|
---|
সৌতিক, কলকাতা: ১৯৯৯-২০০২ সালের মধ্যে ৩৩ টি ধর্ষণ ও ১২ টি খুনের ঘটনা ঘটেছিল উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার এক গ্রাম সুঁটিয়াতে, পশ্চিমবঙ্গের এই সুঁটিয়া গ্রাম কে তখন বলা হত ‘ধর্ষনগ্রাম। নাগবাড়ির কুখ্যাত তোলাবাজ এবং মস্তান সুশান্ত চৌধুরী ও তার দলবলের অত্যাচারে সুঁটিয়া ও আশপাশের গ্রামগুলোতে তখন অন্ধকার যুগ চলছে। মস্তান সুশান্ত চৌধুরীর ক্ষমতা এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছিলো যে সে তার ‘কার্গিল পার্টি’র ছেলেদের বলত, “এলাকার কোন মেয়েটাকে ভাল লাগছে বল। তুলে আন, রেপ কর। বাকিটা আমি সামলে নেব।” সুশান্ত চৌধুরী ও তার কার্গিল পার্টির ছেলেরা এতটাই নরপিচাশ ছিল যে মায়ের সামনে মেয়েকে, মেয়ের সামনে মা কে, বাবার সামনে মেয়েকে ধর্ষণ করতো। সুঁটিয়া গ্রামের পাড়ার একটি বিয়েবাড়ি থেকে একটি মেয়েকে তুলে নিয়ে গিয়ে টানা ৩ দিন ধরে ওরা ধর্ষণ করে, মেয়েটির শুধু অপরাধ ছিল সে বিয়েবাড়ির ফুচকা খেয়ে বলেছিলো ফুচকাটা ভালো নয়। ওই গ্রামের মেয়েরা সারাদিনের প্রতিটা মুহূর্ত ধর্ষিতা হওয়ার ভয়ে দিন কাটাতেন।
এই অত্যাচারে মানুষ অতিষ্ট হয়ে ২০০২ সালের ১ আগস্ট সুঁটিয়া বাজারে ডাক দেওয়া হলো প্রথম প্রকাশ্য এক প্রতিবাদসভার। অনেকেই এসেছে, তবুও বক্তৃতা করার সাহস কেউ পাচ্ছে না। এগিয়ে এলেন এক যুবক, মাইকটা তুলে নিয়ে বললেন,
“যদি এখনও মা-বোনেদের সম্মান রক্ষা করতে না পারি, তা হলে আমরা সভ্য সমাজে থাকার যোগ্য নই। আমাদের যদি ধর্ষণকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস না থাকে, তাহলে আমাদের তাদের থেকেও বেশি শাস্তি পাওয়া উচিত…তাই আসুন, আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে আমাদের নারীদের সম্মান রক্ষা করুন।”
সেদিনের সেই যুবক টার নাম বরুণ বিশ্বাস। কে এই বরুণ বিশ্বাস ? আপনারা অনেকেই হয়তো চেনেন আবার অনেকেই হয়তো চেনেননা। ১৯৭২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার (অধুনা উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলা) সুটিয়ায় বরুণ বিশ্বাসের জন্ম। ১৯৭১ সালে তাঁর বাবা-মা জগদীশ বিশ্বাস ও গীতা বিশ্বাস বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ফরিদপুর থেকে চব্বিশ পরগনা জেলার পাঁচপোতার আচারিপাড়ায় চলে এসেছিলেন। জগদীশ বিশ্বাস তাঁর সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য দিনে মজুরের কাজ করে ও রাতে স্থানীয় যাত্রাদলে গান গেয়ে জীবিকানির্বাহ করতেন। বরুণ বিশ্বাস পাঁচপোতা ভরাডাঙা হাই স্কুল ও খাতরা বয়েজ হাই স্কুলে পড়াশোনা করেন। তারপর গোবরডাঙ্গা হিন্দু কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি ও নিউ ব্যারাকপুরের বি. টি. কলেজ থেকে বি.এড ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষা শেষ করার পর বরুণ বিশ্বাস WBCS পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন কিন্তু সমাজসেবা ও শিক্ষকতার জীবন বেছে নেন। ১৯৯৮ সালে তিনি কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউশনে (মেন) স্কুলশিক্ষক হিসেবে কাজে যোগ দেন। মৃত্যুর সময় পর্যন্ত তিনি সেখানেই শিক্ষকতা করেছিলেন।
সেইসময় স্কুল-শিক্ষক বরুণ বিশ্বাস একদল গ্রামবাসীদের নিয়ে এই জঘন্য অপরাধের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন এবং অপরাধীদের গ্রেফতারের দাবি জানাতে থাকেন। ২০০০ সালে মাত্র ২৮ বছর বয়সে তিনি অন্যান্যদের সঙ্গে “সুটিয়া গণধর্ষণ প্রতিবাদ মঞ্চ” গঠন করেন। শয়তানদের দুর্গ কেঁপে উঠল। ‘প্রতিবাদী মঞ্চ’এর আন্দোলনের চাপে ধরা পড়লো পাঁচজন অপরাধী। আসামী সুশান্ত চৌধুরীর হাতে বরুন তুলে দিয়েছিলেন ‘শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’। বলেছিলেন “জেলে বসে পড়িস।”
…….এরপর ৫ই জুলাই, ২০১২ স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে বরুণ বিশ্বাস কে ওরা খুন করে দিলো, বরুণের রক্তমাখা ওই শরীর টা প্রায় আধ ঘন্টা গোবরডাঙ্গা স্টেশনে পড়ে ছিল কিন্তু সেদিন কেউ এগিয়ে আসেনি বাঁচাতে। ছাত্রদের কাছে প্রিয় ছিলেন ‘মাস্টারমশাই’ সম্বোধনে, আস্থা ছিলেন গরীব-দুঃখী মানুষেরও। বেতনের যতটুকু পেতেন তার সবই খরচ করতেন এসব মানুষের জন্য। নিজের বেতনের টাকা খরচ করে ধর্ষিতা হওয়া মেয়েদের বিয়ের ব্যবস্থা করা এবং তাদের মানসিকভাবে শক্তিশালী করা, নিজের খাট দান করে নিজে প্লাস্টিকে শোয়া,অন্যের পড়াশুনার খরচ চালানো, বিভিন্ন অসুবিধা তে সরকারকে চিঠি মারফৎ জানানো, রাতে মানুষদের পাহারা দেওয়া প্রভৃতির নেপথ্যে ওই মানুষটা ছিলেন। স্নাতক পাস বেকার তরুণদের একত্র করে সহায়তা করতেন চাকরির প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য। বরুন বিশ্বাস কে কি আপনারা ভুলে যাবেন ? যদি ভুলে যান এই লেখাটা একবার পড়ে নেবেন ..
“আমি ছেলে-হারানো এক গর্বিত মা। আমার ছোটোছেলে বরুণ মৃত্যুভয়ের সামনে দাঁড়িয়েও কখনও পিছু হটেনি। যেদিন পর্যন্ত প্রতিবাদী মঞ্চ সবরকম দুষ্কর্মের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকবে, সেদিন পর্যন্ত আমার ছেলে অমর থাকবে। বরুণ ছিল, বরুণ আছে, বরুণ থাকবে।”
—গীতা বিশ্বাস (বরুণ বিশ্বাসের মা)
বরুণ বিশ্বাসরা মরে না,বরুণ বিশ্বাসরা যে মরতে পারেনা, নিজের বাবা মার সামনে ধর্ষিতা হওয়া মেয়েটার জীবনে শক্তি যুগিয়ে তার বিয়ে দিয়ে তাকে নতুন করে বাঁচবার শক্তি দেওয়ার মধ্যে বরুণ বিশ্বাস বেঁচে আছে, সারাদিন বাড়ির মধ্যে ধর্ষিতা হওয়ার আতঙ্কে দিন কাটানো ওই মহিলাদের হৃদয়ের ভালোবাসাতে বরুণ বিশ্বাস বেঁচে আছে , টানা ৩ দিন ধরে ধর্ষণ করে রাস্তার ধারে ফেলে রাখা ওই মেয়েটা কে সুস্থ করে করে বাঁচার স্বপ্ন দেখানোর মধ্যে বরুণ বিশ্বাস বেঁচে আছে, বরুণ বিশ্বাস বেঁচে আছে পয়সার অভাবে মেয়ের বিয়ে দিতে না পারা ওই বাবাটার আনন্দের চোখের জলের মধ্যে, বরুণ বিশ্বাস বেঁচে আছে অভাবে পড়তে না পারা ওই ছেলেমেয়েগুলোর নতুন করে পড়তে পারার আনন্দের মধ্যে।
বরুন বিশ্বাস এভাবেই বেঁচে থাকবে আমাদের হৃদয়ে। অন্যায়ের প্রতিবাদে গ্রামবাংলার প্রতিটা বাড়ি থেকে একটা করে বরুন বিশ্বাস জন্মে উঠুক,গর্জে উঠুক।
সৌ তি ক