|
---|
নতুন গতি নিউজ ডেস্ক। দু’টি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নম্বরের মধ্যে মাত্র দুই অঙ্কের মিল। এই মিলকে কাজে লাগিয়েই একটি বেসরকারি লজিস্টিক সংস্থার একজন ‘ডেলিভারি বয়’ সংস্থার বদলে নিজের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে চালান করেছিল দেদার টাকা। এইভাবে প্রায় এক কোটি টাকা সরানোর পর চাকরি ছেড়ে গা ঢাকা দিয়েছিল সে। সংস্থার কেউ ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি এই জালিয়াতি। অবশেষে কলকাতা পুলিশের অ্যান্টি ফ্রড সেকশনের হাতে ধরা পড়েছে অভিযুক্ত যুবক।
ঘটনাক্রম এরকম। গত ৩০ মে গিরিশ পার্ক থানায় একটি অভিযোগ জমা পড়ে। ‘ডেলিভারি প্রাইভেট লিমিটেড’ নামের একটি লজিস্টিক সংস্থার একজন উচ্চপদস্থ আধিকারিক জানান, তাঁদের সংস্থার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে মোট ৯২,৯৫,০০০ টাকা অন্যত্র সরিয়ে ফেলেছে কোনও অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি। এই সংস্থার মাধ্যমে অ্যামাজন, জিয়াওমি, পেটিএমের মতো বিভিন্ন ই-কমার্স কোম্পানির পণ্য ডেলিভারি করা হয়ে থাকে। গ্রাহকদের দেওয়া টাকা জমা হয় সংস্থার নির্দিষ্ট ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। সেই অ্যাকাউন্ট থেকে কীভাবে এত টাকা গায়েব হয়ে গেল, ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছিলেন না সংস্থার আধিকারিকরা।
এই কেসের তদন্তভার দ্রুত ন্যস্ত হয় কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের অ্যান্টি ফ্রড সেকশনের উপর। সাব-ইনস্পেকটর সুরজিৎ বণিকের নেতৃত্বে অ্যান্টি ফ্রড সেকশনের বিশেষ টিম প্রথমেই ওই সংস্থার কর্মীদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সংক্রান্ত বিভিন্ন নথিও খতিয়ে দেখা শুরু হয়। দেখা যায়, সংস্থার অফিসে জমা হওয়া বেশ কিছুব্যাঙ্ক স্টেটমেন্টে যে অ্যাকাউন্ট নাম্বার দেওয়া রয়েছে, তার শেষ চারটি অঙ্কের দু’টি অঙ্ক খুবই আবছা। অনলাইন লেনদেনের ক্ষেত্রে ইমেল বা মোবাইল ফোনে যে মেসেজ যায়, তাতে শুধু ব্যাংক অ্যাকাউন্টের শেষ ৪টি অঙ্কই উল্লেখ করা থাকে। নিরাপত্তার কারণে ‘X’ চিহ্ন দেওয়া থাকে বাকি অঙ্কগুলোর জায়গায়। এই ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্টগুলিতে শেষ চারটি অঙ্কের শুধু মাঝের দু’টি অঙ্ক ৮২। যা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু, তার আগের এবং পরের অঙ্ক দু’টি এমনই আবছা যে সেগুলো পড়াই যাচ্ছিল না। কেউ যে ইচ্ছে করেই ঘষে এগুলিকে আবছা করে দিয়েছে, সেটা বুঝতে পারছিলেন তদন্তকারী অফিসারেরা।
দ্রুত সংস্থার সমস্ত কর্মচারীর ব্যক্তিগত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুঁটিয়ে দেখা শুরু হয়। তখনই নজরে আসে, শুভঙ্কর দাস নামে সংস্থার এক প্রাক্তন ডেলিভারি বয়ের অ্যাকাউন্ট নম্বরেও শেষ চার অঙ্কের মধ্যে ৮২ রয়েছে, যেমন ছিল সংস্থার অ্যাকাউন্টে। তদন্তকারী অফিসারেরা জানতে পারেন, বেশ কয়েকদিন আগে নিজে থেকেই চাকরি ছেড়ে দিয়েছিল শুভঙ্কর। চাকরি ছাড়ার পর সে কী করে, কোথায় থাকে, তা জানাতে পারেননি সংস্থার কেউই। কারও সঙ্গেই যোগাযোগ রাখেনি আর। পাল্টে ফেলেছিল মোবাইল নম্বরও।
শুভঙ্করের খোঁজ শুরু হয়। খবর দেওয়া হয় সোর্সদের। সাহায্য নেওয়া হয় প্রযুক্তিরও। গত ৬ আগস্ট, বিকেল ৩.৪০ নাগাদ হুগলীর চণ্ডীতলা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় শুভঙ্করকে। সেখানে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে গা ঢাকা দিয়েছিল সে।
জেরার মুখে অভিযোগ স্বীকার করে নেয় শুভঙ্কর। পরিপাটি চিত্রনাট্য সাজিয়েছিল জালিয়াতির। পণ্য ডেলিভারি দেওয়ার পর গ্রাহকদের থেকে যে টাকা নিত সে, তা সংস্থার অ্যাকাউন্টে জমা করার বদলে নিজের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা করত শুভঙ্কর।
কিন্তু সংস্থায় তো ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট জমা দিতে হয়। সেখানেই ছিল আসল খেলা। সংস্থায় স্টেটমেন্ট জমা দেওয়ার সময় ৮২-র আগের ও পরের দুটি অঙ্ক ঘষে তুলে দিত শুভঙ্কর, যাতে কেউ সন্দেহ না করে। তাড়াহুড়োর মধ্যে কেউ অত খুঁটিয়েও দেখত না। দেখলেও ভাবত, ঘষা লেগে উঠে গেছে কোনওভাবে। এইভাবে সংস্থার টাকা যে নিজের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে চালান করে দেওয়া যায়, ভাবতেই পারেনি কেউ। ফলে সন্দেহও হয়নি।
এভাবেই ২০১৮-র জানুয়ারি থেকে একটু একটু করে মোট ৯২,৯৫,০০০ টাকা হাতিয়ে নিয়েছিল শুভঙ্কর। জালিয়াতির টাকা প্রথমে নিজের অ্যাকাউন্টে রেখে তারপর বেশ কয়েকটি ভুয়ো অ্যাকাউন্টে তা সরিয়ে ফেলত। এটিএম থেকে তারপর তুলে নিত টাকা। প্রায় কোটি টাকা টাকা হাতানোর পর চাকরি ছেড়ে দিয়েছিল শুভঙ্কর।
তদন্ত এখনও চলছে। এই জালিয়াতির ঘটনায় শুভঙ্করের সঙ্গে আর কেউ যুক্ত ছিল কিনা, খতিয়ে দেখা হচ্ছে তা-ও।