|
---|
রামিজ আহমেদ : চাঁদের হাট-এর আয়োজনে ভারতে ভবতোষ সুতারের ভাস্কর্যের প্রথম একক প্রদর্শনী, ‘উজ্জাপন- দ্য সেলিব্রেশন’ হল। প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন কলকাতার সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস-এর অনারারি প্রফেসর তপতী গুহ ঠাকুরতা। ওই অনুষ্ঠানে তিনি ভবতোষ সুতারের গ্রন্থ, “মাঠে ঘাটে শিল্প (আর্ট অন গ্রাউন্ড জিরো)”-ও উদ্বোধন করেন করেন। ভবতোষ সুতারের ভাস্কর্যের ওই একক প্রদর্শনী প্রত্যক্ষ করতে সরশুনার ক্ষুদিরাম পল্লি`তে চাঁদের হাট-এর অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন শহরের বিশিষ্ট শিল্পী ও শিল্প-অনুরাগীরা। প্রদর্শনীতে ৫৬টি নির্বাচিত শিল্পকর্ম প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয় যা শিল্পী নিজেই সংকলিত করেছেন। এই প্রদর্শনীটি ১০ এপ্রিল, ২০২২ পর্যন্ত খোলা থাকবে।
এই সমগ্র কর্মসূচি`র পিছনের চিন্তাভাবনা`র কথা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ভবতোষ সুতার বলেন, “উজ্জ্বপন এমন একটি বিষয় যা বর্তমান পরিস্থিতি থেকে শুরু করে কালানুক্রমিক ঘটনা নিয়ে কথা বলে। এটি ভবিতব্যের ভাষা তৈরির প্রয়াস। আমি সত্যিই বিশ্বাস করি যে আমি যে জ্ঞান অর্জন করেছি, সেটা প্রান্তিক জীবিকা এবং দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতাকে স্পর্শ করেছে। কলকাতার প্রতিটি ক্ষেত্রে আমার শিল্পকর্মের অন্বেষণ আমাকে প্রচুর আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে এবং বেঁচে থাকার মতন শিল্প আয়ত্ত করতে সাহায্য করেছে। এটি আমার অনুসন্ধানের যাত্রাকে তুলে ধরার একটি প্রয়াস। এটাই চাঁদের হাট-এ উজ্জাপন-এর কারণ। চাঁদের হাট-কে ঘিরে চারপাশে একটি সমান্তরাল সমাজ গড়ে উঠেছে এবং সেই সমাজের অনেক মানুষের সঙ্গে আমার প্রতিদিনের চিঠিপত্র আমাকে বিভিন্ন গুণাবলী গড়ে তোলার চক্রকে উন্নত করতে সাহায্য করেছে। এটি আমাকে আধিপত্য ও ক্ষমতার মুখোমুখি দাঁড়াতে সাহায্য করেছে। এটা শুধুমাত্র জন্মভূমির শিকড় হারানো এবং একটি নতুন জীবনের জন্য পশ্চিমবঙ্গে চলে যাওয়া নয়, উজ্জাপন তার বর্তমান আধারে জীবনের সংস্কারের কথা বলে।”
অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে কলকাতার সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস-এর অনারারি প্রফেসর তপতী গুহ ঠাকুরতা বলেন, “ভারতে যে কোনও শিল্পী বা শিল্পপ্রেমীর জন্য, কলকাতা হল একটি উল্লেখযোগ্য প্ল্যাটফর্ম, যেখানে যে কেউ নিজের সৃষ্টি প্রদর্শন করতে চায়৷ ভবতোষ সুতারের কাজগুলিকে বিভিন্ন জাদুঘরে, ব্যক্তিগত সংগ্রহে এবং অন্যান্য অনেক বিখ্যাত স্থানে পাবলিক আর্ট হিসাবে দেখা যায় এবং প্রতিটি ভাস্কর্য, পেইন্টিং, ইনস্টলেশন তার নিজস্ব কাহিনি তুলে ধরে। এটি শুধু কলকাতায় নয়, ভারতে তাঁর প্রথম একক প্রদর্শনী এবং এই রকম একটি কর্মসূচি`র অংশ হওয়া আমার জন্য অত্যন্ত সম্মানের।”
ভবতোষ সুতার ১৯৭৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কলকাতার গভর্নমেন্ট কলেজ অফ আর্ট অ্যান্ড ক্রাফ্ট থেকে স্নাতক হন। তিনি একজন চিত্রশিল্পী ভাস্কর্য এবং ইনস্টলেশন শিল্পী। তিনি দুর্গাপুজোয় তাঁর নিজস্ব শিল্পকর্ম নিয়ে শিল্পের এক নতুন ধারায় প্রবেশ করেছেন এবং তাঁর সৃজনশীল প্রতিভার জন্য সমালোচকদের কাছ থেকে প্রচুর প্রশংসাও পেয়েছেন। তিনি দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্ষণস্থায়ী শিল্পের একটি অংশ তৈরি করেছেন যা পাবলিক আর্টের বাধা এবং সীমানা অতিক্রম করেছে এবং তাঁর অভিজ্ঞতামূলক ডিজাইনের মাধ্যমে তিনি লক্ষ লক্ষ মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছেন। তিনি চাঁদের হাট কালেকটিভ-এর একজন প্রধান সদস্য যিনি কলকাতার সরশুনার আশেপাশে বসবাসকারী মানুষদের নিয়ে শহুরে, মফস্বল এবং গ্রামের এক অনন্য সমন্বয় তৈরি করেছেন। এটি এমন একটি আবাসস্থল যা নিজেই পরিযায়ী কাহিনি এবং উদ্ঘাটনের একটি মহাবিশ্ব। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে; প্রতিমা- কাঠ পুতলি প্রতিমা (২০০১); শব্দকল্প (২০০৬); খিদিরপুরে ২৫ পল্লিতে মানব জামিন (২০০৭); উনুন (২০০৯); পাথরে প্রাণ (২০১৩); বাধন, নাদ (২০১৮); জন্ম (২০১৯); সমর্পন (২০২১) ইত্যাদি। তাঁর বেশ কিছু সৃষ্টি যাদুঘরে এবং ব্যক্তিগত সংগ্রহে সংরক্ষিত রয়েছে।
ভবতোষ সুতারকে একজন স্ব-প্রশিক্ষিত শিল্পী হিসাবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। তিনি একজন ভিস্যুয়াল গল্প কথক যাঁর সম্পূর্ণ অনুশীলন ভাস্কর্য, পেইন্টিং এবং ইনস্টলেশন সহ বিভিন্ন মাধ্যম-এর সঙ্গে গত দুই দশক ধরে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে রয়েছে।
পাবলিক স্পেসে তাঁর কাজ প্রায়ই একটি স্মারক স্কেলে তৈরি হয়ে থাকে। ভবতোষের ইনস্টলেশনগুলি হল, অস্থায়ী প্রদর্শনী যা একটি বিশাল প্রভাব ফেলতে পারে এবং দর্শকদের প্রভাবিত করতে পারে৷ তিনি মানব সংস্কৃতির সঙ্গে তার আশেপাশের পরিবেশের শারীরিকতার প্রতি আগ্রহী। তাঁর কাজের অংশটি একাধিক দৃষ্টিকোণ এবং সাময়িকতা থেকে সাইটটিকে পরীক্ষা ও পুন:পরীক্ষা করে।
চাঁদের হাট দর্শকদের, তাদের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা থেকে প্রলুব্ধ করে সক্রিয় করে তোলে এবং তাদের মধ্যে শিল্পকর্মের নান্দিনক ব্যবধানকে ঘোচানোর চেষ্টা করে। এর মাধ্যমে দর্শকরা একটি নিরাপদ, বাহ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে বস্তুনিষ্ঠভাবে একটি শিল্পকর্মকে বিবেচনা করার সুযোগ পায়। এই প্রয়াসের সিংহভাগই কোনও না কোনও রাজনৈতিক বা মতাদর্শগত অংশগ্রহনে সামিল হয়। এইভাবে ধর্মীয় মূর্তিশিল্প একটি রাজনৈতিক আন্দোলন দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয় যেখানে শিল্পী এবং তাঁদের দর্শকরা উভয়ই অংশগ্রহণ করে।