|
---|
জাহির আব্বাস, পূর্ব বর্ধমান : বোলপুর লোকসভা কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী অসিত মালের সমর্থনে বুধবার আউসগ্রাম হাই স্কুল ফুটবল মাঠে তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটি জনসভায় অংশগ্রহণ করেন। সেখানে তিনি পশ্চিমবাংলার মানুষের জন্য নানা প্রকল্প ও উন্নয়নের কথা তুলে ধরার পাশাপাশি বিজেপির মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে সরব হন এবং ভারতবর্ষ থেকে হটানোর ডাক দেন। তৃণমুল নেত্রী মমতা ব্যানার্জি দীর্ঘ সময় ধরে ইলেকশন করার বিরূদ্ধে আওয়াজ তোলেন। বলেন, তিন মাস ধরে ইলেকশন চালাচ্ছো, একবার ভাববে না, কী গরম! মানুষের কত কষ্ট হয় এই কাঠফাটা রোদ্দুরে! তিনি আরো বলেন,এই নির্বাচনে যদি বিজেপি জেতে, আর দেশে কোনোদিন নির্বাচন হবে না। ভারতবর্ষের গণতন্ত্র আজ জেলে পরিণত হয়েছে। ওয়ান ইলেকশন, ওয়ান পার্টি, ওয়ান লিডার – আর কেউ ভারতবর্ষে থাকবে না। তিনি বিজেপির কার্যকলাপ প্রসঙ্গে বলেন, বিজেপি দেশ বিক্রি,জাতি বিক্রি, ধর্ম বিক্রি,অধিকার বিক্রি ,সম্পত্তি বিক্রি, মানুষ বিক্রি – সব করে দেবে। উন্নয়নের কাজ নেই। একটাও বলতে পারছেন না দশ বছরে কী করেছেন। শুধু প্রচার করে যাচ্ছেন, আমি এটা করেছি। তিনি অভিযোগের সুরে বলেন, আমাদের কাজগুলোর প্রচার করে যাচ্ছেন উনি করেছেন বলে। এছাড়াও তিনি বিজেপির প্রচুর টাকা খরচ করে প্রচারের বিরুদ্ধেও সরব হন। তিনি বলেন, আমাদের পক্ষে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে ওই প্রচারের পাল্টা প্রচার টিভি কাগজে অ্যাড দিয়ে করা সম্ভব নয়। তাই আমরা আমাদের কথা মানুষের কাছে বলছি। যেটা বলছি নিজে কানে শুনবেন , নিজে চোখে দেখবেন।বিজেপির কথা শুনবেন না। দেখবেন না। ওরা মিথ্যে কথার দল মিথ্যে বলার দল।
তুমি বর্তমানে নানা সমস্যা বিষয়ে বিজেপির নীরবতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। বলেন, এখন বেকারের কথা বলছে না। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে, বলছে না। মেডিসিনের দাম বেড়ে গেছে, বলছে না। ব্যাংকের টাকা লোকে ঠিকমতো পাই না, সেগুলো বলছে না। সারা পৃথিবী আজকে ছি ছি করছে ওদের।
তিনি আরো বলেন, আজকে শুধু বলছে এনআরসি করব। সিএএ করব। ইউনিভার্সাল সিভিল কোড করব। মানে, আপনার ধর্ম বিক্রি হয়ে যাবে।আপনার অধিকার বিক্রি হয়ে যাবে। আপনার সম্পত্তি কেড়ে নেবে। আপনাকে না খাইয়ে মারবে। আপনাকে ডিটেনশন ক্যাম্পে রেখে দেবে। আমরা থাকতে এই জিনিস আমরা করতে দেব না। তাই সারা দেশে সব মানুষের কাছে আবেদন, যে যেখানে(আছেন ),বিজেপিকে ভোট দেওয়া যাবে না।দেশ বেচে দেবে। বিজেপি পার্টি একটা জুমলা পার্টি। একটা মিথ্যাবাদী। যত চোর- -ডাকাত-মাফিয়া দেখবেন যে, বিজেপিতে নাম লিখিয়েছে। কেন?
অন্যদিকে, তৃণমুল নেতা কর্মী
সমর্থক দের সাহস প্রসঙ্গে বলেন, যারা তৃণমূল করে তাদের বুকের পাটা আছে। তারা লড়াই করে বেঁচে আছে। আমাদের রোজ দশটা করে চিঠি পাঠায়। কখনো ই ডি, কখনো ইনকাম ট্যাক্স, সিবিআই পাঠাচ্ছে। তিনি পাল্টা প্রশ্ন তুলে বলেন, ওদের চোর-ডাকাতদের একটাও চিঠি পাঠিয়েছে? বিজেপির কেউ অ্যারেস্ট হয়েছে? এপ্রসঙ্গে কেষ্ট অর্থাৎ অনুব্রত মণ্ডলের কথা টেনে নাম না করে শুভেন্দু অধিকারী কে খোঁচা দিয়ে বলেন, কেষ্ট যদি দুর্নীতির জন্য অ্যারেস্ট হয়ে থাকেন, তোমার গাদ্দার তো সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিবাজ,সে কেন অ্যারেস্ট হবে না! তিনি আরো বলেন,বিজেপি কোটি কোটি টাকা খরচ করে ফেক নিউজ তৈরি করে দাঙ্গা লাগায়। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ করে। মা বোনেদের সম্মানহানি করে ।বেকারের চাকরি কাড়ে। শ্রমিকের চাকরি কাড়ে।তাই তিনি জনতাকে সতর্ক করে বলেন , মনে রাখবেন এটা দিল্লির ইলেকশন। বাংলায় আমরা যত বেশি সিট পাবো ।এই সিট গুলি নিয়ে আমরা দিল্লিতে ইন্ডিয়া জোটকে তত বেশি শক্তিশালী করতে পারব।এবং আমরা মোদির বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে দেশটা কীভাবে আগে চলতে পারে,মানুষকে সাহায্য করতে পারে- তার জন্য আমরা চেষ্টা করব।
তিনি বিজেপির ধর্মবোধ প্রসঙ্গেও প্রশ্ন তোলেন ।বলেন, হিন্দু ধর্ম ওরা মানেনা। কীসের হিন্দু ধর্ম! আমরা মানি, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ধর্ম। ওদের হিন্দুধর্ম মানে মা দুর্গা না, মা কালী না।
দেশের স্বয়ংশাসিত সংস্থাগুলির নিরপেক্ষতা নিয়েও তিনি আওয়াজ তোলেন। বলেন, এরা কোর্ট কিনে নিয়েছে। সিবিআই কিনে নিয়েছে। আমি সুপ্রিম কোর্টের কথা বলছি না। সুপ্রিমকোর্টের কাছে এখনো আমরা বিচারের আশায় আছি। এরা হাইকোর্ট কিনে নিয়েছে। এরা এন আই এ কিনে নিয়েছে। এরা বিএসএফ কিনে নিয়েছে।
এরপরই গণমাধ্যমের ওপর প্রভাব খাটানো ও গৈরিকি করণের প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। বলেন, দূরদর্শন- দেখবেন, তার রংটাও গেরুয়া করে দিয়েছে। শুধু বিজেপির কথা বলবে ।আর “মোদি কা বাত” বলবে ।আর আপনাকে শুনতে হবে। দেখবেনই না, বয়কট করে দেন। ওটা দেখলেই মাথা গরম হয়ে যাবে। সব স্টেশনগুলোর রং গেরুয়া করে দিচ্ছে। এবার বলে দেবে আপনাদেরও শুধু গেরুয়া রং পরতে হবে। তাহলে সাধুরা কি পরবে? যারা ত্যাগী হয়, তারা গেরুয়া পরে। আর বিজেপি তো ভোগী। ভোগীরা কেন গেরুয়া রং পরবে?
তিনি ১০০ দিনের কাজের টাকা,আবাস যোজনার ঘরের টাকা আটকানো অন্যান্য রাজ্যের সাথে নিরিখে বাংলার প্রতি দ্বিচারিতা প্রসঙ্গ তুলে বলেন, আমি তো রোজ বলি একবার করে- বড় বড় কথা বলবার আগে, তৃণমূলকে চোর বলবার আগে, ওরে ডাকাতরা একবার মুখ ফুটে বল যে, তোদের রিপোর্ট কী আছে? মহারাষ্ট্রের রিপোর্ট বের কর, উত্তরপ্রদেশের রিপোর্ট বের কর, বিহারের রিপোর্ট বের কর, আর বাংলার রিপোর্ট বের কর এবং সাথে সাথে এজি রিপোর্টও বের কর। তিনি অভিযোগ করেন, ওরা দেয়নি। এ প্রসঙ্গে তিনি তৃণমুল এম পি সহ নেতাকর্মী দের দিল্লিতে লড়াই এর কথা মনে করান। বলেন,তৃণমূল কংগ্রেসের এমপি রা একমাত্র পার্লামেন্টে বিজেপিকে জব্দ করে রেখেছে। আর কেউ পারেনা। ভয়ে সাহস পায় না। তৃণমূল কংগ্রেস না থাকলে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়বার কেউ নেই।
এরপরই তিনি বিজেপির বিরুদ্ধে ইন্ডিয়া জোটকে শক্তিশালী করার আহ্বান জানান,
তিনি বলেন, সারাদেশে যত রিজিওনাল পার্টি আছে, অন্য পার্টি আছে সারাদেশে তারা লড়াই করুন। আমাদের তাতে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু, বাংলায় লড়াইটা আমাদের করতে হয়। তাই বাংলায় তৃণমূল কংগ্রেসের সাথে লড়াইটা বিজেপির হচ্ছে। তৃণমূল কংগ্রেসের ভোটটা কেটে গেলে বিজেপি লাভবান হবে । আপনারা নিশ্চয়ই সেটা চান না। এ প্রসঙ্গে তিনি সিপিএম কংগ্রেসের ভোট কাটার প্রসঙ্গও উল্লেখ করেন।
তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জি উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে আশ্বস্ত করে বলেন, আপনারা কি মনে করেন বিজেপি এবার ক্ষমতায় আসবে? মাটির কথা শুনে রাখুন, আগের বারে সব জায়গায় সব সিট পেয়ে ৩০৩ হয়েছিল ৫৪৩ এর মধ্যে। আর এবারে উত্তরপ্রদেশেও অত সিট পাবে না। অখিলেশ ভালো লড়াই করছে। বিহারে যত সিট পেয়েছিল এবার থোড়াই পাবে? হাফও পাবে না। রাজস্থানে প্রথম ভোটেই কুপোকাত। ঘাবড়ে গেছেন। এভাবে তিনি মধ্যপ্রদেশ,চেন্নাই ,কর্ণাটক, তামিলনাড়ু,তেলেঙ্গানাতেও বিজেপির আশানুরূপ সিট না পাবার কথা উল্লেখ করেন। কেরালায় সিপিএম-কংগ্রেস মিলেমিশে সিট পাবার কথা বলেন। দিল্লি ও হরিয়ানার কৃষকদের বিজেপির বিরুদ্ধে অসন্তোষের কথাও তুলে ধরেন।
এরপরই তিনি সতর্ক করে বলেন, বিজেপির প্রচুর টাকা। জনগণের জন্য তো কিছু করেনি। সব টাকাটাই লুট করেছে। জনগণের পকেট মেরেছে। আর সেই টাকাটা দিয়ে রোজ নিজের প্রচার করছে। কিন্তু গরিব মানুষকে বাড়ি দিচ্ছে না। ১০০ দিনের কাজ দিচ্ছে না। মা-বোনেদের কাজ দিচ্ছে না। সংখ্যালঘুদের টাকা দিচ্ছে না। সবকিছু বন্ধ করে দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে, তিনি বিজেপির মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ১৫ লক্ষ টাকা উল্লেখ করেন।তিনি বিজেপির সভায় লোক ভরানো প্রসঙ্গে বলেন, ইলেকশনের আগে লোক পাই না বলে ভাড়া করে লোক নিয়ে আসেন। ভাড়াটিয়া লোক। মিছিলে জয়েন করলেই ৫০০ টাকা।
তিনি কর্মসংস্থান প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বলেন, আবার যদি বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসে,না থাকবে নিজের ধর্মের ব্যবহার, না থাকবে মানুষের অধিকার, না থাকবে কথা বলার অধিকার, না থাকবে জীবন জীবিকার অধিকার। কী থাকবে ?শুধু থাকবে, চাকরি দেওয়ার ক্ষমতা নেই, চাকরি কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতা। ভাত দেওয়ার ক্ষমতা নাই, কিল মারার গোসাই । এরপরই সম্প্রতি ২৬ হাজার শিক্ষকের চাকরি বাতিল প্রসঙ্গে তিনি তীব্র ধিক্কার জানান। তিনি বলেন, বাংলায় কি সব স্কুল বন্ধ হয়ে যাবে! বাংলায় কি স্কুল আর চলবে না! টিচারের চাকরি কি আর হবে না! তিনি বলেন,ইচ্ছা সত্বেও কর্মসংস্থান করা যাচ্ছে না। আমার হাতে এখনো সরকারি দপ্তরের দশ লক্ষ বাড়তি চাকরি আছে। শুধুমাত্র কোর্টে গেলেই আটকে দিচ্ছে । তিনি শিক্ষকসমাজ ও সরকারি কর্মচারীদের বিজেপিকে একটা ভোটও না দেওয়ার আর্জি জানান।
তিনি কোর্ট প্রসঙ্গে অভিযোগের সুরে বলেন, বিজেপির একটা মহা তীর্থকেন্দ্র। এবং সেখানে বিজেপি পিল করলেই একেবারে যা বলবে, তাই । আর অন্য কেউ যদি বিচার চায়, তাদের জন্য দরজা বন্ধ। কোনো বিচার পাবেন না। বলেন, ডাকাতদের বেল দিয়ে দিচ্ছে। মাফিয়াদের বেল দিয়ে দিচ্ছে। নাম না করে এ প্রসঙ্গে শুভেন্দু অধিকারীর(!) বিরূদ্ধে সোচ্চার হয়ে বলেন,আর সবচেয়ে বড় গাদ্দার,যে গাদ্দারী করেছে তার বিরুদ্ধে মাডারের কেস থাকা সত্ত্বেও তাকে বলছে, তাকে নাকি অ্যারেস্ট করা যাবে না! এটা কি আইন? আমিও আইনের ছাত্রী ছিলাম।
তিনি নাগরিকত্ব , ক্যা , এনআরসির বিষয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানান। বলেন, গাদ্দাররা বলছেন এন আর সি করবোই। আমি বলছি হবে না। তাহলে কি করতে হবে? বিজেপিকে বিদায় দিতে হবে। আমরা সবাই নাগরিক আমাদের ভোটে প্রধানমন্ত্রী জিতেছিলেন। আমাদের ভোটে আমি জিতেছিলাম। আর আজকে আপনাদের নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে হচ্ছে!
তিনি আত্মবিশ্বাসের সাথে বলেন, মানুষ কিন্তু ওদের সাথে নেই ।এটা মাথায় রাখবেন, আমরা লড়াই করে বাঘের বাচ্চার মত বাঁচি। যতই অত্যাচার করুক, আমরা মনে করি সব মানুষ সব ধর্ম পালন করবে নিজের নিজের মতো করে। এদিনের সভায় তিনি বিজেপির প্রচার নিয়ে কটাক্ষ করে বলেন, আজকে যে বিজেপি এসে বড় বড় কথা বলছে, আমার কাছে উত্তর চাইছে, আমি বলেছি তোরা আগে অপদার্থরা উত্তর দে। এটা আমার ইলেকশন নয়, এটা দিল্লির ইলেকশন। কিন্তু দিল্লির ইলেকশনে বিজেপিকে হারাতে হবে। তাই ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছি এত রৌদ্রে, এত ঝড়ে ,এত জলে বিজেপি যাতে একটাও সিট না পায়। এক একটা সিট আমাদের চোখের মনির মত রক্ষা করতে হবে। প্রচন্ড গরমের দাবদহ উপেক্ষা করে এদিনের সভায় হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্লোগান দেন, মোদী হটাও দেশ বাঁচাও, কখনো গলি গলি মে শোর হ্যায়/ বিজেপি চোর হ্যায়, কখনো এই বিজেপি আর না। তিনি এই প্রচন্ড গরমে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হেলিকপ্টারে প্রায় ৫০ ডিগ্রি তাপ উপেক্ষা করে মানুষের স্বার্থে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে কষ্ট করে ছুটে বেড়াচ্ছেন বলে জানান।