|
---|
নিজস্ব প্রতিনিধি : ২০১৫ সালের ঘটনা। ২৭ ডিসেম্বর সকাল ১০টা নাগাদ, বাইপাস সংলগ্ন পিকনিক গার্ডেনের সিএন রায় রোডে একটি নির্মীয়মান বহুতলের দোতলায় একজন অচৈতন্য মানুষের দেহ দেখতে পান নির্মাণশ্রমিকরা। খবর আসে তিলজলা থানায়। দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায় সাব ইনস্পেকটর শুভব্রত করের নেতৃত্বে তিলজলা থানার বিশেষ টিম। দেখা যায়, অচৈতন্য মানুষটির হাত পিছমোড়া করে বাঁধা বেল্ট দিয়ে, দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়েছে পা-দুটিও। ডানদিকের কপালে আঘাতের চিহ্ন। চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকেরা জানান, মানুষটির মৃত্যু হয়েছে আগেই।
তদন্ত শুরু হয়। মৃত মানুষটির পরিচয় জানতে স্থানীয় মানুষদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন তদন্তকারী অফিসারেরা। জানা যায়, তাঁর নাম কেভিন আলফ্রেড ডিসিলভা। তিনি পিকনিক গার্ডেনের বাসিন্দা। কেভিনের অস্বাভাবিক মৃত্যুর তদন্ত চেয়ে তিলজলা থানায় একটি অভিযোগও দায়ের করেন তাঁর শ্যালক অ্যালবার্ট জন।
সূত্রে খবর দেওয়া হয়। জানা যায়, ২৬ ডিসেম্বর রাতে কেভিন-সহ ৩ জন পাঁচিল টপকে ঐ নির্মীয়মান বহুতলে ঢুকেছিল। কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী তদন্তকারী অফিসারদের জানান, ২৭ তারিখ ভোরবেলা অন্য দু’জন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিকে তাঁরা ওই বহুতল থেকে বেরিয়ে আসতেও দেখেছেন। ওই দু’জনের পরিচয় জানতে সূত্র মারফতের সঙ্গে সাহায্য নেওয়া হয় প্রযুক্তিরও। কিছুক্ষণের মধ্যেই চিহ্নিত করা যায় দু’জনকে। ২৭ ডিসেম্বর সন্ধেতেই সুরেশ সরকার রোড এবং পিকনিক গার্ডেন রোডের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয় প্রীতম সিংহ রায় ওরফে মার্ক এবং আদ্রিয়ান ফার্নান্ডেজকে। সম্পর্কে দু’জনেই মৃত কেভিনের তুতো ভাই।
জেরায় প্রীতম এবং আদ্রিয়ান জানায়, কেভিনের সঙ্গে মিলে একসঙ্গে ড্রাগ নিত তারা। কেভিন একসময় রিহ্যাব সেন্টারেও ছিল কিছুদিন। সেখান থেকে বেরিয়ে ফের শুরু করে ড্রাগ নেওয়া। ২৬ ডিসেম্বর রাতেও লুকিয়ে ড্রাগ নেবে বলেই তারা পাঁচিল টপকে ঐ নির্মীয়মান বহুতলে ঢুকেছিল। কিছুক্ষণ পরে তাদের ড্রাগ ফুরিয়ে আসে। নতুন ড্রাগ কেনার জন্য টাকার প্রয়োজন। কারও কাছেই বেশি টাকা ছিল না। তখন প্রীতম আর আদ্রিয়ানের নজর পড়ে কেভিনের পায়ে থাকা দামি জুতোর দিকে। কেভিনকে জুতো বেচে ড্রাগ কিনে আনার প্রস্তাব দেয় তারা। কেভিন সেই প্রস্তাবে রাজি না হলে শুরু হয় ঝগড়া।
ড্রাগের নেশায় তখন উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল প্রীতম আর আদ্রিয়ান। জোর করে জুতো খুলে নেওয়ার জন্য কেভিনকে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলে তারা। আশপাশেই পড়ে থাকা দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে তার পা-দুটোও। তারপর, কেভিনের পায়ে থাকা দামি জুতো খুলে নেয় তারা। কেভিন চিৎকার শুরু করলে মুখ চেপে ধরে দু’জনে মিলে। তখন শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায় কেভিন। ওই ধস্তাধস্তির সময়েই কপালে আঘাত লেগেছিল কেভিনের।
ড্রাগের নেশায় তখন বাহ্যজ্ঞান প্রায় লুপ্ত হয়েছে প্রীতম আর আদ্রিয়ানের। ওই অবস্থাতেই কেভিনকে ফেলে রেখে তারা বেরিয়ে আসে বাইরে। তারপর বৈঠকখানা বাজারে গিয়ে রাস্তার পাশের একটি দোকানে বেচে দেয় কেভিনের সেই জুতো। জুতো বেচে পাওয়া টাকার বিনিময়ে ফের কেনে ড্রাগ।
সেই দোকান থেকেই কেভিনের জুতোজোড়া উদ্ধার করেন তদন্তকারী অফিসারেরা। ইতিমধ্যে ময়না তদন্তের রিপোর্টেও দেখা যায়, শ্বাসরোধ করেই খুন করা হয়েছে কেভিনকে। ধৃত প্রীতম আর আদ্রিয়ান যে ঘটনার রাতে কেভিনের সঙ্গেই ছিল, তার অন্য প্রমাণও মেলে। বৈঠকখানা বাজারের সেই দোকানিও শনাক্ত করেন প্রীতম আর আদ্রিয়ানকে।
সমস্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে চার্জশিট জমা দেওয়া হয়। দীর্ঘ শুনানির পরে সেই কেসেরই রায় বেরিয়েছে। প্রীতম এবং আদ্রিয়ানের যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডের নির্দেশ দিয়েছেন মাননীয় বিচারক। সঙ্গে ২০,০০০ টাকা করে জরিমানা। জরিমানা অনাদায়ে কারাদণ্ডের মেয়াদ বাড়বে আরও ৬ মাস।
নিচে থাকল প্রীতম এবং আদ্রিয়ানের ছবি। একদিনের মধ্যেই অপরাধীদের পাকড়াও করেছিলেন এই কেসের তদন্তকারী অফিসার, তিলজলা থানার তৎকালীন সাব ইনস্পেকটর শুভব্রত কর। শুভব্রত এখন গোয়েন্দা দপ্তরের গুণ্ডাদমন শাখায় কর্মরত। তাঁর ছবিও থাকল।