থানা থেকে ব্যাঙ্কে ম্যানেজারের পরিচয়ে অসীম কুমার ঘোষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। অসীম জানান, তিনি সম্পর্কে সুব্রতর মামা। তাঁর থেকেই জানা যায়, সুব্রতর বর্তমান ঠিকানা গিরিডিতে। অসীম মারফত সুব্রতর একটি পুরোনো ফটোগ্রাফও হাতে আসে তদন্তকারী অফিসারদের। দ্রুত গিরিডির উদ্দেশে রওনা দেয় নিউ আলিপুর থানার বিশেষ টিম। ইতিমধ্যে প্রযুক্তি প্রহরার মাধ্যমে জানা গেছে, বিগত ৮ দিন ধরে গিরিডির রাজগরিয়াতেই আছে হেমন্ত ও সুব্রত দু’জনেই।
গিরিডি পৌঁছনোর ২দিন পরে একটি ধর্মশালায় সুব্রতর সন্ধান পান তদন্তকারী অফিসারেরা। যদিও হেমন্তর দেখা মেলেনি। তদন্তকারী অফিসারেরা জানতে পারেন, হেমন্ত একদিনের জন্য বারাণসী গেছে। তখনই সুব্রতকে গ্রেপ্তার করলে সেই খবর পৌঁছে যেতে পারে হেমন্তর কাছেও। সেক্ষেত্রে গা ঢাকা দিতে পারে হেমন্ত। সব দিক বিবেচনা করে, সুব্রতকে তখনই গ্রেপ্তার না করার সিদ্ধান্ত নেন তদন্তকারী অফিসারেরা। কিন্তু, সুব্রত যাতে পালাতে না পারে তা নিশ্চিত করতে ঐ ধর্মশালাতেই ঘর নেয় তদন্তকারী টিমের প্রত্যেকে।
ইতিমধ্যে, খবর পেয়ে হেমন্তকে স্বাগত জানাতে বারাণসীতে অপেক্ষা করছিল নিউ আলিপুর থানার আরেকটি টিম। হেমন্ত বারাণসী পৌঁছতেই গ্রেপ্তার করা হয় তাকে। সেই খবর আসার সঙ্গে সঙ্গেই গিরিডি থেকে গ্রেপ্তার করা হয় সুব্রতকেও।
চমকের তখনও বাকি ছিল অনেকটাই। অনলাইনে এই গোটা লেনদেন প্রক্রিয়া দেখে তদন্তকারী অফিসারদের সন্দেহ হয়েছিল, কোনও একটি আন্তঃরাজ্য অপরাধচক্রের সঙ্গে ধৃতরা সবাই জড়িত। জেরার মুখে ভেঙে পড়ে হেমন্ত ও সুব্রত স্বীকার করে, তারা বেআইনি অনলাইন সাট্টার কারবার চালায়। ‘কলকাতা ফাটাফাট—সাট্টা মাটকা’ নামের একটি গ্রুপও আছে তাদের। ২০১৭-১৮ সাল নাগাদই এই সাট্টার নেশা পেয়ে বসে হেমন্তকে। সাট্টার নেশাতে বুঁদ হয়েই প্রেমিকা প্রিয়ার সঙ্গেও প্রতারণা করেছে সে।
হেমন্ত ও সুব্রতর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই ডায়মন্ড হারবারের কাছে শিরাকোলে একটি অনলাইন লটারি সংস্থার অফিসে তল্লাশি চালায় নিউ আলিপুর থানার বিশেষ টিম। গ্রেপ্তার করা হয় সাট্টা কারবারের ৩ জন এজেন্টকে। বাজেয়াপ্ত হয় ৩০টি মোবাইল, ক্যালকুলেটর, সাট্টা কারবারের বেশ কিছু নথি ও কাগজপত্রও। হুগলি ও পোস্তা-সহ একাধিক জায়গায় তল্লাশি চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে আরও কয়েকজনকে। ৩টি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ইতিমধ্যেই। ঐ অ্যাকাউন্টগুলিতে থাকা মোট ১২ লক্ষ টাকা উদ্ধারের চেষ্টাও চলছে।
নিচে থাকল ধৃতদের ছবি। উদ্ধার হওয়া মোবাইল, ক্যালকুলেটরের ছবিও থাকল। অভিযোগ পাওয়ার মাত্র ১০ দিনের মধ্যেই অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে বেআইনি সাট্টাচক্রের পর্দা ফাঁস করে দিয়েছেন নিউ আলিপুর থানার তদন্তকারী অফিসারেরা। তাঁদের ছবিও থাকল।