ভারত-পাক দ্বন্ধে আশংকায় দিন কাটাচ্ছেন কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ

কাশ্মীরের শ্রীনগরে তার বাড়ির ওপর দিয়ে প্রথমযখন যুদ্ধবিমান উড়ে যাচ্ছিল, তার কিছুক্ষণ পর৫০ বছর বয়সী মোহাম্মদ ইউসুফ জানতে পারেন,খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে।
নিয়ন্ত্রণরেখা থেকে ১০ কিলোমিটারের কমদূরত্বের একটি স্কুলে গণিত পড়ান মোহাম্মদইউসুফ। মাথার ওপরে যুদ্ধবিমানের গর্জন এরআগে কখনও তিনি শুনেননি বলে জানিয়েছেন।-খবর ইন্ডিপেন্ডেন্ট অনলাইনের
রাজ্যটির গ্রীষ্মকালীন রাজধানী শ্রীনগরে গতসপ্তাহের আগে যুদ্ধবিমানের এমন গোঙানিনিকটাতীতে শোনা যায়নি।
ছবির মতো দেখতে শ্রীনগরের কাছেই সীমান্তদিয়ে চিরবৈরী দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যেনিয়মিত গোলাবিনিময়ের ঘটনা ঘটছে। এতেভারত-পাকিস্তানের নাগরিকরা হতাহত হচ্ছেনঅহরহ।
যুদ্ধবিমানের গর্জন যখন ইউসুফের কানে আসে,তখন রাত সোয়া ৩টার বেশি বাজে। তখনও কেউজানতেন না যে ইতিহাসে প্রথমবারের মতোভারত-পাকিস্তান পরস্পরের ভূমিতে বিমানহামলা চালাতে যাচ্ছে।
ইউসুফ বলেন, বিমানের শব্দে ঘুম ভেঙে গেলেআতঙ্কিত হয়ে সবাই ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসি।
স্ত্রী ও তিন সন্তানকে নিয়ে মোহাম্মদ ইউসুফেরসংসার। তিনি বলেন, কী ঘটছে, তা দেখতে সবাইআকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। গভীর রাত,অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাইনি। তবে বিমানেরবিকট গর্জন এসে কানে লাগছিল।
এই গণিত শিক্ষক বলেন, আমি কখনেই এমনশব্দ শুনিনি। কিন্তু এটি কীসের শব্দ তা জানতাম।আমরা ভেবেছিলাম, সীমান্তে কিছু একটা ঘটছে।যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।
কেবল মোহাম্মদ ইউসুফই নন, শ্রীনগরের অন্যবাসিন্দারাও নিজেদের সন্তানদের আতঙ্ক থেকেবাঁচাতে মিথ্যা বুঝ দিয়েছেন। যাতে খারাপ কিছুঘটছে বলে তাদের কাছে মনে না হয়। শিশুরাযাতে স্বাভাবিক থাকতে পারে।
তিনি তার ১০ বছর বয়সী ছোট ছেলেআজহারকে বলেন, সব কিছু ঠিক আছে। এটিবিমানের স্বাভাবিক চলাচল।
এটিই হচ্ছে শ্রীনগরের মানুষের স্বাভাবিকজীবনযাপন। পরমাণু শক্তিধর ভারত-পাকিস্তানের বৈরিতার মাঝখানে তাদের অবস্থান।দুই দেশই কাশ্মীরকে নিজেদের অবিচ্ছেদ্য অংশবলে দাবি করছে।
পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সেনা অধ্যুষিতঅঞ্চলগুলোর একটি হচ্ছে কাশ্মীর। পাহাড়েঘেরাএই ছোট্ট উপত্যকাটিতে প্রায় সাত লাখ ভারতীয়সেনা মোতায়েন করা হয়েছে।
সশস্ত্র পুলিশের বিপুল অবস্থান সত্ত্বেও বিশ্বব্যাপীপর্যটকদের অন্যতম গন্তব্য হচ্ছে কাশ্মীর। ডাললেকের চোখ জুড়ানো দৃশ্য ও ঐতিহাসিক স্থাপনারয়েছে সেখানে।

    ৪০০ বছরের পুরনো মোগল আমলের পরীমহলদেখতে পর্যটকরা ছুটে যান কাশ্মীরে। কিন্তু পরীরনিবাসখ্যাত এই গার্ডেনেও ভারতীয় আধাসামরিকবাহিনীর একটি ছোট্ট ক্যাম্প বসানো রয়েছে।
    ১৪ ফেব্রুয়ারিতে পুলওয়ামায় হামলার পরকাশ্মীরে উত্তেজনা নাটকীয়ভাবে বেড়ে গেছে।ঝিলাম নদে যাত্রী পারাপার করেন আবদুলকারিম কালু। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধেরসময় সর্বশেষ শ্রীনগরে যুদ্ধবিমানের ঘুরপাকদেখেছেন তিনি।
    কালু বলেন, সাম্প্রতিক যুদ্ধবিমান দেখার পরসেই সময়ের কথা আমার মনে পড়ে গেছে।এখানে ব্যবসায়ী সমিতি নিয়মিত ধর্মঘট ডাকে।কাজেই শহরজুড়ে সবসময় উত্তেজনা থাকে।
    আর এসব কারণে কালুর উপার্জনেও ধাক্কালাগে। তিনি বলেন, বাস্তবিকভাবে পরিস্থিতিরঅবনতি ঘটছে। সংঘাতের কারণে কাশ্মীরেরলোকজনের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক কাজ করছে।
    কালু সবসময় নিজের দুই নাতনির নিরাপত্তা নিয়েউদ্বিগ্ন থাকেন। তিনি বলেন, যারা সকালে রুটি-রুজির সন্ধানে ঘর থেকে বের হন, সন্ধ্যায় তারাজীবিত ফিরতে পারবেন কিনা, তা নিয়েঅনিশ্চয়তা রয়েছে।
    কাশ্মীরের রাস্তায় একসময় বহু হকার দেখা যেত।তারা হস্তশিল্প ও কাশ্মীরি কাপড়চোপড় বিক্রিকরতেন। পর্যটকরা তা সংগ্রহ করছেন। কিন্তুপরমাণু শক্তিধর দুই দেশের মধ্যে সংঘাতেরপ্রেক্ষাপটে  সড়ক থেকে তারা উধাও হয়ে গেছেন।
    কাশ্মীরের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে এক দোকানিরসঙ্গে  কথা বলতে গেলে তিনি বিচলিত বোধকরেন।
    কীভাবে পাক ভারত সংঘাত তার ব্যবসা ধ্বংসকরে  দিয়েছে, সে কথা জানালেন ২৫ বছর বয়সীযুবক আবিদ খাপড়া।
    কথা বলার সময় তার ভেতর খুবই আবেগ দেখাগেছে। বেদনার সঙ্গে তিনি বলেন, দিনে দিনেআমরা হতাশ হয়ে পড়ছি। অর্থনৈতিকভাবেআমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।আমাদের শিশুরাশিক্ষাবঞ্চিত হচ্ছে। এভাবেই খেসারত দিতে হচ্ছেআমাদের।মানুষের চলাচলে    বিধিনিষেধ আরোপ করেরেখেছে দাঙ্গা পুলিশ। ১৪ ফেব্রুয়ারির হামলারপর থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে ধরপাকড়অভিযান চলছে। কাজেই পুলিশের বাধায় নিজেরদোকানে  যেতে পারেন না আবিদ খাপড়া। এতেতার আয়-উপার্জন বন্ধ হয়ে  গেছে। ক্ষুব্ধ হয়ে সে কথাই বলছিলেন  এ কাশ্মীরি যুবক।তিনি বলেন, যখনই আমি বাইরে বের হই,  দেখিদাঙ্গা পুলিশ সেখানে  দাঁড়িয়ে আছে। আমিহয়রানির শিকার হই। দোকানে যেতে পারি না।

    আবিদ বলেন, ভারতের কোথাও গেলেসেনাবাহিনী আপনাকে সহায়তা করবে।কিন্তুএখানে একজন সেনার কাছে  অপরিচিতজায়গার  ঠিকানা জিজ্ঞাসা করতেও সাহস পাবেননা সেনাসদস্যরা যদি খারাপ  কিছুও করে, তবেসে জন্য তাদের জবাবদিহি করতে হয় না।
    একটি ক্যাফেতে খেতে গিয়ে পছন্দের খাবারপাননি ২২ বছর বয়সী চিকিৎসা বিজ্ঞানেরশিক্ষার্থী আবরু জান। তিনি বলেন,  পুলওয়ামায়হামলার পর ভারতীয় আধাসামরিক বাহিনীরআচরণে  পরিবর্তন চলে এসেছে। সেনাসদস্যরাআমাদের তাদের  শত্রু মনে  করছে।আবরু জান বলেন, একজন কাশ্মীরি হিসেবেস্বজন  হারানো পরিবারের সদস্যদের বেদনা আমিবুঝতে পারি। আমরা সবাই কাউকে না কাউকেহারিয়েছি। আমাদের গ্রামে অনেক  প্রাণহানিঘটেছে। বন্দুকের গুলিতে তরুণদের  আহত হতেদেখেছি।
    বাইরে বের হলেই সশস্ত্র পুলিশের মুখোমুখি হতেহয় বলেও জানান এ মেডিকেলছাত্রী। বললেন,এখানে অনেক বিধিনিষেধ মেনে চলতে হয়।এখানে বহু সেনা মোতায়েন করা হয়েছে।পরিস্থিতির এতই অবনতি ঘটেছে যে,কাশ্মীরিদের জন্য কাশ্মীর কোনো নিরাপদবাসস্থান নয়।‘পুলওয়ামার আগে মনে হয়েছিল,   পরিস্থিতিরউত্তরণ ঘটছে। স্বাভাবিক না হলেও চলাফেরাকরা যেত। কিন্তু বর্তমানে পাকিস্তান ও ভারতসংঘাতের দিকে চলে গেছে। আর সেই সংঘাতেরমাঝে রয়েছে কাশ্মীর।’
    ঘাসে ঢাকা নদীর তীরে বসে বন্ধুদের সঙ্গে গল্পকরছিলেন ২১ বছর বয়সী কম্পিউটার প্রকৌশলীমোহাম্মদ আবরার। তার একটি ভালো চাকরিআছে। কাজেই তিনি কিছুটা আশাবাদী মানুষ।
    তার পরও তিনি বলেন, আতঙ্কে শহরেসপ্তাহখানেক রাতে ঘুমাতে পারিনি। শ্রীনগরেররাস্তায় এই প্রথমবারের মতো আমি উত্তেজনাটের  পেলাম।‘গত সপ্তাহে যখন মাথার ওপর দিয়ে যুদ্ধবিমানঘুরপাক  খাচ্ছিল, তখন এটিকে হলিউডের যুদ্ধচলচ্চিত্রের দৃশ্য বলে মনে হয়েছিল। আমরা খুবইহতাশ।বাড়িতে নিজেদের নিরাপদ ভাবতে  পারছিনা।’পাকিস্তান শান্তির নিদর্শন হিসেবে পাইলটঅভিনন্দন বর্তমানকে ভারতের কাছে ফেরতদেয়ার পর উত্তেজনা কিছুটা কমতির দিকেগেছে। কিন্তু এতে এমন কোনো স্থায়ী সমাধানআসেনি,  যাতে কাশ্মীরের লোকজন আশাবাদীহতে পারেন।
    এই কম্পিউটার প্রকৌশলী বলেন, এখানে কারওভবিষ্যৎ নেই। কোনো শিশু, নারী-পুরুষ কিংবাবৃদ্ধ। কেউ নিরাপদ নয়; এমনকি  এখানকারকোনো বাড়িতেও কারও নিরাপত্তা নেই।