১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার দিবস

মানবাধিকার দিবস আগেও পালিত হয়েছে। এবারও হলো। সামনে বছর আবার হবে। হয়েই যাবে। মানবাধিকার দিবস এসেও যাবে। শুধু এটা বোঝা যাবে না, এর হিসেব হবে না যে, সে তার অধিকারটা কতটা বুঝে পেলো। লিখেছেন মহিউদ্দীন আহমেদ।

     

    প্রতি বছরের মতো এবারও ১০ ডিসেম্বর, পালিত হলো মানবাধিকার দিবস। সরকারী বে-সরকারী উদ্যোগে আলোচনা- সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সহকারে মহাসমারোহে মিডিয়া কভারেজ দিয়ে পালন করা দেখলাম। দেখলাম মানবাধিকার দিবস পালিত হচ্ছে। দিনভর আলোচনার শেষে, পড়ুন মানবাধিকার দিবস পালনের শেষে যার নির্যাস, ( লোককে বলাবলি করতে শুনলাম ) আলোচনা ভালোই হলো, অনেক কথা শুনলাম। এত খরচ করেছে আর টিফিন প্যাকেট আরো ভালো করার দরকার ছিলো। এই ভালো টিফিন প্যাকেটেই আটকে গেছে “মানবাধিকার”।

    মানবাধিকার কি? কেন? কার জন্য? যা আমরা বুঝিনি। আমরা বুঝিনি আমাদের অধিকার? তার আগে- আমরা বুঝিনি “আমরা মানব”। পৃথিবীর বুকে “মানব” হিসেবে জন্ম নেবার সঙ্গে সঙ্গে কতৃপক্ষের প্রদেয় আমার প্রাপ্ত “বার্থ সার্টিফিকেট” টাই যে আমার অধিকাররের প্রথম “অধিকার” সেটাই তো কেউ শেখায় নি। আজও শিখলাম না। শিখতে জানতেও চাই না। পাড়ার কেউ বলে গিয়েছে, আজ ক্লাবে মিটিং আছে যাবি, তাই গিয়েছিলাম। মাষ্টার মশাই, উকিলবাবু, কাকা বাবু, বিশিষ্ট সমাজসেবী অনেক ভালো ভালো কথা বললেন। শুনলাম। হাততালি দিলাম। তারপর টিফিন প্যাকেট নিয়ে বাড়ী এলাম। কে কি বললেন, আর মনে নেই। মনে ধরলো শুধু, টিফিন প্যাকেটের কথা।

    আজ সমাজের, শহর কি গ্রামের আপমর জনগণ বা সিংহভাগ জনগণই বোঝেনি, বলা ভুল হচ্ছে, তাদের বোঝানো হয় নি- মানবাধিকার কি? কেন? কার জন্য?

    মানবাধিকার নিয়ে বলতে গেলে অনেক কথাই বলতে হয়। তবে, এক কথায় বলতে গেলে, আমাকে আমার কথাটা বলতে দাও, আমাকে আমার প্রাপ্যটা বুঝিয়ে দাও। এখন সমস্যাটা হলো, আমাকে যদি আমার কথাটাও বলতে বলা হয়, আমার প্রাপ্য ( অধিকার) যদি কেউ জানতে চায়, তাহলে সেটাই তো আমি বলতে পারব না। সেটাও শেখা হয় নি, জানা হয় নি। কেউ শেখায় নি, কেউ জানায় নি।

    স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বাধীন নাগরিক হয়ে আমার কর্তব্য, আমার অধিকার নিয়ে আমরা সচেতন নই। আমার খাদ্যের অধিকার, আমার বেঁচে থাকার অধিকার, আমার কথা বলার অধিকার, আমার তথ্যের অধিকার, আমার সভ্য সমাজের সভ্য মানুষ হয়ে চলাফেরা করার অধিকার সম্পর্কে আমি – আমরা অবহিত আছি কি?

    বৃহত্তর সমাজ ব্যাবস্থায় সমাজ দুই ভাগে বিভক্ত। আমরা আর ওরা। একপক্ষ অধিকার চাইবে, আরেকপক্ষ অধিকার প্রদান করবে। এই প্রাপক আর প্রদানকারীর মধ্যে বিস্তর ফারাক। প্রদানকারী পরিস্কার করে বলবে না তোমার প্রাপ্য কি? আর প্রাপকও পরিস্কার করে বুঝবে না, জানবে তার প্রাপ্য কি? শুধু দুই পক্ষই দুপক্ষকে দোষারোপ করতেই ভালো পারে। সরকারী দফতরের আধিকারিক বলছেন, তার প্রাপ্য বা অধিকার পেতে যে ভাবে বলতে হয় ( পড়ুন আবেদন করতে হয়) তা ঠিকঠাক করে নি। আর প্রাপক বলছেন, আমি সব করেছি, আমাকে আমার অধিকার, প্রাপ্য বোঝানো হয় নি। এই দুই পক্ষের মাঝে রয়েছে ভুল বুঝাবুঝি। ভুল ধারনা। এক জন আরেকজনকে বিশ্বাস করে না, ভরসা করে না। আজও দফতরে, প্রশাসনিক কার্যালয়ে মানুষ “পাবার আশাই” লাইনে দাঁড়ায়। শুধু সে বোঝেনি এটা তার চাওয়া নয়, দয়া নয়। এটা তার অধিকার। আবার প্রশাসনিক দফতরে “এর ভাই, ওর দাদা, আমি অমুকের লোক, সে পাঠিয়েছে” এসব শব্দবচন ব্যাবহার না করলে কাজ হয় না এমন ধারনা অনেকের মনে বাঁসা বেঁধে আছে। তা দূর হবে কবে? দূরের গ্রাম থেকে ময়লা, ছেঁড়া জামা, ভাঙ্গা সাইকেল নিয়ে আসা লেখাপড়া না জানা লোকটা দফতরের আধিকারিকের কাছে যান “ভয় আর সংকোচ” কে সঙ্গে করে। যেন সে “চাইতে” এসেছে। এখানে তাকে বোঝানো দরকার ছিলো, সে নিজের অধিকার বুঝে নিতে এসেছে। তাকে তার কথাটা বলতে দাও।

    মানবাধিকার দিবস আগেও পালিত হয়েছে। এবারও হলো। সামনে বছর আবার হবে। হয়েই যাবে। মানবাধিকার দিবস এসেও যাবে। শুধু এটা বোঝা যাবে না, এর হিসেব হবে না যে, সে তার অধিকারটা কতটা বুঝে পেলো। ১৯৮৭ সালের লিগ্যাল সার্ভিসেস এ্যক্ট পাস হয়েছে। মানবাধিকার পেতে বিনামূল্যে আইনী সহায়তা পাবার কথা বলা হয়েছে। পুরুষ, মহিলা, শিশু, শ্রমিক নির্বিশেষে। স্বাধীনতার এত বছর পরেও আমরা সবাই জানি না এই অধিকারের কথা। যা না জানার জন্য আমরা, আমাদের অনেক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছি। এখন, আবার মানবাধিকার দিবস পালন করা হবে। শুধু দিবস পালন করেই হবে না, সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে সঙ্গে নিয়েই সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে সচেতন করতে হবে, তোমার অধিকার তুমি চাইবে না, বুঝে নেবে। যেদিন জাতি ধর্ম বর্ণ ধনী গরিব শিক্ষিত অশিক্ষিত সবাই বুঝতে পারবে তার, জানতে পারবে তার অধিকার কি সেদিনই অন্যভাবে পালিত হবে মানবাধিকার দিবস।