|
---|
নিজস্ব সংবাদদাতা : রাত পোহালেই বাঙালির অন্যতম শ্রেষ্ঠ উৎসব দোল।গোটা রাজ্যের মানুষ মেতে উঠবেন রং এবং আবির খেলায়। কিন্তু অনেকেই হয়তো জানেন না প্রায় একশো বছরের বেশি পুরনো এক ব্রিটিশ ‘নির্দেশিকা’র জন্য আজও মুর্শিদাবাদ জেলায় দুদিন ধরে রং খেলা হয়। একসময় এই দোল বা হোলি উৎসবের দিনটিতে মুর্শিদাবাদের রাজা, নবাব এবং জমিদাররা তাঁদের সম্পদ ও বৈভবের প্রদর্শন করতেন।অনেকেই মনে করেন মুর্শিদাবাদ জেলায় নবাবী আমলে শুরু হওয়া দু’দিনের হোলি উৎসব আসলে একটি সামন্ততান্ত্রিক সংস্কৃতির নিদর্শন। ১৭৯৩ সালে ব্রিটিশ সরকার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করার পর মুর্শিদাবাদ জেলাতে হোলি উৎসবের জাঁকজমক আরও বেড়ে ওঠে। মুর্শিদাবাদের বিখ্যাত ঐতিহাসিক বিষাণ গুপ্ত বলেন, ‘১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের পর একাধিক রাজা, মহারাজা তাঁদের জমিদারির কাছারিবাড়ি বহরমপুর শহরের তৈরি করেছিল। তার কারণ ব্রিটিশ সরকার নিয়ম করেছিল চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সামন্ত প্রভুরা খাজনা দিতে না পারলে তাদের জমিদারি বিলুপ্ত হবে।’
একাধিক ঐতিহাসিক বলেন, এই সময়ে বহরমপুর শহরের একাধিক নামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে এবং একটি কোর্ট তৈরি করে ব্রিটিশ সরকার। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল রাজা, মহারাজা এবং জমিদারদের মধ্যে বিভিন্ন জমি বিরোধের নিষ্পত্তি করা। বিষাণ গুপ্ত আরও বলেন, ‘মুর্শিদাবাদের বিখ্যাত রাজা ও জমিদার যেমন- বৈকুন্ঠনাথ সেন, হরি সেন এবং কাশিমবাজার, কান্দি এবং জিয়াগঞ্জের মহারাজারা বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী ছিলেন। এই ধর্মে হোলি একটি বড় উৎসব। হোলি এবং দূর্গা পুজোর দিন এই সমস্ত রাজা এবং মহারাজারা তাদের অর্থ এবং সম্পদের প্রাচুর্য জনসমক্ষে প্রদর্শন করতে ভালোবাসতেন।’ হোলির আগের দিন জমিদার, রাজা এবং মহারাজারা ‘চাঁচোল উৎসব’ পালন করতেন (যা ন্যাড়াপোড়া নামেই বেশি পরিচিত)। এইদিন রাজা এবং জমিদাররা তাঁদের পারিবারিক দেবতাকে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার মাধ্যমে ভাগীরথী নদীতে নিয়ে যেতেন স্নান করানোর জন্য।
বিষাণ গুপ্ত বলেন, ‘হোলির দিন জমিদার, রাজা এবং মহারাজারা তার নিকট আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব এবং লাঠিয়ালদের সঙ্গে রং এবং আবির খেলতেন। কিন্তু প্রায়ই দেখা যেত তাঁরা যখন রাস্তা দিয়ে শোভাযাত্রার মাধ্যমে রং খেলতে যেতেন তখন রাজা, মহারাজা এবং জমিদারদের অনুগামীদের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে যেত।’ ইতিহাসবিদরা বলেন, ‘এই সমস্ত রাজা, মহারাজা এবং জমিদাররা এতটাই প্রভাবশালী ছিলেন যে স্থানীয় জেলা কালেক্টরের পক্ষে তাদের রাস্তায় নেমে হোলি খেলা বন্ধ করার ক্ষমতা ছিল না। বিষাণ গুপ্ত জানান, ‘তাই বিংশ শতকের প্রথম ভাগে ব্রিটিশ প্রিভি কাউন্সিল একটি অর্ডার পাস করে। সেই আদেশনামাতে বলা হয়েছিল খাগড়া-সৈদাবাদ এলাকার মহারাজা এবং জমিদাররা একদিন হোলি খেলবেন এবং বহরমপুর (মূলত গোরাবাজার) এলাকার জমিদার বা প্রভাবশালী ব্যক্তিরা অপর দিন হোলি খেলবেন।’ রাজন্য ও জমিদারি প্রথা বহুদিন আগেই বিলুপ্ত হলেও পুরনো রেওয়াজ মেনে এখনও বহরমপুর শহর এবং মুর্শিদাবাদ জেলাতে দু’দিন ধরে দোল খেলা হয়।
বিষাণবাবু আরও বলেন, ‘হোলির দিন জমিদার এবং রাজারা তাদের প্রজাদেরকে নিজেদের বাড়িতে ডাকতেন এবং একটি বিশেষ মিষ্টি, যা স্থানীয়ভাবে মালপোয়া নামে বেশি পরিচিত তা খাওয়াতেন।’ সেই ঐতিহ্য বজায় রেখে আজও দোলের দিন বহরমপুরের প্রচুর মিষ্টির দোকানে মালপোয়া তৈরি করে। মুর্শিদাবাদ জেলা ইতিহাস ও সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্রের সম্পাদক অরিন্দম রায় বলেন, ‘মুর্শিদাবাদে এখনও দু’দিন ধরে দোল খেলা হলেও ‘বসন্ত উৎসব’ এখন অনেক বেশি করে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। অনেক সংগঠন এখন সপ্তাহব্যাপী ‘বসন্ত উৎসব’ পালন করছে। বয়স এবং ধর্ম নির্বিশেষে সমস্ত মানুষই এতে অংশগ্রহণ করেন। তবে এখনও মুর্শিদাবাদ জেলা জুড়ে দু’দিন ধরে রং খেলার রীতি চালু রয়েছে।’