স্বাধীনতার ৭৬ তম বর্ষপূর্তিতে কৃষি সমৃদ্ধ এই জেলার বাসিন্দাগণ ও প্রশাসন স্বাধীনতা সংগ্রামীর বটুকেশ্বর দত্তের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করলেন

নিজস্ব সংবাদদাতা : ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগষ্ট ভারত স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। তবে এই স্বাধীনতা সহজে আসেনি।

    দেশ মাতৃকার অনেক বীর সন্তানদের আত্মত্যাগ ও আত্মবলিদানের মধ্য দিয়ে এসেছিল এই স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে রয়েছে পূর্ব বর্ধমান জেলার অনেক বীর সন্তানের নাম।

     

    তাঁরা ভারতকে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত করার শপথ নিয়ে বিপ্লবী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। সেই সব বীর বিপ্লবীদের মধ্যে অবশ্যই অগ্রগণ্য এই জেলার সদর দক্ষিণ মহকুমার বটুকেশ্বর দত্ত, রাসবিহারী বোস, রাসবিহারী ঘোষ ও অনিল বরণ রায়রা। এই চার দেশবরেণ্য বিপ্লবীর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের পাতায়। এঁরা ছাড়াও অবিভক্ত বর্ধমান জেলার আরও অনেকে আছেন যাঁদের অবদান গোটা দেশবাসী আজও মনে রেখেছে।দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পেরিয়ে গিয়েছে ৭৬ বছর। সারাটা বছর বর্ধমান জেলার স্বাধীনতা সংগ্রামীরা বিস্মৃতির অতলে রয়ে থাকেন ঠিকই। কিন্তু স্বাধীনতা দিবসে দেশভক্ত বর্ধমানবাসী কখনই ভোলেন না দেশ মাতৃকার জন্য জীবন উৎসর্গ করা জেলার মহান বিপ্লবীদের শ্রদ্ধা জানানোর কথা।

     

    ঐতিহাসিক তথ্য থেকে জানা যায়, লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে ১৯০৫ সালে সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে যে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল তার ঢেউ আছড়ে পড়েছিল বর্ধমান জেলাতেও। শুধু শহর বর্ধমানের মানুষজনই নয়, গ্রামীণ বর্ধমানের মানুষজনও সেই সময়ে সামিল হয়েছিলেন বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদ আন্দোলনে। তদানীন্তন সময়ে অবিভক্ত বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামের সন্তান কাজি নজরুল ইসলামের দেশাত্মবোধক গান ও কবিতা স্বাধীনতা আন্দোলনকে উদ্বুদ্ধ করেছিল।দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ১৯২৫ সালে বর্ধমানে এসে বর্ধমানের মহারাজা বিজয়চাঁদের আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে ইতিহাসবিদরা মনে করেন দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনেব বর্ধমানের গুরুত্ব কোনও অংশেই কম ছিল না। স্বদেশী আন্দোলন থেকে শুরু করে বিপ্লবী আন্দোলন, সবেরই উত্তরণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বর্ধমানের বিপ্লবীদের নাম। এই জেলার

    জ্যোতিন্দ্রনাথ বন্দ্যেপাধ্যায় যৌবনেই বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। পরে অবশ্য তিনি আধ্যাত্মিকতায় মনোনিবেশ করে ’নিরালঙ্গ স্বামী ’নামে পরিচিত হন। ১৮৭৬ সালে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ’ভারত সভা’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । সেই ’ভারত সভার’ তিনটি শাখা গড়ে উঠেছিল অবিভক্ত বর্ধমান জেলার বিভিন্ন প্রান্তে। ওই শাখাগুলি ’বর্ধমান শাখা’, ’কালনা শাখা’ ও ’পূর্বস্থলী হিতকরী সভা’ নামে আত্মপ্রকাশ করে।

     

    কালনার কবিরাজ বংশীয় উপেন্দ্রনাথ সেন ও দেবেন্দ্রনাথ সেনের উদ্যোগে কালনা ও কাটোয়ায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল বঙ্গভঙ্গ বিরোধী সভা। ঐতিহাসিক তথ্য থেকে জানা যায়, সেই সভায় স্বয়ং সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় উপস্থিত ছিলেন। কালনা মহকুমা ইতিহাস ও পুরাতত্ব চর্চা কেন্দ্রের সভাপতি সিদ্ধেশ্বর আচার্য্য দাবি করেন, ’স্বদেশী আন্দোলনের ঢেউ সেই সময়ে কালনার বাঘনা পাড়ার যুবক মহলে প্রভাব ফেলেছিল। ১৯০৬ সালে বিদেশী দ্রব্য লুঠ করে পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছিল কালনার বাঘনা পাড়ায়।সেই ঘটনায় ব্রিটিশ পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলেন কালনার গৌর গোবিন্দ গোস্বামী, মণিগোপাল মুখোপাধ্যায়, সন্তোষ বন্দ্যোপাধ্যায়, বৃন্দাবন গোস্বামী, বলাই গঙ্গোপাধ্যায় ও বলাই দেবনাথ। সিদ্ধেশ্বর বাবু দাবি করেছেন, “এইসব দেশ ভক্তদের গ্রেফতারি সংক্রান্ত মোকদ্দমাই ছিল বঙ্গে প্রথম রাজনৈতিক মোকদ্দমা“। তদানীন্তন সময়ে বাঘনা পাড়ায় স্বদেশী ভাণ্ডারও প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। ১৯৪২-এ ’’ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে বাঘনা পাড়ার যুবকরা সামিল হয়েছিলেন বলে সিদ্ধেশ্বর আচার্য্য জানিয়েছেন।

     

    জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে উৎসাহিত করার জন্য নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু দু’বার বর্ধমানে এসেছিলেন। ইংরেজ আমলে জাতীয় শিক্ষা নিয়েও বর্ধমান জেলা উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছিল। ইংরেজি বিদ্যালয়ের পরিবর্তে জাতীয় বিদ্যালয় স্থাপনে খণ্ডঘোষের তোরকোনার রাসবাবিহারী ঘোষ প্রভূত অর্থদান করেছিলেন। কালনা, বর্ধমান সদর, বৈকন্ঠপুর প্রভৃতি স্থানে জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ’বান্ধব সমিতি’, ’মহামায়া সমিতি’ প্রভৃতি নামে জেলার কালনা, পূর্বস্থলী ও মন্তেশ্বরে বিপ্লববাদী গুপ্তসমিতি গড়ে উঠেছিল। মানকরের জমিদার রাজকৃষ্ণ দীক্ষিত ও দুর্গাপুরের ভোলানাথ রায় সেই সময়ে স্বদেশী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে কারারুদ্ধ হন।

     

    স্বরাজ তহবিলের চাঁদা তোলার জন্যে ১৯২১-২২ সালে চিত্তরঞ্জন দাস বর্ধমানে এসেছিলেন। তাঁর আগমনের পরিপ্রেক্ষিতে বর্ধমান জেলায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ভিন্ন মাত্রা পেয়েছিল। জাতীয়তাবাদী কবিতা লোখার জন্য বর্ধমানের জামালপুরের গোপালপুর গ্রাম নিবাসী গোবিন্দরাম বন্দ্যোপাধ্যায়কে স্কুল থেকে বিতাড়িত হতে হয়েছিল। ১৯২২ সালের ৫ জানুয়ারি এই গোপালপুরের ইংরেজ বিরোধী মানুষজনের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা পায় ’গোপালপুর মুক্তকেশী বিদ্যালয়’। গান্ধিজীর অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিয়ে বিদ্যালয়ের প্রথম পরিচালন সমিতি এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত হয় , “ইংরেজদের নিয়ম মেনে রবিবার নয় – বিদ্যালয় ছুটি থাকবে সোমবার। সেই থেকে আজও রবিবার পুরোমাত্রায় পঠনপাঠন চালু থাকে গোপালপুর মুক্তকেশী বিদ্যালয়ে। সোমবার এই বিদ্যালয় ছুটি থাকে।“

     

    পরাধীন ভারতবর্ষের মাটিতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে ভিন্নমাত্রায় পৌছে দিতে বর্ধমানের মহিলারাও মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। এই বিষয়ে উল্লেখযোগ্যরা হলেন সুরমা মুখোপাধ্যায় ও নির্মলা সান্যালনাম। ১৯৩১ সালে কংগ্রেসের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বর্ধমান জেলা কৃষক সমিতি’। তদানীন্তন কালেই কৃষক সমিতির সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল।যে সভার সভাপতি হয়েছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত। তাঁর নামেই পরবর্তীকালে দর্ধমানের হাটগোবিন্দপুরে গড়ে ওঠে ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি মহাবিদ্যালয় ।

     

    রাজ্যের পঞ্চায়েত মন্ত্রী তথা বর্ধমান দক্ষিণ দামোদর এলাকার ভূমিপুত্র প্রদীপ মজুমদার বলেন, “দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে অবিভক্ত বর্ধমান জেলাবাসীর অবদান কোন অংশেই কম ছিল না। এই জেলার বটুকেশ্বর দত্ত ,রাসবিহারী বসু, রাসবিবাহী ঘোষ, অনিল বরণ রায় প্রমুখ দেশবরেণ্য বিপ্লবীর নাম দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। এঁনারা ছাড়াও জেলার আরও যারা দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন তাঁদের অবদানও জেলাবাসী মনে রেখেছে।তাই

    মঙ্গলবার স্বাধীনতার ৭৬ তম বর্ষপূর্তিতে কৃষি সমৃদ্ধ এই জেলার বাসিন্দাগণ ও প্রশাসন সকল স্বাধীনতা সংগ্রামীর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনে ব্রতি হবেন“ ।