নারী শিক্ষার প্রসারে অক্সিজেন ম্যান

বাবলু হাসান, লস্কর দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা : সুন্দরবনের প্রত্যন্ত এলাকায় মহিলাদের কে অন্ধকার আচ্ছন্ন মৃত্যুপুরী থেকে তুলে এনে সুশিক্ষায়-শিক্ষিত করে গোড়ে তোলার প্রয়াসে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছেন। পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার গোসাবার বালি দ্বীপের বছর ৩২ এর সৌমিত্র মন্ডল। নদী বেষ্টিত বিপদ শঙ্কুল এই জায়গা। শহরে আসার একমাত্র ভরসা জলযান। তার উপরে আবহাওয়া খারাপ হলে গন্তব্যে পৌঁছানো মুশকিল হয়ে পড়ে। বিগত বছরে করোনা নামক মারণ ব্যাধি সারা বিশ্বকে গ্রাস করে ফেলেছিল। সেই সময়ে নিজের জীবন বিপন্ন করে কখনো অক্সিজেন সিলিন্ডার আবার কখনো বা ঔষধ, খাদ্য সামগ্রী নিয়ে পৌঁছে গিয়েছেন মুমূর্ষ রোগীর কাছে। নিজে একজন ডায়াবেটিস পেশেন্ট তারপরেও নিজের জীবনের তোয়াক্কা না করে বাই সাইকেলে মুমূর্ষ রোগীর বাড়িতে পৌঁছে গিয়েছেন। যে সময়ে মানুষজন গৃহবন্দি, সে সময়ে নিজ ও পরিবারের সদস্যদের কথা চিন্তা না করে সদা সর্বদা এই কাজে র্ব্রতী হয়েছিলেন। এই কাজে তাকে সঙ্গ দিয়েছিলেন আর কেউ নন সৌমিত্র মন্ডলের অর্ধাঙ্গিনী নবনিতা গায়েন।

    আর্থিক অনটনের মধ্যে বড় হয়েছেন তিনি। পড়াশোনা করতে দিনের পর দিন অন্যের বাড়িতে থাকতে হয়েছিল তাকে। কখনও আত্মীয়-স্বজনেরা তার পাশে দাঁড়িয়েছিল আবার কখনো শিক্ষকেরা। আর সেই কারণে অভাবের যন্ত্রণা ভালই বোঝেন সুন্দরবনের গোসাবা ব্লকের বালি দ্বীপের বাসিন্দা সৌমিত্র মণ্ডল।

    প্রতি বছর মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকের রেজাল্ট বের হলেই নিজের উদ্যোগে দুঃস্থ অথচ মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের খুঁজে বেড়ান এই যুবক। প্রকৃত দুঃস্থদের খুঁজে তাঁদের স্কুল-কলেজে ভর্তির ব্যবস্থা করেন তিনি। কখনও নিজে স্কুলের সঙ্গে ব্যক্তিগত ভাবে কথা বলে ভর্তির ফি মুকুবের চেষ্টা করেন। কখনও সোশ্যাল মিডিয়ায় এই সমস্ত দুঃস্থদের জন্য সাহায্যের আবেদন জানিয়ে পোস্ট করতে দেখা গেছে সৌমিত্রকে। তাঁর আবেদনে কেউ সাড়া দিলে সরাসরি স্কুল বা ওই দুঃস্থ পড়ুয়াদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নম্বর দিয়ে সেখানে সাহায্য পাঠাতে অনুরোধ করেন এই যুবক।এ ভাবেই গত কয়েক বছরে সুন্দরবনের গোসাবা ব্লকের দুঃস্থ মেধাবী পড়ুয়াদের অন্যতম ভরসা হয়ে উঠেছেন তিনি। এ বছর এখন পর্যন্ত ৩৯ জন দুঃস্থ পড়ুয়া, যারা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে ভাল ফল করেছে, তাঁদের স্কুলে ভর্তির ব্যবস্থা করেছেন সৌমিত্র। সুন্দরবনের গোসাবা ব্লকের সাতজেলিয়া, মোল্লাখালি, কচুখালি, সোনাগাঁ সহ বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে দুঃস্থ ও মেধাবী পড়ুয়াদের পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি। সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁর কথা শুনেই দুঃস্থ পড়ুয়াদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছেন উওর চব্বিশ পরগনার বাসিন্দার সেখ খালেকের মতো বহু স্বহৃদয় ব্যাক্তি সহ একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। এ ছাড়াও, বালি দ্বীপের নিজ জমিতে তিনি গড়ে তুলেছেন ‘ নোনা দ্বীপের পাঠশালা ‘ নামে একটি অবৈতনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যেখানে ৪০ জন ছাত্রীদের বিনামূল্যে পড়ান তিনি। তাই এই উদ্যোগে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বনগাঁ নির্ভয়া ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন নামে এক সেচ্ছাসেবী সংগঠন। সংগঠন টি প্রতিমাসে একজন শিক্ষিকার বেতন ভার বহন করে চলেছেন। ছোটবেলায় গোসাবার বাড়ি ছেড়ে ক্যানিংয়ে এক আত্মীয়ের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করেছেন সৌমিত্র। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পরে সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ভূগোলে অনার্স নিয়ে পড়েছেন। বিএড পাশ করেছেন। নিজের শিকড়ের টান অনুভব করে পড়াশোনা শেষে নিজের গ্রামে ফিরে আসেন এই যুবক। গোসাবার বালি দ্বীপের সত্যনারায়নপুর বিবেকানন্দ বিদ্যাভবনে শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা করে চলেছেন সৌমিত্র । এসবের পরও গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন সমাজসেবা মূলক কাজ করে চলেছেন। আর এই সব কাজ করতে মূলত সোশ্যাল মিডিয়াই তাঁর অন্যতম ভরসা বলে জানালেন।

    সৌমিত্র বলেন, ‘‘ছোট থেকেই আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব, শিক্ষকদের সাহায্যে পড়াশোনা করে বড় হয়েছি। পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না। তাই টাকার জন্য পড়াশোনা বন্ধের কষ্টটা আমি বুঝি। সে কারণেই সুন্দরবনের এই সব মেধাবী পড়ুয়া, যারা অর্থাভাবে স্কুল কলেজে ভর্তি হতে পারছে না, তাদের পাশে থাকার চেষ্টা করছি।’’এ সব ছাড়াও গোসাবা ব্লকের বিভিন্ন প্রান্তের বেশ কিছু পড়ুয়াদের বিনা পারিশ্রমিকে পড়ান সৌমিত্র। এ রকমই তাঁর এক ছাত্র মিলন মণ্ডল বলে,সৌমিত্রদার জন্য আমরা গর্ববোধ করি। উনি আমাদের বিপদে সব সময়ে পাশে দাঁড়ান।’’স্কুলে ভর্তি হওয়ায় জন্য আর্থিক সাহায্য পেয়েছে মিতালী মণ্ডল, রিমি নস্কররা। তাদের কথায়, কী ভাবে স্কুলে ভর্তি হব বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু এই দাদা আমাদের স্কুলে ভর্তির ব্যবস্থা করেছেন।’