|
---|
নতুন গতি নিউজ ডেস্ক,দক্ষিণ দিনাজপুরঃ প্রয়োজনীয় অতি বিরল B-Negative রক্তের অভাবে বিপন্ন রোগীর জীবন বাঁচাবার জন্য আটই আগস্ট,২০২০ তারিখে সম্পূর্ণ লক-ডাউনের দিনে নিজের বাসস্থান বালুরঘাট থেকে ১১০ কি.মি. দূরে রায়গঞ্জে ছুটে গিয়ে রক্তদান করে অনন্য নজির গড়লেন পেশায় এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক ও সমাজসেবী শ্রী বিভাস দাস।দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার সীমান্ত-শহর হিলির বাসিন্দা বিধবা এক গৃহবধূ শ্রীমতী মিলন সাহা। কিছুদিন আগে পড়ে গিয়ে কোমরে ও হাতে মারাত্মক চোট পান। চিকিৎসকের পরামর্শ মতো প্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্য পরীক্ষা-নিরিক্ষার পরে দেখা যায় তার কোমরের ও হাতের হাড় মারত্মকভাবে ভেঙে গেছে। কয়েকদিন স্থানীয় এবং জেলা হাসপাতালের চিকিৎসকদের চিকিৎসায় কাঙ্খিত সাফল্য না মেলায় হতাশাগ্রস্ত তাঁর ছেলে ও মেয়ে তাঁকে নিয়ে রায়গঞ্জের স্বনামধন্য অস্থি শল্য চিকিৎসক শ্রী অনিন্দ্যসুন্দর সরকারের কাছে নিয়ে গেলে আবার একপ্রস্থ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে উক্ত চিকিৎসক জানান। রোগীর কোমরে ও হাতে একাধিক অস্ত্রোপচার করা ছাড়া অন্য কোনও গতি নেই। অস্ত্রপোচারের জন্য রোগীকে রক্ত দিতে হবে। তাঁর রক্তের গ্রুপ অতি বিরল B-Negative! রোগীকে তাঁর আনুসঙ্গিক অন্যান্য শারীরিক সমস্যার জন্য প্রয়োজনীয় ঔষধপত্র দেওয়া হয়। রোগীর শরীরের রক্তে শর্করার মাত্রা বেশি থাকায় অস্ত্রোপচারের আগে সেই শর্করার মাত্রা কমিয়ে আনা একান্ত আবশ্যিক হওয়ায় তার জন্য অন্য চিকিৎসকদের সঙ্গে আলোচনা করে ঔষধপত্রাদি গ্রহণের পরামর্শ দেন অস্থি শল্য চিকিৎসক ডাঃ অনিন্দ্যসুন্দর সরকার।
এরপরে রোগীর ছেলে এবং মেয়ে রক্তের সন্ধান করতে থাকেন। কিন্তু ঐ অতি বিরল B-Negative রক্ত না পাওয়ায় রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে নানান জায়গায় ছোটাছুটি করে বিফল হওয়ায় হাল ছেড়ে দেবার প্রাক মূহুর্তেই কোনও এক সূত্রে সংবাদ পেয়ে সমাজসেবামূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত ত্রিমোহিনীর এক প্রাথমিক শিক্ষক শ্রী গোপাল রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। গোপালবাবু তখন রক্তদান আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত এবং মানুষের বিপদে আপদে সর্বদাই ঝাঁপিয়ে পড়ায় অভ্যস্ত B-Negative রক্তধারী কুশমণ্ডি ব্লকের বেড়ল এফ.পি. স্কুলের প্রধানশিক্ষক বালুরঘাটনিবাসী শ্রী বিভাস দাসের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে বিষয়টি জানিয়ে ঐ রোগীর মেয়ে মৌমিতা সাহার ফোন নম্বর দিয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে সাহায্য করতে বলেন। জনসেবামূলক নানান কাজকর্মে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত বিভাস দাস সঙ্গে সঙ্গে মৌমিতাদেবীর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে জানান যে, তিনি গত চৌঠা মে, ২০২০ তারিখে এক কর্কট রোগাক্রান্ত রোগীর জন্য দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা হাসপাতালে রক্তদান করেছেন, তাই তিন মাস অতিক্রান্ত না হওয়ায় রক্তদানের নিয়মানুসারে তিনি এই মুহূর্তে রক্তদানের জন্য উপযুক্ত নন।
এই বার্তায় অন্য কোথাও এই বিরল গ্রুপের ইচ্ছুক রক্তদাতার সন্ধান না পেয়ে মাথায় আকাশ পড়ে বিপন্ন ঐ রোগীর পরিবার-পরিজনেদের মাথায়। তখন বিভাসবাবু নিজেও তাঁর সংগ্রহে থাকা বেশ কয়েকজন ঐ গ্রুপের রক্তধারী ব্যক্তির সঙ্গে ফোন মারফৎ যোগাযোগ করেও এই করোনার আবহে কাউকেই রক্তদানের জন্য রায়গঞ্জে যেতে রাজি করাতে পারেননি। রোগীর পরিবারের অনুরোধে বিভাসবাবু জানান যে রক্ত-সংগ্রহ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত চিকিৎসক সামগ্রিক সঙ্কটময় পরিস্থিতি ও রোগীর জীবন বাঁচাবার জরুরী স্বার্থে স্পেশাল অনুমতি দিলে গত রক্তদানের তিন মাস পূর্ণ হবার সামান্য কয়েকদিন বাকি থাকলেও রক্ত দিতে তাঁর নিজস্ব কোনও আপত্তি নেই। যথারীতি জেলা হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত চিকিৎসক ডাঃ রমিত দে মহাশয়ের সঙ্গে তিনি নিজেই ফোনে যোগাযোগ করে নির্দিষ্ট সময়ের মাত্র কয়েকদিন আগেই রোগীর জীবন বিপন্নতা ও রক্তের দুষ্প্রাপ্যতা বিবেচনা করে রক্তদান করবার অনুমতি চাইলে ঐ চিকিৎসক তাঁকে সুনির্দিষ্ট সময়সীমার আগে রক্ত দিতে কঠোরভাবে বারণ করে দেন। এই কথা জেনে ঐ রোগীর পরিবারের লোকজন আবারও অন্যত্র রক্তদাতার সন্ধান করে ব্যর্থ হয়ে আবার বিভাসবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
ইতিমধ্যে বেশ সময় অতিবাহিত হওয়ায় রোগীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। এমতাবস্থায় ডাঃ অনিন্দ্যসুন্দরবাবু রোগীর পরিবারের সম্মতিতে প্রয়োজনীয় রক্তের অভাবেও ঝুঁকি নিয়েই প্রথম অস্ত্রোপচার করেন ও সাফল্যলাভ করেন, এবং জানিয়ে দেন দুই একদিন দেরি হলেও ঐ B-Negative রক্তের একাধিক ইউনিট হাতে না মজুত না পেলে দ্বিতীয় অস্ত্রোপচার করা কখনওই সম্ভব নয়। ফলে কিছুটা স্বস্তিপ্রাপ্ত রোগীর পরিজন আবার বিভাসবাবুর স্মরণাপন্ন হন। এর মধ্যেই ছয় ও সাতই আগস্ট,২০২০ তারিখে স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য চাল,আলু ইত্যদি বিতরণের কাজ এসে যাওয়ায় এই দুই দিন প্রধানশিক্ষক বিভাসবাবু স্কুলের কাজে ব্যস্ত থাকবেন বলে ইচ্ছে থাকলেও রায়গঞ্জে গিয়ে রক্ত দিতে পারছেন না।
জীবন-সঙ্কটকালে রোগীর জীবন বাঁচাবার তাগিদে রোগীর পরিজনদের জানিয়ে দেন যে, স্কুলে দুই দিন চাল আলু বিতরণের পরে বাকি শিক্ষার্থীদের বিতরণের কাজ ফেলে রেখেই আটই আগস্ট, ২০২৯০ তারিখে রক্তদানের জন্য যে ভাবেই হোক তিনি রায়গঞ্জে যাবেন। ঐ দিন আবার রাজ্য-জুড়ে সম্পূর্ণ লক-ডাউন। কিন্তু তার মধ্যেই বিভাসবাবু ঠিক পৌঁছে যান রায়গঞ্জের উপশম নার্সিংহোমে ভর্তি থাকা ঐ রোগীর কেবিনে। অবশেষে হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন রোগীর পরিবার। রোগীর পরিজন যথারীতি তৎক্ষনাৎ বিভাসবাবুকে নিয়ে রায়গঞ্জ হাসপাতালের রক্ত-সঞ্চয় বিভাগে নিয়ে যান। বিভাসবাবু হাসিমুখে রক্তদান করে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে সেই রক্ত হাসপাতালের রক্ত-সঞ্চয় বিভাগ থেকে উপশম নার্সিংহোমে পৌঁছানো পর্যন্ত রোগীর পরিবারের সঙ্গে থেকে তাঁদের আশ্বস্ত করে বালুরঘাটের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। রক্ত হাতে পাবার পরেই সেইদিন বিকেলেই ডাঃ অনিন্দ্যসুন্দর সরকার রোগীর দেহে সফলভাবে দ্বিতীয় অস্ত্রোপচার করেন। দীর্ঘ টানাপোড়েন ও দুশ্চিন্তাবসানে রোগীর পরিবারের মুখে ফুটে ওঠে স্বস্তির স্বর্গীয় হাসি। এই ব্যাপারে বিভাসবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান যে, এই রকম ব্যাপারে তিনি সর্বদাই শশব্যস্ত হয়ে রক্তদানের উদ্দেশ্যে ছুটে যান কাছাকাছি যে কোনও হাসপাতালের রক্ত-সঞ্চয় বিভাগে।
রক্তদানের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন সংগঠনে, হাসপাতালের রক্ত-সঞ্চয় বিভাগে তাঁর ফোন নম্বর দিয়ে রাখা ছাড়াও মাঝেমধ্যেই ফেসবুকের সোসাল মিডিয়াতেও রক্তদানের ইচ্ছা প্রকাশ করে সবাইকে অবহিত করেন। আগামী নভেম্বর মাসের শেষে একজন মহিলার সন্তান জন্মদানের সময় তাঁর প্রয়োজনে ঐ বিরল B-Negative রক্ত দেওয়ার অঙ্গীকার করে রেখেছেন। প্রায়শই তিনি এইরকম অগ্রিম বুকড হয়েই থাকেন। বালুরঘাটে অবস্থিত জেলা হাসপাতালে একাধিকবার রক্তদান করা ছাড়াও তিনি এর আগে মালদহ হাসপাতালেও ছুটে গিয়েছেন রক্তের অভাবে সঙ্কটাপন্ন রোগীর প্রয়োজনে রক্তদানের জন্য। রোগীর পরিবার তাঁর ভূমিকার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেও বিভাসবাবু বলেন এটা তাঁর কাছে বিশেষ কোনও ব্যাপারই নয়, তিনি এই রকম কাজে বেশ অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। তিনি শুধুমাত্র নিজ দেহের রক্তদানের মাধ্যমেই থেমে না থেকে ঐ রোগীর প্রয়োজনে আরও একজন রক্তদাতার সন্ধানে তৎপর হয়ে নানাস্থানে যোগাযোগ করে চলেছেন।