কেমন আছে বাঙালি মুসলমান?

গোলাম রাশিদ: কেমন আছেন? ভালো আছি৷ সহজ প্রশ্ন, ততোধিক সরল উত্তর৷ কিন্তু তলিয়ে দেখলে এর মাঝে গভীর অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়৷ পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে বলেছিল নাটোরের বনলতা সেন, এতদিন কোথায় ছিলেন? এটা অভিযোগ, অনুযোগ না প্রশ্ন? কৈফিয়ত চাওয়াও হতে পারে৷ এতদিন আপনার কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না৷ এখন প্রশ্ন তুলছেন, জানতে চাইছেন, কেমন আছে বাংলার মুসলমান? দেশভাগের পর সাতটি দশক পার হয়েছে৷ চোখ তুলে দেখেননি? আটশো বছর পথ হেঁটে কোথায় কোথায় গিয়েছেন? মস্কো, ভ্লাদিমির লেনিন, চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান, কঠিন কঠিন রাশিয়ান, চাইনিজ শব্দের উচ্চারণ ঠোঁটের আগায়৷ আর মুসলিম নাম উচ্চারণে দুর্দান্ত হোঁচট, ঠোঁটের আগায় হাভানা চুরুটের মতো তাচ্ছিল্য লেগে৷ তাই ৩৪ বছরের বাম শাসনে কোনও মুসলিম এই বাংলায় জেলা সম্পাদক হিসেবে গুরুদায়িত্ব পায়নি৷ এর নাম সমাজতান্ত্রিক সেকুলারিজম! এখন জিজ্ঞাসা, কেমন আছেন? পালটা প্রশ্ন হতে পারে, কেমন রেখেছেন? শাসক তুর্কি মুসলিমদের আমল থেকে এ বাংলায় ইসলামের প্রচার-প্রসার৷ সুফি-দরবেশরাও ধর্ম ও সম্প্রীতি প্রচার করেছেন৷ নিম্নবর্গের মানুষ মুসলিম হয়েছে৷ তাহলে সেই প্রায় আটশো বছর থেকে কেমন আছি জিজ্ঞাসা করছেন? নাকি স্বাধীনতা তথা দেশভাগের পর কেমন আছি? দুটোই জিজ্ঞাস্য হলে প্রশ্নকর্তা হতে পারেন মিলন দত্ত কিংবা খাজিম আহমেদ৷ আর তার যুতসই জবাবদাতাও তাঁরাই৷ দু’জনেই বিদগ্ধ, বাংলার বিবেককে জানেন, চেনেন, গবেষণা ও পড়াশোনার জগতে বহু বছর ধরে নিরলস পরিশ্রম করছেন৷ আর তারই ফল ‘কেমন আছে বাংলার মুসলমান’ (প্রথমা প্রকাশন) ও ‘বাঙালি মুসলমানঃ আপন ভুবনের সন্ধানে’(প্রকাশক- উদার আকাশ)৷ এই দুটি বই সামনে রেখে ভালো-মন্দ থাকার তাৎপর্য বিশ্লেষণ ও প্রশ্নোত্তর চলতে পারে৷

    মুসলিম পরিচয় সংকটের কথা এ ক্ষেত্রে প্রথমেই উল্লেখ করা যেতে পারে৷ বাঙালি মুসলিম এ দেশীয় অন্ত্যজ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিল৷ তারা ধর্মান্তরিত মুসলিম৷ উর্দুভাষী মুসলিমদের এ ক্ষেত্রে বাদ দিলে দরিদ্র, পিছিয়ে পড়া মুসলিমদের কথাই বাকি থাকে৷ যাদের শিক্ষার হার খুব কম৷ মিশনারি শিক্ষা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে এর মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান৷ কিন্তু তাতে আর্থিক সংকট ক্রমশ দূর হলেও ‘পরিচিতি সংকট’ কাটেনি৷ মিলন দত্তের জিজ্ঞাসু মন বর্তমানের মধ্যে বাঙালি মুসলিমদের অবস্থা নিরূপণ করতে চেয়েছে, খাজিম আহমেদ অতীত থেকে উদাহরণ তুলে ধরে এক সামগ্রিক চিত্র অঙ্কনের চেষ্টা করেছেন৷ তাই বই দু’খানির মধ্যে বিশ্লেষণ ও তথ্য সরবরাহের পার্থক্য থাকলেও পাশাপাশি রেখে পড়া যেতে পারে৷

    মিলন দত্তের সন্ধানী মনের সঙ্গে বিশ্লেষণ ও তথ্যের সমাহার ‘কেমন আছে পশ্চিমবঙ্গের বাংলার মুসলমান’ বইটিকে সমৃদ্ধ করেছে৷ আর একটি বিষয়ে তাঁর সাহসের কথা উল্লেখ করতেই হয়৷ ‘সংস্কৃতির ধর্মসংকট’ শিরোনামের নিবন্ধটিতে তিনি বেশকিছু অপ্রিয় ‘স্পর্শকাতর’ প্রশ্ন তুলেছেন যেগুলি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি এতদিন এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে৷ সংস্কৃতি জগতে মুসলমানদের অংশগ্রহণ নিয়ে মিলন দত্ত প্রশ্ন তুলেছেন৷ তাঁর দাবি, ‘পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজে একাধিক বিশুদ্ধবাদী আন্দোলন রীতিমতো সক্রিয়৷ তারা প্রচার করে, মুসলমানদের সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রে কোরান-হাদিস অনুসৃত বিধিবিধানের বাইরে সবই অ-ইসলামি৷’ এছাড়া তিনি মুসলিম সমাজের সংস্কৃতি বিমুখতার জন্য দেওবন্দ-ফেরত মাওলানা ও তাবলিগিদের দায়ী করেছেন৷ এমদাদুল হক নূর সম্পাদিত ‘নতুন গতি’ পত্রিকা আয়োজিত অনুষ্ঠানগুলির সূচনা কুরআন তেলাওয়াত দিয়ে শুরু হয়, এ নিয়ে একপ্রকার প্রশ্ন তুলেছেন মিলন দত্ত৷ তাঁর অভিযোগগুলি ভিত্তিহীন নয়৷ মুসলিম সমাজে এ ধরনের কালচার রয়েছে৷ এখন কুরআন তেলাওয়াত কিংবা সংস্কৃত শ্লোক পড়ে কোনও অনুষ্ঠানের সূচনাকে যদি ‘ঐতিহ্যের অনুসরণ’ বলে অভিহিত করা হয়, তাতে অবশ্য সংস্কৃতির কোনও ক্ষতি হয় না৷ এই যুক্তিতর্কের দিকে অবশ্য লেখক যাননি৷ আর এ বিষয়ে এই বইয়ের লেখক চশমা পরে যে মুসলিম সমাজকে দেখছেন, সেটা ‘মোল্লা-মৌলবি শাসিত গোঁড়া সমাজ’৷ বাস্তবে এর অস্তিত্ব কতটা আছে তা নিয়ে আলোচনা চলতে পারে৷ এই বাংলার গ্রামের মুসলিমরা দরিদ্র, নিরক্ষর, অশিক্ষিত, পিছিয়ে পড়া৷ সংস্কৃতি অ-চর্চার জন্য এগুলিই দায়ী৷ আর মুসলিম মধ্যবিত্ত সমাজকে ইসলামি সংগঠন ও ইমাম-শাসিত বলে অনেকে মনে করেন৷ ধারণাটি স্বচ্ছ নয়৷ এ ক্ষেত্রে বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী আবদুর রাউফের ভাষাতেই বলা যায়, ‘ঈদ উপলক্ষে পাড়ায়-পাড়ায় চাঁদা তুলে আলোকসজ্জা ক্রমেই বাড়ছে এবং বাড়ছে তারস্বরে মাইকের গান৷ সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় এই যে এসব গানের বেশির ভাগই হিন্দি ফিল্মের হিট গান৷ শুদ্ধিবাদী আলেম সমাজ শত তিরস্কার করে এসব দমাতে পারছেন না৷’ তাহলে মুসলিম সমাজ শরীয়তের জন্য সংস্কৃতি বিমুখ এ কথা কতটা যুক্তিযুক্ত৷ আর এই নিবন্ধেই লেখক আবদুর রাউফের আরেকটি মন্তব্য তুলে ধরেছেন, তা অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য, ‘ইসলামি অনুশাসনের দৃষ্টিতে এই ধরনের সব বিনোদন আদৌ অনুমোদনযোগ্য কি না, যদি তা না হয় তাহলে বিনোদনের বিকল্প ব্যবস্থা কী হতে পারে? এসব প্রশ্ন নিয়ে আধুনিক শিক্ষিত মুসলমান মাথা ঘামাতে চাইছে না৷ সেটা মোটেই ভালো সেক্যুলার কিংবা এক নাস্তিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে নয়, আসলে তারা এই ধরনের অস্বস্তিকর প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে চায়৷’

    তবে মিলন দত্তের বেশকিছু পর্যবেক্ষণ ও পরামর্শ সুচিন্তিত, এ কথা অস্বীকার করা যায় না৷ এই বইয়ে মুসলমানদের হালহকিকত বলতে গিয়ে তিনি ভয়ঙ্কর সত্য উচ্চারণ করেছেন৷ পিছিয়ে পড়া, সংস্কৃতি বিমুখতা ইত্যাদির জন্য এই সংখ্যালঘু সমাজ কি একাই দায়ী? তাঁর মতে, “পশ্চিমবঙ্গে যেটা ভয়ের তা হল প্রতিবেশী সম্বন্ধে সংখ্যাগুরুর অজ্ঞতা ও অবজ্ঞা৷ কোনও সমাজের জন্য সেটা ভালো নয়৷ কিন্তু এই বিভেদ ঘোচানোর কোনও রাজনৈতিক সদিচ্ছা–না বাম না দক্ষিণ, কোনও মহলেই এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি৷ বরং মিথ্যা তথ্য দিয়ে, নানাবিধ দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করে বিভেদের সেই ফাটলটাকে বাড়িয়ে তোলেন আমাদের ‘দায়িত্বশীল’ নেতা-নেত্রীরা৷” রাজনৈতিক নেতাদের অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে তিনি থেমে থাকেননি, বাংলা সাহিত্য ও সিনেমায় মুসলিম চরিত্রের অপ্রতুলতার কথাও তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন৷ মিলন দত্ত বলছেন, ‘আসল সত্যটা হল, বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত মুসলমানকে চিনতেও চায় না৷ শিক্ষিত বাঙালি হিন্দুর এই মানসিকতায় স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যে৷ একজন সেক্যুলার লেখকও তাঁর ওই সম্প্রদায়গত অবস্থান থেকে বেরোতে পারেন না৷ কারণটা সহজ ও স্পষ্ট—সেই অজ্ঞতা৷’ সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক ও তপন সিংহের মতো সংবেদনশীল চলচ্চিত্র নির্মাতারা বাংলা সিনেমায় বাঙালি মুসলমানদের একটি শালীন বা উপযুক্ত জায়গা দিতে পারেননি৷ এই তথ্যগুলো বুঝিয়ে দেয় এ বাংলায় মুসলমানদের অবস্থা ও অবস্থান৷

    পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ অঞ্চলের সমগ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংখ্যাগুরু মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ৷ ১৯৪৭ সালে দেশভাগের ট্র‍্যাজেডির পর সেই মানচিত্র বদলেছে৷ এপার বাংলায় মুসলমানরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে৷ অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তারা পিছিয়ে পড়তে থাকে৷ সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে মননচর্চা করে চলেছেন খাজিম আহমেদ৷ ‘বাঙালি মুসলমান: আপন ভুবনের সন্ধানে’ গ্রন্থটি তাঁর এতদিনের গবেষণার ফসল৷ এর আগে তিনি প্রথম প্রবন্ধ সংকলন উদার আকাশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘পশ্চিমবাংলার বাঙালি মুসলমান : অন্তবিহীন সমস্যা’ গ্রন্থের মাধ্যমে যে আলোচনার সূত্রপাত করেছিলেন তা যেন পূর্ণতা পেয়েছে এই গ্রন্থে৷ বাঙালি মুসলিম কেমন আছে, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে তার অতীত ও অতীত থেকে বর্তমানের দিকে যাত্রাপথের মূল্যায়ন জরুরি৷ বাঙালি হিসেবে মুসলমান সমাজের বিকাশ, আত্মমর্যাদা ঠিক কোন স্থানে দাঁড়িয়ে, তা তিনি ইতিহাসের আলোকে বিশ্লেষণ করেছেন৷ মিলন দত্ত যেখানে বর্তমানের সমস্যাগুলিকে উসকে দিয়ে বাঙালি মুসলিমদের আত্মসমীক্ষার সামনে ফেলছেন, সেখানে খাজিম আহমেদ হাজী মুহাম্মদ মহসিন, নবাব আবদুল লতিফ, জাস্টিস সৈয়দ আমির আলি, মৌলানা আজাদ, সৈয়দ বদরুদ্দোজা, হুমায়ুন কবির প্রমুখ মহীরুহের জীবন থেকে আগুনের পরশমণি দেওয়ার চেষ্টা করেছেন৷ এঁদের জীবনের উজ্জ্বল দিকগুলিতে আলো ফেলে তিনি বাঙালি মুসলিমদের এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখিয়েছেন৷ ইতিহাসের এই মহানায়কদের নিয়ে আজকাল খুব কম চর্চা হয়৷ বিস্মৃতপ্রায় বললেও ভুল হবে না৷ তাঁদেরকে তিনি যেভাবে দু’মলাটের মধ্যে তুলে এনেছেন, তা তাঁর কঠোর পরিশ্রম ও গবেষণার ফসল বললে ভুল হবে না৷ পশ্চিমবাংলার বাঙালি মুসলিমদের আপন ভুবনের সন্ধান করতে গিয়ে তিনি মুর্শিদাবাদকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন৷ ঐতিহাসিক দিক থেকে এই জেলার সেই তাৎপর্য পাওয়ার অধিকার রয়েছে৷ খাজিম আহমেদ নিজেও এই জেলার মানুষ৷ মুর্শিদাবাদে ইসলামের উত্থান থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত এই জেলার রাজনীতিতে মুসলিমদের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেছেন অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে৷ ‘মুর্শিদাবাদঃ মুসলিম ভাবানুষঙ্গ’, ‘সুবে বাংলার নিজামত প্রশাসনঃ অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারা’, ‘দেশবিভাগ পরবর্তী মুর্শিদাবাদের রাজনীতিতে মুসলমানদের ভূমিকা’ শীর্ষক তিনটি তথ্যসমৃদ্ধ প্রবন্ধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ তুর্কি আগমন থেকে শুরু করে নবাবি মুর্শিদাবাদের শান-শওকত যেভাবে তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন, তা পড়লে পাঠক সেই সোনালি সময়ের স্বাদ পেতে পারেন৷

    গ্রন্থকার খাজিম আহমেদ এ দেশের মুসলিমদের সমস্যার কারণ হিসেবে অর্থনৈতিক দিকটাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছেন৷ সরকারি চাকরিতে মুসলিমদের বঞ্চনা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ওয়াকফ সম্পত্তি তছরুপ, সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি বিষয়গুলি কীভাবে বারবার তাদের জীবন ও জীবিকাকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে, তার বিশ্লেষণ করেছেন লেখক৷ এর পাশাপাশি পরিশেষে তিনি দিকনির্দেশনা দিতে ভোলেননি৷ সেই পথনির্দেশ করতে গিয়ে ইতিহাসের নির্মোহ বিশ্লেষক খাজিম আহমেদ যে শব্দগুলি উচ্চারণ করেছেন তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ—- ‘ভারতীয় মুসলমানদের মনে রাখতে হবে নিজের বিকাশের দায়িত্ব নিজে গ্রহণ না করলে প্রকৃতি, ঈশ্বর, ইতিহাস বা রাষ্ট্র কোনও কিছুই তাদের একমাত্র উদ্ধারক হতে পারে না৷’ মুসলমানরা আগামীতে কেমন থাকবে, সেটা এই বাক্যের উপরই অনেকটা নির্ভর করে৷