|
---|
সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়
মে দিবস তার তাৎপর্য হারাচ্ছে। কোভিড ১৯ এর আতঙ্কে মানুষ যখন দিশাহারা, তখন তাকেই প্রেক্ষিত করে বিভিন্ন রাজ্য দিনে আট ঘন্টার শ্রমের বদলে ১২ ঘন্টা বা সপ্তাহে ৪৮ ঘন্টা শ্রমের বদলে ৭২ ঘণ্টা কাজের নিয়ম করছে।রাজস্থান,গুজরাট,হরিয়ানা এই ব্যাপারে ১৯৪৮ সালের কারখানা আইন টি ইতিমধ্যে সংশোধন করে ফেলেছে।
সপ্তাহে ৪৮ ঘন্টার পরিবর্তে ৭২ এবং দিনে সপ্তাহে সর্বাদিক ৮ঘন্টার পরিবর্তে ১২ ঘন্টা কাজ করা এবং কাজ করানোটাই এখন আইন।এবং সেটা করার জন্য এখন সকলেই মুখিয়ে।কেউ শ্রমিকের অধিকার নিয়ে কথা বলবেনা। শুধু রাজনৈতিক স্লোগান তোলা হবে। রাজনৈতিক মুখপত্রে কিছু চর্বিত চর্বণ—- এই হল মে দিবসে আজকের তাৎপর্য ।
ব্রিটিশ উপনিবেশের সময় বিশ্বায়নের পুঁজির এতটা উদারনীতি ছিল না। তাই ঔপনিবেশিক পুঁজির বিরুদ্ধে শ্রমিক যখন নিজের অধিকার বুঝে নিতে মুখোমুখি ঘুরে দাঁড়ালো, সে পেরেছিল। এখন অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলন আর সংঘটিত হয় না।আমেরিকা থেকে ইউরোপের শতশত রাস্তায় হাজার হাজার শ্রমিক একযোগে মিছিল করলেও কেউ বলেনা কেন ৮ ঘণ্টার পরিবর্তে ১২ ঘণ্টা কাজ করব !! কারণ, সবাই এখন অদ্ভুতভাবে শোষণের যন্ত্রনা ভুলে উদারনীতি র ললিপপে ভোগবাদী সংস্কৃতিতে মজে আছে। আমাকে আমার মত থাকতে দাও আমি ডুবেছি ফেসবুকে আর হোয়াটসঅ্যাপে। কোন শ্রমিকের যূথবদ্ধ আন্দোলন নেই। সবাই সবাইকে টপকে এগিয়ে যেতে চায়।
তাই উনবিংশ শতাব্দীতে আন্দোলন, বিংশ শতাব্দীতে অধিকার প্রতিষ্ঠা শুধু হল আট ঘন্টাই কাজ , তার বেশি আর কিছু হলো না।
কোভিড ১৯ এর আতঙ্ক কে সামনে রেখে সব ধরনের সরকার কর্মীদের ওপরে বিভিন্ন রকমে শ্রম আইন এর সংস্কার আনছে। শ্রমিক কর্মচারীদের নিয়ে যে আইন ও রীতিনীতি চালু ছিলো এতদিন স্বাধীন ভারতে, সেটুকুও বজায় রাখা হচ্ছে না এখন। মোদি সরকারের প্রথম কাজ এখন যতগুলি বকেয়া সংস্কার রয়েছে বিভিন্ন মন্ত্রকে সেগুলি যত দ্রুত সম্ভব রুপায়ন করে ফেলা। তার জন্য শ্রমিকের অধিকার তাই সবার আগে সংকুচিত করে ফেলা প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে, নইলে আন্তর্জাতিক পুঁজি ক্ষুব্ধ হয়।
স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন গতকাল । গত বুধবারই মন্ত্রিসভার বৈঠক হলো। সেখানে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়েছে।লকডাউনের ফলে দেশে যে পরিমান অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ করার জন্য সংস্কারের গতি অবিলম্বে বাড়াতে হবে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে দ্রুত সংস্কারের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, যাতে আর ও বেশী পুঁজি বিনিয়োগ হয় ও উৎপাদন এবং কর্মসংস্থান বাড়ে। মজার কথা হলো,প্রতিটা সংস্কার শুরু করার আগেই এগুলো সরকারের তরফ থেকে বলা হয়,কিন্তু সত্যি ই কি লগ্নি বাড়ে?আর যে লগ্নি বাড়ে তার ভিত্তিতে লগ্নিকারির মুনাফা যতটুকু বাড়ে তার তুলনায় কতটুকু বাড়ে নতুন কর্ম সংস্থান!! সেসব কিছুই জানার দরকার নেই। এই করোনায় দীর্ঘ লকডাউনের পর এদেশের বেকারত্বের হার প্রায় ৩০ শতাংশে পৌঁছে গেছে।; তাই নিয়ে কেউ কথা বলবে?
এই দেশের অর্থনৈতিক উনতিকে সকলেই জবলেস গ্রোথ বলে ঘোষনা করেছে।তাই নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখেনা,যে নতুন লগ্নি হলেও তার লক্ষ্য বেকারত্ব মেটানো নয়। লক্ষ্য ব্যক্তিগত মুনাফা। বিকল্প ভাবনা যা ছিল তাতে খুব একটা আশার আলো নেই।
আর ও সমস্যা হচ্ছে বামদলগুলির ভূমিকা।তারাও এই সমস্ত উদ্যেগের কোনও বিরোধিতা করছে না। বরং বলা যেতে পারে ডান-বাম সকলেই চলতি হাওয়ার পন্থী। যে কেরল সরকারকে বামপন্থী সরকার বলা হয় তারাও এই অবস্থায় সরকারি কর্মচারী দের ২৫%হারে বেতন কেটে নেবার জন্য অর্ডিন্যান্স জারি করেছেন। এবং তারপর কর্মচারীরা শেষ পর্যন্ত হাইকোর্টের শরণাপন্ন হওয়ায়, হাইকোর্ট তার ওপর স্থগিতাদেশ দিয়েছে। একই ভাবে কেন্দ্রিয় সরকার আগামী জুলাই মাস পর্যন্ত মহার্ঘ ভাতার দেওয়ার ক্ষেত্রে স্থগিতাদেশ জারি করেছে।
বর্তমান শ্রমিকদের কাছে ডান বা বাম সকলেই সমান। কোনও পন্থার রাজনিতিক দলের বার্তায় কোনও পরিবর্তন কিছু নেই। দুজনের কাছেই শ্রমিকরা বিপন্ন। আজ এই মে দিবসে সবচাইতে বেশী প্রয়োজন ক্ষুদ্র ও মাঝারি মাপের সংস্থা, শিল্পগুলি বাঁচিয়ে রাখা।যারা সবচেয়ে বেশী কর্মীদের চাকরি দেয়। অসংগঠিত কর্মীদের ক্ষেত্রে সরকারের এই সংকটে কতখানি নিষ্ক্রিয় তা তাতো পরিষ্কার দেখাই যাচ্ছে। লকডাউন এর ৪০ দিন পরেও কোটি কোটি পরিযায়ী শ্রমিক বিভিন্ন জায়গায় আটকে আছে।আজকে মে দিবস যাদের নিয়ে তারাই জানেনা আগামী কাল কী খাবে!! সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্টানগুলোকে কর্মীদের চাকরি ছাটাই না করবার জন্য।কিন্তু বহু কম্পানী হাজার হাজার কর্মীকে ইতিমধ্যেই বসিয়ে দিয়েছে।বেতন তো কেউ কেউ অর্ধেক কিংবা যত সামান্য করে দিয়েছে।তার সাথে নো ওয়ার্ক নো পে ঘোষনা করেছে।সরকারের তরফ থেকে কর্মী সুরক্ষায় কোনও ব্যাবস্থা নেওয়া হয়নি। হচ্ছে ও না।
তাহলে সেই মহান মে দিবস আজ কোথায়??
মে দিবস উপলক্ষে এই কথা গুলি বলতে হচ্ছে আজ অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে। এই কথাগুলি বলবার জন্য যেসব শ্রমিক সংগঠন রাস্তায় লাল ঝান্ডা তুলে পথে নামবেন বলে ঠিক করেছিলেন, কোভিড ১৯ এর জন্য তাদের আজ গৃহ বন্দী থাকতে হল।আজকের পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত জরুরী কথা এটাই যে যেটুকু সাধারণ শ্রমিক কর্মচারীদের জন্য বাজেট থাকে বা রাজ্য গুলিকে যে টাকা দেওয়া হয়,সেটুকু ও এই শ্রমিক পরিবারগুলি বাস্তবে পায়না।২০০৯ সালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ ছিলো, নির্মাণ শ্রমিকদের জন্য । কিন্তু সেই নির্দেশ ও অমান্য করেই সরকার চলছে।কোনও ব্যাবস্থা নেওয়া হয়নি তাদের শ্রমিক কল্যাণ এর স্বার্থে। শীর্ষ আদালতের রায় রূপায়ণ করার জন্য কোনও উদ্যোগ সেভাবে নেওয়া হয়নি।কর্মী অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সংগঠন গুলির পক্ষ থেকে কোভিড ১৯ কে একটি বিশেষ অকুপেশনাল ডিজিস হিসাবে ঘোষনা করতে দাবি জানানো হয়েছে,যাতে কর্মীরা সামাজিক নিরাপত্তা পায় । কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্যের প্রশ্নে সরকারি সহায়তা পায়।কিন্তু কি রাজ্য কি কেন্দ্র কেউই এই ব্যাপারে কর্ণপাত করছে না।সরকারের নীতি গ্রহণ করার ক্ষেত্রে বরং উল্টোটাই হচ্ছে।কেন্দ্রিয় সরকারের পক্ষ থেকে শ্রমিকের পরিবর্তে কর্মদাতার সুবিধার্থে শ্রম আইন সংশোধন করা হচ্ছে। মালিক স্বার্থে তাকে আরও নমনীয় করে তোলার জন্য আরও ভাবা হচ্ছে। ইচ্ছা মতন ছাঁটাই ও প্রয়োজন মত বেতন কমিয়ে দেওয়ার অধিকার থাকছে মালিকের হাতে।এইগুলিকে সংস্কার করে সরকারের তরফ থেকে দাবী করা হচ্ছে, তারা উন্নয়নের কাজ করছে। এ কোন উন্নয়নের সংস্কার যা শ্রমজীবী মানুষের শ্বাস রোধ করে দেয়! মে দিবসের পরিপক্ষিতে তার শতবর্ষ পেরিয়ে যাবার এতদিন পরও শ্রমিকরা কোণঠাসা।কেন? কিসের তাহলে শ্রমিক আন্দোলন?? কিসের জিন্দাবাদ ধ্বনি?কোন মেহনতি মানুষের জন্য?! মেহনতী মানুষ তো আজ নিজেই বুঝি মুনাফার অংশীদার হওয়ার জন্য দৌড়চ্ছে!! আমায় একটু জায়গা দে , আমি যেন ম্যানেজমেনটের কৃপা পাই!!
তার কোথাও নিরাপত্তা নেই। সে জানে, শ্রমের বাজারে মানুষ এক সস্তা পণ্য!! বিশ্বায়নের এখনই এটাই শিক্ষা! কভিড কি ঘুরিয়ে দিতে পারবে অর্থনীতির চাকা এবার অন্য পথে?
আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন জানাচ্ছে,এই পৃথিবীর ৩৩০ কোটি শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে প্রতি 5 জনের মধ্যে চারজন হয় চাকরি হারাচ্ছে কিংবা তাদের বেতন কমে যাচ্ছে। দেখাযাক তাদের রিপোর্ট, ” Compared to pre-crisis levels (Q4 2019), a 10.5 per cent deterioration is now expected, equivalent to 305 million full-time jobs (assuming a 48-hour working week). The previous estimate was for a 6.7 per cent drop, equivalent to 195 million full-time workers. This is due to the prolongation and extension of lockdown measures.
Regionally, the situation has worsened for all major regional groups. Estimates suggest a 12.4 per cent loss of working hours in Q2 for the Americas (compared to pre-crisis levels) and 11.8 per cent for Europe and Central Asia. The estimates for the rest of the regional groups follow closely and are all above 9.5 per cent.
Informal economy impact
As a result of the economic crisis created by the pandemic, almost 1.6 billion informal economy workers (representing the most vulnerable in the labour market), out of a worldwide total of two billion and a global workforce of 3.3 billion, have suffered massive damage to their capacity to earn a living. This is due to lockdown measures and/or because they work in the hardest-hit sectors.”
এরপরেও মে দিবস পালিত হবে। স্লোগান চলতেই থাকবে শুধু “দুনিয়ার মজদুর এক হও” !!
তথ্যসূত্র :বার্তা সম্প্রতি