|
---|
আসাদুল ইসলাম,কলকাতা: তিনি ছিলেন দল ভাঙ্গানোর মাস্টার। যেভাবে তিনি তৃণমূল কংগ্রেসকে গড়েছিলেন ঠিক সেভাবেই ভেঙ্গে দিচ্ছেন একদা তৃণমূল কংগ্রেস দলের সেকেন্ড ম্যান ইন পজিশন মুকুল রায়। নির্বাচনে না জিতেও কেবল দলবদলের কারসাজিতে একসময় বহু পৌরসভা, পঞ্চায়েত, বিভিন্ন পর্ষদ উপহার দিয়েছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসকে। কংগ্রেস, সিপিএময়ের বড় বড় নেতাদের হাতে ঘাসফুল পতাকা ধরিয়ে দিয়ে দলে যোগদান করিয়েছিলেন। এটা নিত্যদিনের স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে উঠেছিল। মূলত তাঁর সৌজন্যে, এক সময় যে নেতাদের হাতে মার খেয়েছেন হেনস্থা হয়েছেন দলের পুরনো কর্মী -নেতারা, তারা দলে ভিড়ে গিয়ে আবার দাদাগিরি দেখানোর জায়গায় চলে আসায়, নবাগত আর পুরনো তৃণমূলীদের মধ্যে আড়াআড়ি বিভাজন রেখা তৈরি হয়েছিল রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে। তারপর গঙ্গা দিয়ে যত জল বয়ে গেছে ততই দুই পাড়ের লাল তৃণমূল আর সবুজ তৃণমূল মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। গোটা রাজ্যই হয়ে উঠেছে ঘাসফুলে ছয়লাপ। তারপর শোনা যায় একদিন, এই খেলারই শিকার হয়ে ওঠেন খোদ মুকুল রায়। নবীন অভিষেক ব্যানার্জীর উত্থানে তাঁর মর্যাদা কমতে শুরু করে। ক্রমাগত কোণঠাসা হয়ে পড়া মুকুল রায় শোনা যায় সেই অভিমানেই দলের সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে শুরু করেন। নারদা আর সারদা কাণ্ড দলের ভাঙ্গন রেখাকে তারপর আরও গভীরতর করে তোলে। আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের মুখে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সেই ভাঙ্গন খেলা চমকপূর্ন হয়ে উঠেছে। মুকুল রায়ের ওস্তাদির জেরে একের পর এক নেতা দল ছেড়ে যোগদান করছেন বিজেপিতে। তৃণমূল কংগ্রেস দলের অন্দরে এর ফলে রীতিমতো চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়েছে। আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে উপযুক্ত প্রার্থী দেওয়া না -দেওয়া নিয়ে যখন চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে ফল কতটা ভালো বা খারাপ হতে পারে তা নিয়ে, তখন দলের একাধিক নেতাকে ভাঙিয়ে নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের আগামী লোকসভা নির্বাচনের খারাপ ফল করার সম্ভাবনাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছেন মুকুল রায়। শুধু তৃণমূল কংগ্রেস থেকেই নয় ডানপন্থী জাতীয় কংগ্রেস এমনকি বামপন্থী সিপিএম থেকেও নেতানেত্রীরা বিজেপির মত কট্টর ডানপন্থী দলে ভিড়ছেন । লোকসভা ভোটের মুখে বোলপুরের সাংসদ অনুপম হাজরা, বিষ্ণুপুরে সাংসদ সৌমিত্র খাঁ, ভাটপাড়ার বিধায়ক অর্জুন সিং তৃণমূল কংগ্রেস ছেড়ে ইতিমধ্যে বিজেপিতে নাম লিখিয়েছেন। বিধান নগর পৌরসভার মেয়র সব্যসাচী দত্ত, কলকাতা পৌর নিগমের প্রাক্তন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর বান্ধবী বৈশাখী ব্যানার্জি এবং দক্ষিণ দিনাজপুরের তৃণমূল জেলা সভাপতি বিপ্লব মিত্রের বিজেপিতে যোগদান নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনার খবর রটেছে। অর্জুন সিং এর কিছু ঘনিষ্ঠ বিধায়কও বিজেপিতে যোগ দিতে পারেন বলে শোনা যাচ্ছে। বিজেপির কেন্দ্রীয় ও রাজ্য নেতৃত্বের পক্ষ থেকে বারবার দাবি করা হচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেসের আরও বহু নেতানেত্রীর বিজেপিতে যোগদান শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র। খেলার গতি প্রকৃতি দেখে স্পষ্ট যে এই কম্মের কারিগর দিলীপ ঘোষ বা শমীক ভট্টাচার্য নয় মুকুল রায়। তাঁর পুরনো অস্ত্র দিয়েই তিনি তৃণমূল কংগ্রেসকে ঘায়েল করতে চাইছেন। গত পাঁচ-সাত বছর ধরে রাহুল সিংহ, দিলীপ ঘোষরা জান লড়িয়ে দিয়েও আশাপ্রদ ফল করতে পারেননি পশ্চিমবঙ্গে। তাই কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে মুকুল রায় হয়ে উঠেছেন আশা ভরসার জায়গা। গোটা দেশেই বিজেপি নেতৃত্ব এখন কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। আগামী লোকসভা নির্বাচন শেষে নরেন্দ্র মোদি আবার প্রধান মন্ত্রীর কুর্সিতে বসতে পারবেন কিনা তা নিয়ে এখন ঘোর সংশয়। বিজেপি বিরোধী দলগুলো যেভাবে বিরোধিতার স্বর উচ্চগ্রামে তুলে অনেকটা সুবিধাজনক অবস্থায় চলে গিয়েছিল পুলওয়ামা কান্ড শেষে তা খানিকটা ঠেকানো গেলেও পরিস্থিতি কিন্তু অনুকূল নয়। এই অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ফের ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনতে মরিয়া বিজেপি নেতৃত্ব স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয় দেশের সমস্ত রাজ্যে লোকসভা নির্বাচনে টিকিট পাওয়ার একমাত্র যোগ্যতা হলো তার জিতে আসার সম্ভাবনা। দলগত আদর্শ আছে কী নেই, এসব দেখার দরকার নেই, একথা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ। সেই সূত্র মেনেই আশা করা যায় পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি প্রার্থী ঘোষণা করা হবে। সেক্ষেত্রে তৃণমূল কংগ্রেস, কংগ্রেস এবং সিপিএম থেকে বিজেপিতে যোগদান করা নেতা-নেত্রীদের টিকিট পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। যদি তাই হয় তাহলে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার ফর্মুলায় রক্তাক্ত হয়ে উঠতে পারে তৃণমূল কংগ্রেস। এরকম কঠিন পরিস্থিতিতে মমতা ব্যানার্জির কাছে মসীহা হয়ে উঠতে পারে রাজ্যের সংখ্যালঘু ভোট। প্রায় ৩০ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোট আছে এই রাজ্যে। এই ৩০ শতাংশ ভোটকে মমতা ব্যানার্জি নিজের দিকে নিয়ে আসতে পারলে নিশ্চিন্ততা অনেকটাই বেড়ে যায়। বিক্ষুব্ধ দু-এক শতাংশ বাদে মোটের ওপর সংখ্যালঘু ভোটের সবটাই তৃণমূল কংগ্রেসের ঝুলিতে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। মমতার এই ভরসার জায়গায় ঘা দিতে শোনা যাচ্ছিল কিছুদিন আগে রাজ্য বিজেপিও সচেষ্ট হয়েছে। এবং বেশ কিছু সংখ্যালঘুমুখকে প্রার্থী করার বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছে। সেটা যদি হয় তাহলেও মারাত্মক কিছু হওয়ার সম্ভাবনা ক। কারণ সংখ্যালঘু মুসলমানদের বেশিরভাগ অংশই এখনও বিজেপি বিমুখ। তৃণমূল কংগ্রেসের জন্য আশঙ্কার বিষয় হল রাজ্যের সর্বত্র সংখ্যালঘু জনসংখ্যার হার সমান নয়, কোথাও কম কোথাও বেশি। এর ফলে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত কেন্দ্রগুলিতে তৃণমূল কংগ্রেস ভালো ফল করলেও, যেখানে সংখ্যালঘু মুসলমান জনসংখ্যা কম সেখানে তৃণমূল কংগ্রেসের খারাপ হল করার সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে। সংখ্যালঘু মুসলমান জনসংখ্যা কম এমন কেন্দ্রগুলিতে তৃণমূল কংগ্রেস, কংগ্রেস, সিপিএম থেকে বিজেপিতে আসা নেতা-নেত্রীদের টিকিট দেওয়া হলে লড়াইটা কিন্তু কিছুটা হলেও কঠিন হয়ে যাবে তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে।