অশিক্ষার অন্ধকার দূর করতে ‘দুয়ারে পাঠশালা’ নিয়ে হাজির দুই শিক্ষক

নিজস্ব সংবাদদাতা, নতুন গতি, পশ্চিম মেদিনীপুর: স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়টি পাড়া থেকে বড়জোর আটশো মিটার দূরে অবস্থিত।তবুও এই পাড়াতে এখনও সেভাবে আসেনি পড়াশোনার চল। বাসিন্দা সংখ্যা একশো পেরোলেও সেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণির গণ্ডি টপকেছে মাত্র একজন। এবার সবং ব্লকের সেই স্কুলবিমুখ বাগালপাড়াতেই ‘দুয়ারে পাঠশালা’ নিয়ে হাজির হলেন দুই শিক্ষক। সবংয়েরই চাঁদকুড়ির বাসিন্দা শিক্ষক শান্তনু অধিকারী ও পূর্ব মেদিনীপুরের হাউরের বাসিন্দা শিক্ষক ভাস্করব্রত পতি।

    সবংয়ের দাঁররা গ্রাম পঞ্চায়েতের খোলাগেড়্যা মৌজার সেই বাগালপাড়ায় অফুরন্ত মদের জোগানে শৈশব সেখানে নেশায় ডুবে । নাবালক অবস্থাতেই বিয়ে, সন্তান ধারণ এখানকার চিরাচরিত রীতি নীতি। রয়েছে তুমুল অভাব এবং বঞ্চনা। অশিক্ষার গাঢ় অন্ধকারে নিমজ্জিত এখানকার প্রায় সকলেই। বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা আর দিনমজুরিই উপার্জনের একমাত্র উপায় হলেও রোজগারের সিংহভাগই চলে যায় নেশার পেছনে। সারা পাড়াতেই নেই বিদ্যুৎ সংযোগ। এর পাশাপাশি রয়েছে স্থানীয় লোকজনদের বিরুদ্ধে শ্রমশোষণের মতো গুরুতর অভিযোগও।
    বুধবার মহালয়ার দিনে এই দুই বন্ধুর ব্যবস্থাপনায় ২৮ জন পড়ুয়া নিয়ে ‘বর্ণপরিচয়’ নামে এই পাঠশালাটির সূচনা ঘটলো। উদ্দেশ্য, এখানকার শৈশবকে স্কুলমুখী করে তোলা। এবং অক্ষরজ্ঞানহীন বড়দেরও স্বাক্ষর করে সামাজিক চেতনার বিকাশ ঘটানো। এদিন, হাতে খাতা, কলম, বই তুলে নিয়ে দেবীর আরাধনাও করল এখানকার শিশুরা। তবে কোনও প্রথাগত মন্ত্রোচ্চারণে নয়। দেবী দুর্গার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে মাটির ঘটে জলসিঞ্চন করে শপথবাক্য পাঠের মাধ্যমে।
    উদ্যোক্তাদের অন্যতম, পূর্ব মেদিনীপুরের বাসিন্দা ভাস্করব্রত পতি জানান, ‘শিক্ষাই পারে এখানকার বাসিন্দাদের প্রকৃত উন্নয়নের সরণীতে নিয়ে যেতে। নিজেদের অধিকারবোধ সম্পর্কে সচেতন করতে। মুষ্টিমেয় ত্রাণ কখনও সমস্যার সমাধান করতে পারে না। পরিত্রাণের পথ খোঁজাই আসল। তাই এই উদ্যোগ’। তিনি জানান, ‘এই পাঠশালা আপাতত সপ্তাহে চারদিন চলবে। জোর দেওয়া হবে খেলাচ্ছলে পড়াশোনায়। রয়েছে পুজোর পরে এখানকার শিশুদের নিয়ে একটি শিক্ষামূলক ভ্রমণের পরিকল্পনাও’।

    প্রসঙ্গত শিক্ষক শান্তনু অধিকারী বিগত কয়েক বছর ধরেই এখানকার বাসিন্দাদের নিয়ে কাজ করে আসছেন। তিনি বলেন “এই বাগালরা আসলে খেড়িয়া শবর। এঁদের প্রকৃত পদবি বাগাল নয়, দেহরি। স্বভাবগত কারণেই এঁরা ভীতু ও মুখচোরা। সভ্যতাবিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে ভালোবাসেন। ভোটার লিস্টে নাম তোলার সময়ই ঘটে গেছে পদবি বিভ্রাট। যে কারণে আজও তাঁদের মেলেনি তপশিলি উপজাতির স্বীকৃতি। ফলে এঁরা বঞ্চিত হচ্ছেন নানা ধরনের সরকারি সুবিধা থেকেও”। তিনি আরও বলেন, ‘কেবল পাঠশালা নয়। আগামীদিনে এঁদের নানা ধরনের সরকারি প্রকল্পের সুবিধা পাইয়ে দিতে প্রশাসনিক স্তরেও কাজ করবে বর্ণপরিচয়’।
    এদিন বর্ণপরিচয়ের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় এই পাড়ারই আশিঊর্ধ্ব দেবেন বাগালের হাত ধরে। তাঁর হাত দিয়েই লাগানো হয় স্মারকস্বরূপ একটি ফলের চারা। এদিন পড়ুয়াদের দেওয়া হয় নতুন পোশাক। সেই সঙ্গে যাবতীয় শিক্ষা ও অংকন সামগ্রী। দেওয়া হয় খেলধুলার সরঞ্জামও। এদিন এই উদ্বোধন উপলক্ষে পাড়ার সকলের জন্য প্রীতিভোজেরও ব্যবস্থা করেন দুই শিক্ষক। এঁরা ছাড়াও এদিনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য মনোরঞ্জন রায়, কমল রায়, নিখিল কুইল্যা এবং বর্ণপরিচয়ের শিক্ষিকা প্রিয়াংকা ভূঞ্যা প্রমুখ। বর্ণপরিচয়ের জন্ম হল বাগালপাড়ায়। বর্ণপরিচয়ের হাত ধরে বাগালপাড়ার পুনর্জন্ম হয় কিনা, এখন সেটাই দেখার!