|
---|
নরেন্দ্র মোদি সরকার কি তাহলে মহামারী সামলাতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ??
মহসীন বৈদ্য(চিকিৎসক): ছোটবেলায় শিয়াল পন্ডিত আর কুমিরের গল্প পড়েছিলাম। কুমির তার সাত ছানাকে শিয়াল পন্ডিতের কাছে পাঠিয়েছিল বিদ্যার্জনের জন্যে। শিয়ালপন্ডিত এক এক করে ছয়টা সাবাড় করে শেষ ছানাটা দিয়ে সাতবার দেখিয়েছিল তার মাকে। বোকা কুমির ভাবলো,বাহ সন্তানরা তো দারুন লেখাপড়া শিখছে!
আমাদের ও অবস্থা কিছুটা কুমিরের মতো। শিয়াল পণ্ডিত সরকার দেখাচ্ছে কোরোনা আক্রান্ত মাত্র 6705(এখন অব্দি),অথচ বিখ্যাত প্রয়োগিত অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক স্টিভ হ্যাঙ্ক বলছেন সংখ্যাটা আসলে কল্পনাতীত,75000+! না,তিনি পাড়ার মোড়ের চা দোকানে ঝড় তোলা কোনো ‘বিশিষ্ট’ বিশ্লেষক বা কোনো বাজারি পত্রিকার ঘণ্টাখানেকের দুশমন নন, দ্য জনস হপকিন্স ইনস্টিটিউট ফর এপ্লায়েড ইকোনমিক্স , গ্লোবাল হেলথ এবং স্টাডি অফ বিজনেস এন্টারপ্রাইজের সহ-পরিচালক ও ফোর্বস ম্যাগাজিনের কলামিস্ট। তিনি ও তাঁর টিম কোরোনা নিয়েও কাজ করছেন।
ভয় পেলেন? হুঁ, ভয় পান,আরেকটু ভয়। আপনি ভাবছেন কেনো, আমরা এতদিন লকডাউন মেনে চলছি, মাঝে মাঝে কোরোনা নিধনে থালা ঘন্টা বাজাচ্ছি,বাতি বাজি জ্বালাচ্ছি,ফাটাচ্ছি,সাথে “কোরোনা গো ব্যাক” যোগে মিছিল ও করছি,তাতেই তো কোরোনা জব্দ হয়ে যাওয়ার কথা! আর সেজন্যেই তো নাম্বার টা 6705!
তাই যদি ভাবেন মশাই,তাহলে আপনি ও হয়তো কুমিরের মতো শিয়ালপণ্ডিত কে বিশ্বাস করেই গদ গদ চিত্তে মহানন্দে বিশ টাকার মাস্ক পরে এখনো সকাল সকাল বাজার দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। মনে রাখবেন শিয়াল পন্ডিত কিন্তু খুব ধূর্ত,সে যা দেখিয়েছিল সরলমতি কুমির তাই ই বিশ্বাস করেছিল আর আপনাকেও যা দেখানো হচ্ছে,শোনানো হচ্ছে আপনি তাই ই বিশ্বাস করছেন। সাথে মনে রাখবেন লকডাউনের মধ্যেই কিন্তু গাজিয়াবাদে হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমজীবী মানুষ জড়ো হয়েছিলেন,তারা এতদিনে কেউ কেউ বাড়ি ফিরেছেন,কেউবা এ জীবনের যাত্রাই সমাপ্ত করে পাড়ি দিয়েছেন পরের অনন্ত জীবনে! এর মধ্যেই ছোটখাটো অনেক মিছিল বেরিয়েছে কোরোনা বধের উল্লাসে,রামনবমীর মিছিল হয়েছে বহু প্রান্তে,নিজামুদ্দিন,তিরূপতি থেকেও সব ফিরে গেছেন যে যার মহল্লায়। তারসাথে যোগ করুন কয়েক লাখ প্রবাসী ভারতীয় ও,যারা বিনা পরীক্ষায় আপনার আমার এলাকাতে ফিরে এসেছে,সংক্রমণের শুরু টা তাদের থেকেই।
এবার আসি সংখ্যাটা বেশি হলেই বা,তাতে চিন্তার কি? চিন্তার এজন্যেই যে,এত বেশি আক্রান্ত মানে ইতিমধ্যেই কমিউনিটি সংক্রমণ শুরু হয়ে গেছে। সে আবার কি জিনিস? এই যে আপনি এখন সারাদিন বাড়িতে বসে বোর হচ্ছেন,তাই দরকার না থাকলেও কিন্তু থলে হাতে সপ্তাহে 3-4 বার করে বাজারে ছুটছেন সকাল সকাল। হাট বারে গ্রামের দিকে 3 ঘন্টার জন্যে হাট বসছে,আর ঠিক ওই 3 ঘন্টাতেই আশেপাশের সব গ্রাম থেকে হাজার হাজার লোক আসছে,ভয় টা এখানেই। একই ভিড় হচ্ছে ব্যাংকে,রেশনে। সোস্যাল ডিস্ট্যান্সিং বহু ক্ষেত্রেই আমরা মানছি না,মাস্ক টা খুলেই হাঁচছি বা কাশছি। আর এভাবে আমরা যত ঘরবন্দী দশা থেকে মুক্ত হয়ে একটু হাওয়া খেতে বেরোব, ততই একের থেকে অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে এই মারণ ভাইরাস। ICMR এর দেওয়া কালকের তথ্য বলছে 38.3% পসিটিভ কেসের কোনো সদ্য বিদেশ ভ্রমণের ইতিহাস নেই। মানে….? ভালোমতোই কমিউনিটি সংক্রমণ হচ্ছে।
আপনি বলবেন,আক্রান্ত সংখ্যাটা তাহলে এত কম কেন? খুব সহজ। কোরোনা আক্রান্তের যে লক্ষণ গুলো দেখা যায় তা হলো জ্বর, সর্দি, শুকনো কাশি,গা ব্যথা, শাসকষ্ট। কিন্তু এগুলো প্রকাশ পেতে কয়েকদিন কেটে যায়,আবার অনেকে সংক্রামিত হলেও রোগলক্ষন নাও থাকতে পারে! আর আমাদের এখানে এখনো পর্যন্ত রোগলক্ষন দেখে তারপর পরীক্ষা হচ্ছে। আর বিপদ টা ঠিক এখানেই! ফলতঃ রোগের প্রাথমিক দশায় বা যার রোগলক্ষন প্রকাশ পেল না,সে কিন্তু নিজের এবং আপনার অজান্তেই হাটে বাজারে,ব্যাংক রেশনের লাইনে,মোড়ের মাথার আড্ডায় নিঃশব্দে নীরবে ছড়াতেই থাকলো!! আর আপনিও বাইরের হাওয়া খেতে বেরিয়ে নিজের সাথে পরিবারের সবাইকে সংক্রামিত করে ফেললেন না তো…..ভাবুন,আরেকটু ভয় পান!
প্রতি মিলিয়নে(10 লক্ষ) দেশভিত্তিক পরীক্ষাহার লক্ষ্য করলে ব্যাপারটা আরেকটু সহজবোধ্য হবে।
UAE 22244, হং কং 12900, ইতালি 11436,সিঙ্গাপুর 11100,সাউথ কোরিয়া 9310, USA 6336,UK 2880,পাকিস্তান 191
ভারতবর্ষ : মাত্র 102
মানে UAE তে যেখানে প্রতি 10 লক্ষ জনতার জন্যে 22244 টি পরীক্ষা হয়েছে, ইতালীতে 11436,আমেরিকায় 6336,আমাদের দেশে কেবল 102 টি! কথায় কথায় নেতারা পাকিস্তানের তুলনা টানে,অথচ কি হাস্যকর আমরা নাকি তাদের থেকেও পিছিয়ে!
এখন কোথাও একটা পসিটিভ কেস পাওয়া গেলে তাকে হসপিটালে ভর্তি করা হচ্ছে আর তার সংস্পর্শে কারা কারা এসেছে তাদেরকে খুঁজে আইসলেশনে পাঠানো হচ্ছে,ভালো কথা। কিন্তু বিপদের শেষ যে এখানেই না। ধরুন 1টা পসিটিভ কেসের 2 টো কন্ট্যাক্ট পসিটিভ পাওয়া গেলো,তারা যে আরো কতজনকে,সেই কজন আরো আরো কতজনকে সংক্রামিত করছে সেটা এভাবে খুঁজে বের করা সম্ভব নয়,যতক্ষন না গণহারে টেস্টিং হচ্ছে। আর তার ফল ও দেখছেন। সবে থার্ড স্টেজে ঢুকছি আমরা,এরমধ্যেই অনেক হাসপাতালে বহু ডাক্তার,নার্স,স্বাস্থ্যকর্মী কিন্তু কোয়ারান্টিনে চলে গেছেন। এভাবে চললে বেশি না,আর কয়েকটা দিন অপেক্ষা করুন হাসপাতালগুলোতে পরিষেবা দেওয়ার ই লোক থাকবে না!
তাই আবারো বলি,চা কাকু কে নিয়ে অনেক খিল্লি হলো,নিজামুদ্দিন নিয়ে অনেক নাটক,দোষারোপ হলো….আর নয়! এ যে জীবন মরণের যুদ্ধ! কোরোনা যে রং ধর্ম দেখেনা, টাকা পয়সাও দেখে না। এখনো সময় আছে,দল মত ধর্ম গোত্র নির্বিশেষে,শাসক বিরোধী,ধনী গরিব নির্বিচারে সবাই দাবী তুলুন পর্যাপ্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে,দাবী তুলুন স্বাস্থকর্মীদের যথেষ্ট সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে,দাবী তুলুন দিন আনা দিন খাওয়া মানুষগুলোর ক্ষিদে মেটানোর সুরাহা করতে। আর যদি ভাবেন,আমার কি! আমার তো 6 মাসের চাল ডাল তোলা আছে,পাঁচতারা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার মতো বস্তা বস্তা টাকা আছে…তাহলে বড় ভুল করবেন। পেটের জ্বালা যে সংক্রমণের ভয় মানেনা,আপনার চাল ডালের বস্তাগুলো নিরাপদে থাকবে তো? ডাক্তার নার্স কর্মীরা সব অসুস্থ হলে আপনার টাকা আপনার চিকিৎসা করবে তো?
কোরোনা যে ঘাড়ের ওপর নিশ্বাস ফেলছে! এখনো সময় আছে….একটু ভাবুন,আরো একটু বেশি ভয় পান! নতুবা আরেকটা ইউরোপ বা আমেরিকার মতো মৃত্যুপুরী চাক্ষুস করতে,স্তূপীকৃত মরদেহের পাহাড়ে সামিল হতে প্রস্তুত হন!!
মহসীন বৈদ্য
10/04/2020