|
---|
নিজস্ব প্রতিনিধি : ১৮ লক্ষ টাকার সোনার গয়না নিয়ে চম্পট দিয়েছিল চোর। না ছিল তার কোনও ছবি, না ছিল ঠিকানার -হদিশ। সেই চোরের নাগাল পেতে এরপর আসানসোল-বিহার-দিল্লি-পাঞ্জাব জুড়ে যা ঘটল, তা যতটা তদন্ত, প্রায় ততটাই থ্রিলার।
২১ অক্টোবর, নিউ আলিপুর থানায় এসে গুরুতর অভিযোগ জানালেন সুনীল সিং। তাঁর বাড়ি থেকে ১৮ লক্ষ টাকার সোনার গয়না নিয়ে চম্পট দিয়েছে পবন যাদব নামের পরিচারক। দু’ দিন আগেই পবনকে বাড়ির কাজে বহাল করেছিলেন সুনীল। তার পরিচিতির সমস্ত নথি সংগ্রহ করে জমা দেবেন বলে থানা থেকে ফর্মও নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু তার আগেই গয়না চুরি করে পবন হাওয়া।
পবনের কোনও ছবি ছিল না সুনীলের কাছে। শুধু জানতেন, পবনের বাড়ি বিহারের বাঁকা জেলায়। নির্দিষ্ট ঠিকানাও জানা হয়নি। পবন কোনও মোবাইলও ব্যবহার করত না। করলেও সে ফোনের কথা জানতেন না সুনীল। তাহলে? কীভাবে মিলবে পবনের খোঁজ?
নিউ আলিপুর এবং ভবানীপুর অঞ্চলে বিহারের বাঁকা জেলা থেকে আসা অন্যান্য পরিচারকদের জিজ্ঞাসাবাদ করা শুরু করেন নিউ আলিপুর থানার তদন্তকারী অফিসারেরা। বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদের পর অবশেষে পবনের একটি ছবি মেলে। সুনীল সেই ছবি দেখে পবনকে শনাক্তও করেন। ইতিমধ্যে জানা যায়, এর আগেও ২০১৪ সালে বিধাননগর (দক্ষিণ) থানায় চুরির অপরাধে গ্রেপ্তার হয়েছিল সে। পাঁচ বছর পর ‘আবার সে এসেছে ফিরিয়া’।
পবনের বাড়ি বাঁকা জেলার বালিয়ামাহারের খাবা-তে। দ্রুত খাবা-র উদ্দেশে রওনা দেয় নিউ আলিপুর থানার বিশেষ টিম। কিন্তু সেখানে পবনের হদিশ মেলেনি। ঝুপড়িতে পবনের মা আর তাঁর একজন প্রতিবন্ধী সন্তান। পবনের কোনও সন্ধান দিতে পারেননি মা। বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় নেইই। ঘরের তল্লাশি করে আধার কার্ডের অ্যাপ্লিকেশন ফর্ম থেকে একটি মোবাইল নম্বরের সন্ধান পান তদন্তকারী অফিসারেরা। কিন্তু জানা যায়, সেই মোবাইল ব্যবহার করেন পবনের মা। ফোনের কল রেকর্ড পরীক্ষা করে দেখা যায়, গত ৬ মাসে সবচেয়ে বেশি বার ফোন করা হয়েছে কামেশ্বর যাদব আর অখিলেশ যাদবকে। দু’জনেই আসানসোলের কুলটির বাসিন্দা। তাহলে কি এই কামেশ্বর বা অখিলেশের সঙ্গে পবনের বা এই চুরির ঘটনার কোনও যোগসূত্র আছে?
ইতিমধ্যেই, নিউ আলিপুর থানায় সতীশ নামের একজন পরিচারক জানান, ১৮ ও ১৯ অক্টোবর তার মোবাইল থেকেই কয়েকবার ফোন করেছিল পবন। কিন্তু, ফোনের পর সেইসব নম্বর সে মুছেও দেয় মোবাইল থেকে। শুরু হয় প্রযুক্তি প্রহরা। দেখা যায়, লালবাবু সিং নামের একজনকে ফোন করেছিল পবন। তার বাড়ির ঠিকানা এন্টালির শম্ভু বাবু লেন। ট্রু কলারে অবশ্য সেই ব্যক্তির নাম দেখাচ্ছিল নীতেশ সিং।
হোয়াটসঅ্যাপ থেকে একটি ছবিও মেলে। কিন্তু সেই ছবি নিয়ে এন্টালিতে লালবাবু সিং-এর বাড়িতে তল্লাশি চালাতে গিয়ে রীতিমতো অপ্রস্তুত হন তদন্তকারী অফিসারেরা। ছবিটি একজন কিশোরের আর লালবাবু সিং প্রৌঢ়। তিনি পেশায় ট্যাক্সি চালক। এই এলাকায় দীর্ঘদিন ধরেই আছেন। ছবিতে থাকা ছেলেটিকেও তিনি চেনেন না। এমনকি, ওই এলাকার কোনো বাসিন্দাই চিনতে পারেননি ছবিতে থাকা ছেলেটিকে। বোঝাই যাচ্ছিল, তাঁর নামে তোলা সিম ব্যবহার করছে অন্য কেউ।
ওই নম্বর থেকে হোয়াটসঅ্যাপে যাঁদের যাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে, তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়। জানা যায়, ছেলেটির নাম নীতেশ যাদব। প্রযুক্তি প্রহরার মাধ্যমে তার আরেকটি নম্বরের সন্ধানও মেলে। জানা যায় ঠিকানাও । উত্তর পশ্চিম দিল্লির সময়পুরের যাদবনগর।
নিউ আলিপুর থানার আরেকটি টিম দ্রুতই রওনা দেয় দিল্লি। যাদবনগরে পৌঁছে জানা যায়, নীতেশের দুই দাদা এখানে থাকতেন কিন্তু দু’ বছর আগেই বাড়ি বদলে হরিয়ানার পানিপথে চলে গেছেন। পানিপথে গিয়েও জানা যায়, তাঁরা সেখানে আর থাকেন না। এদিকে নীতেশ কারও ফোন ধরছিল না। খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না পবনেরও।
নীতেশের কল রেকর্ড পরীক্ষা করে প্রেম বাহাদুর সিং নামে একজনের সন্ধান মেলে। প্রেম বাহাদুর বর্ধমানের কুলটির বাসিন্দা। তার সঙ্গে অনেকবার কথা হয়েছে নীতেশের। প্রেম বাহাদুরকে সিং-কে ঘিরেই একটি ফাঁদ পাতেন তদন্তকারী অফিসারেরা। তাকে ফোন করে পবন আর নীতেশের কথা জিজ্ঞেস করা হয়। প্রেম বাহাদুর জানায়, দু’জনের কাউকেই সে চেনে না। কিন্তু, এরপরই সাবধান করে দিতে সে ফিরতি ফোন করে নীতেশকে। তদন্তকারী অফিসাররা নিশ্চিত ছিলেন, প্রেম বাহাদুর নীতেশকে ফোন করবেই। পাতা ফাঁদে পা দেয় নীতেশও। প্রেম বাহাদুরের সঙ্গে কথা বলার সময়েই তার ফোনের টাওয়ার লোকেশন চিহ্নিত করে ফেলেন তদন্তকারী অফিসারেরা। কুলটির নিয়ামতপুরের বামনডিহা। বোঝাই যাচ্ছিল, নীতেশের পাশাপাশি প্রেমও এই ঘটনায় জড়িত। এদিকে, পবনের মায়ের ফোনে যে কামেশ্বর যাদবের নম্বর ছিল, তার বাড়িও বামনডিহাতেই। জটিল অঙ্কটা মিলে যাওয়ার আভাস পেতে শুরু করেছিল পুলিশ।
নিউ আলিপুর থানার তৃতীয় টিম দ্রুত পৌঁছে যায় কুলটিতে। ২ নভেম্বর, গ্রেপ্তার করা হয় প্রেম বাহাদুরকে। ফেসবুক আর হোয়াটসঅ্যাপ থেকে পাওয়া ছবির সূত্রে তাকে শনাক্ত করতে কোনও অসুবিধে হয়নি তদন্তকারী অফিসারদের। তার ডেরা থেকে উদ্ধার হয় একটি সোনার নেকলেস।
পাশাপাশি, বামনডিহাতে কামেশ্বর যাদবের ঝুপড়িতেও তল্লাশি চালায় নিউ আলিপুর থানার বিশেষ টিম। কিন্তু পবন বা নীতেশ কারও সন্ধানই মেলেনি। তদন্তকারী অফিসারেরা জানতে পারেন, নীতেশ আর পবন তুতো ভাই। কামেশ্বর যাদবের স্ত্রী সুনীতা সম্পর্কে পবনের দিদি। পবন-নীতেশ-সুনীতা— পরিচারক সেজে বাড়িতে ঢুকে চুরি করার অতীত ইতিহাস রয়েছে তিন ভাই-বোনেরই। এই ঘটনার সঙ্গেও যে সুনীতা জড়িয়ে, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ ছিল না তদন্তকারী অফিসারদের। সুনীতা-কামেশ্বর দু’জনকেই গ্রেপ্তার করে জেরা শুরু হয়। কিন্তু, পবন আর নীতেশের হদিশ দিতে পারেনি দু’জনের কেউই। চুরি করা গয়না কোথায় লুকোনো, তাও বলতে পারেনি সুনীতা-কামেশ্বর।
ইতিমধ্যেই নীতেশের মোবাইল ট্র্যাক করে জানা যায়, সে দিল্লির দিকে চলেছে। দিল্লিতে অপেক্ষারত নিউ আলিপুর থানার টিম পৌঁছে যায় নিউ দিল্লি স্টেশনে। কিন্তু, সেখান থেকেও নীতেশের সন্ধান মেলেনি। রাতে ফের জানা যায়, সে পাঞ্জাবের দিকে যাচ্ছে। অবশেষে পাঞ্জাবের পাটিয়ালায় সুনাম সিটি থানা এলাকায় স্থায়ী হয় তার মোবাইল টাওয়ার লোকেশন। ২ রাত অপেক্ষার পর, ৪ নভেম্বর, স্থানীয় পুলিশের সাহায্য নিয়ে নিউ আলিপুর থানার টিম তল্লাশি চালায় সুনাম সিটির মাস্টার কলোনিতে। ধরা পড়ে পবন আর নীতেশ দু’জনেই।
সারা দিন ধরে বস্তির ২৮টি বাড়িতেই তন্নতন্ন করে তল্লাশি চালিয়েও চুরি যাওয়া গয়নার কোনও খোঁজ মেলেনি। পবন আর নীতেশকে জেরা শুরু হয়। ভিডিও কলের মাধ্যমে কলকাতা থেকে যোগ দেন অন্যান্য তদন্তকারী অফিসারেরাও। কিন্তু গয়না কোথায় লুকোনো আছে, তা নিয়ে মুখ খোলেনি কেউই। দু’জনেই টানা দোষারোপ করতে থাকে একে-অপরকে।
ইতিমধ্যে ধৃত ৪ জনের ছবি নিয়ে নিউ আলিপুর থানার অন্য দু’টি টিমের অফিসারেরা কুলটি, আসানসোল ও নিয়ামতপুর অঞ্চলের সমস্ত গয়নার দোকানেই ঘুরে ঘুরে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন। মোট ১১টি গয়নার দোকানের সন্ধান মেলে, যেখানে নীতেশ, পবন, সুনীতা বা প্রেম বাহাদুরের মধ্যে কেউ না কেউ ভারী ভারী সোনার গয়না বেচতে গেছিল। কিন্তু তাদের অতীত জানা থাকায় বা চেহারা দেখে সন্দেহ হওয়ায় কেউই সেই গয়না কিনতে চায়নি।
৮ নভেম্বর, নীতেশ আর পবনকে নিয়ে আসা হয় কলকাতায়। ছিল সুনীতা আর প্রেম বাহাদুরও। ওই ১১টি গয়নার দোকানের মালিককেও আগে-ভাগেই ডেকে আনা হয়েছিল নিউ আলিপুর থানায়। ১১জন মিলে শনাক্ত করায় অপরাধ স্বীকার করে নেওয়া ছাড়া উপায়ান্তর ছিল না পবন-নীতেশ আর সুনীতা-প্রেম বাহাদুরের।
গোটা পরিকল্পনাটাই নীতেশ আর পবনের সাজানো। ছক অনুযায়ী পরিচারক সেজে সুনীল সিং-এর বাড়িতে ঢুকেছিল পবন। তারপর ১৮ লক্ষ টাকার গয়না চুরি করে পৌঁছে গেছিল কুলটিতে। সেখানে গয়না বেচার জন্য সুনীতা ও প্রেম বাহাদুরকেও কাজে লাগায় দু’জন। কিন্তু কোনও গয়নার দোকানেই গয়না বেচতে না পারায় বাধ্য হয়েই সমস্ত গয়না লুকিয়ে রেখেছিল পবন আর নীতেশ। ইতিমধ্যে পুলিশ খোঁজ শুরু করায় দু’জনেই পালিয়ে যায় পাঞ্জাব। ভেবেছিল, সেখানেই কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকবে। পরিস্থিতি ঠান্ডা হলে ফের কুলটি ফিরে গয়নার গতি করবে অন্যত্র। এত দ্রুত যে ধরা পড়ে যাবে, ভাবতেই পারেনি কেউ।
পবন আর নীতেশের উপস্থিতিতেই কুলটির ঘন্টি গলিতে তাদের ডেরা থেকে উদ্ধার হয় সমস্ত গয়না। শুধুমাত্র গয়না লুকিয়ে রাখবে বলেই এই ঘরটা তারা ভাড়া নিয়েছিল ২৩ অক্টোবর।