মালদহে’ মৌসম কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে, দেশের স্বার্থ বনাম ব্যক্তিগত আবেগ

শরীফুল ইসলাম। নতুন গতি,

    কেউ বলছেন মীরজাফর, কেউ গদ্দার কেউ বা স্বার্থপর। বেনজির মৌসম বদলে দেশ জুড়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিতর্ক-ঝড় এখন তুঙ্গে।

    উল্লেখ্য, ১৯ শে জানুয়ারির মমতা’ বিগ্রেড সমাবেশে মঞ্চে তাঁর দল সহ দেশের ২৩ টি অবিজেপি দলের নেতৃত্ব ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে বিজেপির বিরুদ্ধে ১:১ লড়াইয়ের রণকৌশল মোটামুটি স্থির হবার পর পরই সব জল্পনার অবশেষে এ-সপ্তাহ সোমবার, মালদহ’ (উ:) সাংসদ মৌসম বেনজির নূর যোগ দিলেন তৃণমূল কংগ্রেস-এ।
    নবান্নে, তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলে নাম লেখানোর অব্যবহিত পরই সমালোচনার ঝড় ওঠে কংগ্রেস সহ ডান-বাম সব শিবিরে।

    নানা মুণির নানা মতের জবাবে মৌসমের সাফ বক্তব্য , রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের নেতৃত্বেই তিনি চলবেন। এবং দ্বার্থহীন ভাষায় বুঝিয়েও দেন ওঁর নেতৃত্বেই বিজেপির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ময়দানের লড়াইয়ে এক ইঞ্চি জমিও ছাড়তে নারাজ তিনি এবং তাঁর মালদাবাসী।
    তৃণমূল নেত্রী তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও তাঁর দলের নবাগতা এই সাংসদ মৌসম কে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান।
    এর পরেই কংগ্রেসে সদ্য প্রাক্তনী বেনজিরের দলবদলের ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক মহলে বিতর্ক শুরু হয়।

    সাধারণভাবে ভারতবর্ষের সংসদীয় রাজনীতিতে দলবদলের বা আঞ্চলিক দল গুলির গাঁটবন্ধন নতুন কিছু না। আর তাছাড়া, জনবিরোধী কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপির বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িক একটি শক্তিকে এককাট্টা করাই যখন অবিজেপি দল গুলির লড়াইয়ের অভিমুখ তখন মৌসমের দলবদলে এত বিতর্ক কেন ?

    ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং গান্ধী পরিবার যেমন অবিচ্ছেদ্য , অনুরূপ মালদহে গনিখান চৌধুরী এবং কংগ্রেস এক ও অভিন্ন। মালদহের গণিখান পরিবারের উত্তরসূরি হিসাবে মৌসম বেনজিরের এই কংগ্রেস ত্যাগ অবশ্যই সেই প্রেক্ষাপটে নজিরবিহীন। মৌসমের রাজ্য তৃণমূল কংগ্রেসে আসার ব্যাখ্যাই এই উত্তর প্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে। তবে, অকাট্য নয়। এই বিতর্কের কেন্দ্র আরো গভীরে প্রোথিত।

    ১৮৮৫ তে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য যাই থাক, পরবর্তী কালে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি মঞ্চ হিসাবে এই দল টিকে দেখেছেন যাঁরা তাঁদের মধ্যে অনেকের কাছেই ভারতের স্বাধীনতার লাভের পর দলটির গুরুত্ব হ্রাস পায় এবং অনেকে তো স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্য পূর্ণ হবার পর বিভিন্ন দলের মঞ্চ হিসাবে ব্যবহৃত এই স্ট্যান্ড ভেঙে দেওয়ারই পক্ষপাতী ছিলেন। দেশের স্বার্থে জাতীয় কংগ্রেসের উপযোগিতা নিয়ে অস্বীকার করার ধৃষ্টতা কারো নেই বটে, কিন্তু দেশের উর্দ্ধে এই দল নয়, একথা স্বীকার করার যুক্তিবাদী লোকও বোধ করি পাওয়া যাবে না এমন নয়। বিশেষ দল প্রীতি যতই হোক না কেন দেশের স্বার্থে তা নগন্য এ কথা বলার অপেক্ষা থাকে না।

    রাজনৈতিক বিশ্লেষক দের মতে , কেন্দ্রের বিজেপি এবং তাঁদের অধীন রাজ্য গুলির সাম্প্রতিক কার্য্যকলাপ দেশের পক্ষে মোটেই স্বাস্থ্যকর নয়। বরং কয়েক টি ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়, যে ধর্ম ধারণ করে ভারতকে আরো মজবুত ও শক্তিশালী করা যেত সেই ধর্মকেই ব্যবহার করে এঁরা জাতি-ধর্ম উপর ভিত্তি করে দেশের মানুষের মধ্যে মেরুকরণ এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী মানসিকতা কে প্রশ্রয় দেওয়ার খেলায় উন্মত্ত। ডিমানিটাইজেশন থেকে শুরু করে দেশ চালনায় একের পর এক ফ্লপ নীতি ঢাকতে ক্রমাগত ধর্মান্ধতা কে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। মন্দির-মসজিদ, হিন্দু-মুসলিম ইস্যু, আর গো ভক্তি ক্রমাগতভাবে দেশে অস্থির পরিবেশ তৈরি করছে। স্থিতিশীল অর্থনীতি, জীবিকার প্রশ্নেও দিশাহীন। ঐতিহাসিক স্থান গুলিকে বেসরকারিকরণ, নাম পরিবর্তন এই সব নিয়েই মেতে আছে।
    এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে লড়াইটা যদি দেশের- দশের কল্যাণে ,দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য , সংবিধান – সংহতি বাঁচানোর স্বার্থে হয় তবে দল ত্যাগ করার মধ্যে কোনো অনৈতিকতা নেই বলেই অধিকাংশের মত।
    বামপন্থী বলে দাবি করা কয়েক জন মনে করছেন বিজেপিকে সুবিধা করে দেওয়া ছাড়া মৌসমের এই দল পরিবর্তনে কোনো লাভ হবে না। রাজ্য কংগ্রেস বিষয়টিকে গুরুত্বই দিতে চাইছে না। মৌসম নূরের এই রাজনৈতিক পরিবর্তনের সমীকরণে লাভ-ক্ষতির পাটি গণিত সময়ের হাতে থাক না।

    প্রধানমন্ত্রী তো সর্বজন গ্রাহ্য এক জন হবেন নিশ্চিত তবে আপাতত আগামী লোকসভা নির্বাচনের মিশন এবং ভীষণ কেন্দ্রে ধর্ম নিরপেক্ষ শাসন। সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর প্রাথমিক শর্ত যে যেখানে শক্তিশালী তাঁকে আরো মজবুত করা। দেশের সাধারণ নির্বাচনকে পাখির চোখ হিসাবে দেখলে বর্তমান ফেডারেল ফ্রন্টের ধারণায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিশ্চিত এক অগ্রণী মুখ। সেই হাত কে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে তাঁর পাশে থাকাটাও জরুরি যাঁরা মনে করেন তাঁদের মতে , দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের নির্লজ্জ অবক্ষয় এবং দেশ কে বিপথ চালিত করার ষড়যন্ত্র যখন চলে, দেশের স্বার্থে তখন মৌসমদেরও মত ও পথ পাল্টানো অপরিহার্য হয়ে পড়ে।