|
---|
নিজস্ব সংবাদদাতা : দামি মোবাইল, স্মার্ট ওয়াচ, গেমিং ল্যাপটপ কেনার জন্যই কি ‘বন্ধু’কে খুন? নদিয়ার কৃষ্ণনগরে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রকে খুনের অভিযোগে ধৃত ক্লাস টেনের তিন পড়ুয়াকে জিজ্ঞাসাবাদ করে প্রাথমিকভাবে এমনটাই মনে করছেন তদন্তকারীরা। নিহত কিশোর অভিযুক্তদের তুলনায় বয়সে ছোট হলেও পাশাপাশি পাড়ায় থাকা এবং একই স্কুলে পড়ার সুবাদে বন্ধুর মতোই ছিল।শনিবার রাতে ক্লাস এইটের পড়ুয়ার বাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার দূরে একটি পুকুর থেকে তার বস্তাবন্দি দেহ উদ্ধার হয়। সেই ঘটনায় তিন অভিযুক্তকে জেরা করে খুনের মোটিভ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চাইছেন তদন্তকারীরা। তবে যেভাবে রীতিমতো প্ল্যান করে আগে থেকে বস্তা কিনে এনে এবং কিশোরের মাকে ফোন করে তিন লক্ষ টাকা মুক্তিপণ চাওয়া হয়েছিল তাতে নিজেদের লোভ চরিতার্থ করতেই খুন করা হয়েছে বলে পুলিশের সন্দেহ জোরদার হচ্ছে।স্বামী কয়েক বছর আগে মারা যাওয়ায় দুই নাবালক পুত্রকে নিয়ে বাপের বাড়িতে চলে যান নিহত কিশোরের মা। পরিচারিকার কাজ করে সংসার চালাতেন। শিক্ষক দিবসে স্কুলের এক স্যরকে উপহার কিনে দেওয়ার জন্য শুক্রবার সন্ধেয় বন্ধুদের বাড়িতে গিয়েছিল ক্লাস এইটের পড়ুয়া। মা নিষেধ করলেও কানে তোলেনি সে। তারপর থেকেই নিখোঁজ হয়ে যায় সে। মায়ের অভিযোগ, শুক্রবার রাতেই বিষয়টি থানায় জানানো হলেও পুলিশ সেভাবে বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি।
শনিবার বিকেল তিনটে নাগাদ তাঁর কাছে অচেনা নম্বর থেকে ফোন করে মুক্তিপণ চাওয়া হয়। নিহতের মা রবিবার বলেন, ‘ফোনে বলা হয়, কৃষ্ণনগর জেলা লাইব্রেরির সামনে থেকে ছেলেকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তিন লক্ষ টাকা দিলে ছেলেকে ছেড়ে দেবে।’ তিনি বলেন, ‘আমি কাকুতি মিনতি করে বলেছিলাম, লোকের বাড়ি কাজ করে সংসার চলে। অত টাকা কোথায় পাব? তবু চল্লিশ হাজার টাকা জোগাড় করে দেবো বলেছিলাম। তার পরে ওই নম্বরে আর যোগাযোগ করতে পারিনি। পুলিশকে ওই ফোন নম্বর দেওয়ার পরে তারা খোঁজাখুঁজি শুরু করে। আগে করলে হয়তো ছেলেটা বেঁচে যেত।’যে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল, তাদের নাম পাওয়ার পরে শনিবার বিকেলে তাদের প্রথমে আটক করে পুলিশ। সন্দেহভাজন তিন কিশোরকে শুরু হয় জিজ্ঞাসাবাদ। তদন্তকারীরা জানতে পারেন, ঘূর্ণি বাজারের একটি চালের দোকান থেকে বস্তা কিনেছিল ওই কিশোররা। ঠান্ডা পানীয়, মিষ্টিও কিনেছিল বাজার থেকে। ধৃত তিনজনকে নিয়ে ঘূর্ণির ওই দোকানদারদের সামনেও হাজির করে পুলিশ। তারপরে তাদের বয়ানের ভিত্তিতে পুকুর থেকে ক্লাস এইটের পড়ুয়ার বস্তাবন্দি মৃতদেহ উদ্ধার হয়।
কিন্তু তদন্তকারীদের ভাবাচ্ছে, এত পরিকল্পনা করে অষ্টম শ্রেণির এক পড়ুয়াকে কেন খুন করল দশমের তিন ছাত্র। প্রাথমিক জেরায় উঠে এসেছে, গেমিং ল্যাপটপ, স্মার্টওয়াচ কেনার পরিকল্পনার কথা। সেজন্যই ওই কিশোরকে অপহরণ করে মুক্তিপণ চাওয়া হয় বলে সন্দেহ তদন্তকারীদের। যদিও নিহত কিশোরের মায়ের দাবি, তাঁর কাছে যে ফোন এসেছিল, তাতে উল্টোদিকের ব্যক্তির গলা শুনে কোনও কিশোর বলে মনে হয়নি। বরং তাঁর দাবি, ওই ব্যক্তির গলার স্বর যথেষ্ট ভারী এবং সেটা কোনও বয়স্ক ফলে এই খুনের পিছনে আরও কেউ আছে কি না, সেটাও তদন্তকারীদের ভাবাচ্ছে। পাশাপাশি ওই কিশোরের পরিবারের এত টাকা দেওয়ার সামর্থ্য নেই জেনেও কেন তার মায়ের কাছে তিন লক্ষ টাকা দাবি করা হলো, তাও জানার চেষ্টা চলছে। তবে কি অভাব থেকেই মোবাইল, স্মার্ট ওয়াচ কেনার বাসনা–সেটা বুঝতে মনোবিদদের সাহায্য নিতে চাইছে পুলিশ। কৃষ্ণনগর জেলা পুলিশের সুপার ঈশানী পাল বলেন, ‘খুনের কারণ ঠিক কী, তা জানার চেষ্টা চলছে। ধৃত তিন কিশোর প্রাথমিক জেরায় খুনের কথা কবুল করেছে।’ আবার যদিও নিহত ছাত্রের মায়ের দাবি, স্কুলে হাতের কাজ নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে গন্ডগোলের জেরেও খুন করা হয়ে থাকতে পারে ছেলেকে। সংশ্লিষ্ট স্কুলের প্রধান শিক্ষক অবশ্য বলেন, ‘অষ্টম শ্রেণির ছাত্রদের হাতের কাজের একটা ব্যাপার থাকে ঠিকই। তবে অন্য ক্লাসের সঙ্গে গ্রুপে কাজ করার কোনও প্রজেক্ট স্কুলে নেই।’ প্রণয়ঘটিত কোনও কারণও খুনের পিছনে রয়েছে কি না, সেটাও খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা। অভিযুক্ত ধৃত তিনজনের বাড়িতে এদিন সকালে গিয়ে দেখা যায় বাড়ি তালা বন্ধ।অভিযুক্তদের কঠোর শাস্তি দাবিতে এদিন বিকেলে কৃষ্ণনগর পুরসভা মোড়ে একটি প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। কিছুক্ষণ রাস্তা অবরোধও করেন ঘূর্ণির বাসিন্দাদের একাংশ। পুলিশের বিরুদ্ধেও সরব হন তাঁরা। বিক্ষোভে সামিল হওয়া নিহত ছাত্রের আত্মীয়া বলেন, ‘আমরা তো শুক্রবার রাত বারোটা নাগাদ কোতোয়ালি থানায় অভিযোগ জানিয়েছিলাম। শুধু ছাত্রের ছবিটা দিতে পারিনি। পুলিশ দ্রুত ব্যবস্থা নিলে ওকে হয়তো মরতে হতো না।’