|
---|
বিশেষ প্রতিনিধি, মেদিনীপুর : প্রিয়শ্রীর স্মৃতি বেঁচে থাকবে ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে। সফলভাবেই কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল তাঁর। সুস্থ হয়ে উঠছিলো ক্রমশঃ। এরই মাঝে কালান্তক ডেঙ্গু কেড়ে নেয় ছোট্ট প্রিয়শ্রী জানার চনমনে জীবন। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ২০১৮-২০ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী ছিল সে। সেই প্রিয়শ্রীর চিকিৎসার জন্য অতিরিক্ত যে টাকা ‘মেদিনীপুর ছাত্র সমাজ’ জোগাড় করেছিল, সেই টাকা তাঁর গ্রামের পিন্ডরুই কে আই বিদ্যানিকেতনের প্রধান শিক্ষক কনিষ্ঠ সিনহার হাতে তুলে দিলো অবশেষে। আগামী ভবিষ্যতের ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যেই বেঁচে থাকবে প্রিয়শ্রী। এ এক অভিনব উদ্যোগ। মানবতার অপূর্ব দৃষ্টান্ত।
ঐ অর্থ থেকে প্রতি বছর যে সুদ পাবে, তা থেকে প্রতিটি ক্লাসের ইংরেজী বিষয়ের সর্বোচ্চ প্রাপককে “প্রিয়শ্রী স্মৃতি পুরষ্কার” দেওয়া হবে। বিদ্যালয়ের বুকলিস্টে পরের বছর দাতা ‘মেদিনীপুর ছাত্র সমাজ’ এর কথা উল্লেখ থাকবে। প্রতি বছর রবীন্দ্র জয়ন্তী অনুষ্ঠানে পুরষ্কার প্রদানের সময় এই পুরস্কার দেওয়া হবে।
গত ২৪ শে জুন ২০১৯ এ মারা গিয়েছিল প্রিয়শ্রী। দুটো কিডনিই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল তাঁর। বেঙ্গালুরুতে অপারেশন হয়েছিলো। পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলা থানার পিন্ডরুই গ্রামে বাড়ি। পড়া চলাকালীন পোষ্ট অফিসের গ্রামীন ডাকসেবকের পরীক্ষা দিয়েছিল। সেই চাকরি নিয়োগপত্র কিছুদিন আগে এসেছিল। কিন্তু আজ সে নেই।
মেদিনীপুর ছাত্র সমাজের সভাপতি কৃষ্ণগোপাল চক্রবর্তী জানান, প্রথমে এই প্রিয়শ্রীর চিকিৎসার জন্য রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করে এবং শুভানুধ্যায়ীদের থেকে ১,৬৩০০০ টাকা দিয়েছিলো মেদিনীপুর ছাত্র সমাজ। আর কেউ একটি পয়সাও দেয়নি প্রিয়শ্রীর জন্য। তবুও আরো অতিরিক্ত কুড়ি হাজার টাকা জমা হয়েছিলো প্রিয়শ্রীর চিকিৎসার জন্য। কিন্তু মারা যাওয়ার দরুন সেই টাকা প্রিয়শ্রীর স্মৃতিতে তাঁর গ্রামের স্কুলকে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের লক্ষ্য ‘ঐক্য সেবা শান্তি’। কোনও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করিনা। যেখানে সাধারণ মানুষের সাহায্যের প্রয়োজন পড়ে, সেখানেই ছুটে যায় মেদিনীপুর ছাত্র সমাজ।
আজ প্রিয়শ্রীকে মানুষের মননে বাঁচিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর প্রিয়শ্রীর এই অজানা অচেনা দাদা দিদিরা। প্রিয়শ্রীর বাবার অরুন জানা বলেন, মেদিনীপুর ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে অনেক চেষ্টা করলেও বাঁচানো যায়নি মেধাবী প্রিয়শ্রীকে। এঁদের বাইরে আর কোনো সংগঠন বা মানুষ প্রিয়শ্রীর চিকিৎসার জন্য এগিয়ে আসেনি তখন। প্রিয়শ্রীর মা নিজের একটা কিডনি দিয়েও মেয়েটাকে বাঁচাতে পারলো না।
এর আগে ক্যান্সার আক্রান্ত সবং থানার অন্তর্গত কক্তিপুর গ্রামের সুখেন্দু ভক্তের পাশে দাঁড়ানোর সাহস দেখিয়েছে ‘মেদিনীপুর ছাত্র সমাজ’। এই সুখেন্দুকে বাঁচানোর তাগিদেই এই অরাজনৈতিক সংগঠনের পথচলা শুরু হয়। সে সময় প্রায় ২.৫০ লাখ টাকা তুলে দেওয়া হয় তাঁর বাবা নিশিকান্ত ভক্তের হাতে। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গনিত বিভাগের পড়ুয়া ছিল সুখেন্দু।
মেদিনীপুর ছাত্র সমাজের সম্পাদক রাজকুমার বেরা জানান, একসময় মেদিনীপুর কলেজের ভূগোল অনার্সের ছাত্রী মৌমিতা মান্নার ক্যান্সারের চিকিৎসায় প্রায় ১.৫০ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছিল মেদিনীপুর শহরের গনপতি বসু নাগরিক মঞ্চ থেকে। এরপর কেশিয়াড়ির দশ বছরের শিশু অনির্বাণ ঘোষের ব্লাড ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্যও অর্থ সহায়তা করেছিলো তাঁদের এই সংগঠন। এছাড়া কেশপুরের মলয় ঘোষ এবং ঘাটালের সঞ্জীব ভুঁইয়ার ক্যান্সারের চিকিৎসায় অর্থ সহায়তাতেও তাঁরা মানবিকতার পরিচয় দিয়েছে। কেশপুরের স্কুল ছাত্র অপু চক্রবর্তী, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র ঘাটালের তাপস শাসমল, ক্যান্সার আক্রান্ত শিখা শীট, কিডনির সমস্যায় জর্জরিত শেখ আক্রামকে অশোকনগর থেকে অর্থ তুলে দেওয়া হয়েছিল।
চলতি কোরোনা উদ্ভুত লক ডাউন পরিস্থিতিতে এবং আমফান ঝড়ঝঞ্ঝাতে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের পাশেও বারবার ত্রাণসামগ্রী নিয়ে ছুটে গিয়েছে মেদিনীপুর ছাত্র সমাজের কৌশিক কঁচ, অনিমেষ প্রামানিক, আগন্তুক ঘোড়াইরা। কখনও জঙ্গলমহলের খেড়িয়া শবরদের বাড়িতে, আবার কখনও সুদূর সুন্দরবনের জল জীবন জঙ্গলে জীবন বরবাদ হওয়া মানুষগুলোর কাছে। রক্ত মাংসের এই সদস্যরাই আজ বেঁচে রয়েছে প্রিয়শ্রী থেকে শেখ আক্রামের পরিবারের সদস্যদের মনে।