ঋণ জর্জরিত রাজ কাপুর রাজেশ খান্নার ফি জোগাড় করতে পারেন নি ,বাধ্য হয়ে ববিতে নায়ক ঋষি কাপুর |

দুই নক্ষত্র রেখে গেলেন দুই ধারার আলো 

    বিপ্লব দাশ:দেশ যখন করোনা আবহ নিয়ে চিন্তিত তখনই চির ঘুমের দেশে চলে গেলেন ভারতবর্ষের চলচ্চিত্র জগতের দুই নক্ষত্র। বুধবার ৫৪ বছরে মৃত্যু হল ইরফান খানের এবং বৃহস্পতিবার ৬৭ বছরে বিদায় নিলেন ঋষি কাপুর। নিয়তির পরিহাসে দুজনেই দুরারোগ্য ক্যান্সারে  আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।

    ভারতীয় চলচ্চিত্র মহলের সঙ্গে শোকের ছায়া সারা দেশে। দুই শিল্পীর মৃত্য়ুতে  শ্রদ্ধাঘ্য জানাতে ফিরে দেখা এই দুই শিল্পীর চলচ্চিত্র জগতের উজ্জ্বল অবদান।

    ১৯৫২ সালে ৪ সেপ্টেম্বর মহারাষ্ট্রের চেম্বুরে ঋষি কাপুর জন্মগ্রহণ করেন। পিতা রাজ কাপুর ছিলেন অভিনেতা ও পরিচালক। ঋষি কাপুরের যখন মাত্র তিন বছর বয়স, সেইসময় শ্রী ৪২০ ছবিতে “প্যায়ার হুয়া, ইকরার হুয়া হ্যায়” গানটিতে তাঁর প্রথম অন-স্ক্রিন উপস্থিতি দেখা যায়।  এরপর ১৯৭০ সালে রাজ কাপুর নির্মিত ছবি মেরা নাম জোকারের মাধ্যমে তিনি প্রথম শৈশব চরিত্রে অভিনয়ে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৭৩ সালে ডিম্পল কাপাডিয়ার বিপরীতে প্রথম নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন ববি ছবিতে। সেই ছবিটি পরিচালনা করেন তাঁর বাবা রাজ কাপুর। ২০১২ সালের একটি সাক্ষাৎকারে ববি ছবিতে তাঁর অভিনয় প্রসঙ্গে ঋষি কাপুর বলেছিলেন, “ববি ছবিটি তৈরি সম্পর্কে একটি ভুল ধারণা ছিল চলচ্চিত্র প্রেমীদের। এই ছবিটি নাকি আমাকে অভিনেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। আসলে ঘটনাটি তা নয়, ছবিটি আসলে মেরা নাম জোকার ছবির ঋণ পরিশোধের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। বাবা রাজ কাপুর এই ছবিটি একটি কিশোরী প্রেমের গল্প বানাতে চেয়েছিলেন। এবং ছবিতে রাজেশ খান্নাকে কাস্ট করার কথাও ভেবেছিলেন। কিন্তু ঋণ দায় এত বেশি ছিল যে রাজেশ খান্নাকে টাকা দেওয়ার মতো ক্ষমতা সেই সময় বাবার ছিল না, তাই বাধ্য হয়ে আমাকে অভিনেতা হিসেবে কাস্ট করেন বাবা। এই ছবিটি ভারতের সাতের দশকের শুধু নয়, দেশের প্রেমের ছবির ইতিহাসে অল টাইম  হিট হয়ে উঠেছিল। এ জন্য তিনি ফিল্মফেয়ার সেরা অভিনেতার পুরস্কারও পান।

    ৭০-এর দশকে একাধিক ছবিতে কৌতুক অভিনেতাদের মধ্যে তিনি মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। যার মধ্যে অন্যতম ১৯৭৫ সালে নীতু সিংয়ের সঙ্গে রাফু চক্কর, ১৯৭৭ সালে অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে অমর আকবর অ্যান্টনি, ১৯৭৫ সালে খেল খেল মে এবং ১৯৭৭ সালে জিনাত আমানের সঙ্গে হাম কিসিসে কাম নাহিন। অন্যদের মধ্যে তিনি নীতু সিংহের সঙ্গে কাজ করেছিলেন, পরে তিনি ১৯৮০ সালে বিয়ে ও করেছিলেন। ১৯৭৪ সালে জহরীলা ইনসান, ১৯৭৬ সালে দম্পতি কাভি কাভি এবং ১৯৭৬ সালে দুসরা আদমী-সহ একাধিক ছবিতে পর্দা ভাগ করে নিয়েছিলেন। তিনি বহু ছবিতে রোমান্টিক চরিত্রে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন। যার মধ্যে চাঁদনী, কুলি, এবং করোবার-এর মতো ছবিগুলো হিট হয়। ১৯৯৯ সালে পরিচালক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন, আ আব লাউট চ্যালে ছবিতে।

    চলচ্চিত্রে অভিনয় করার সুবাদে পেয়েছেন প্রচুর পুরস্কার। ১৯৭০ সালে মেরা নাম জোকার ছবির জন্য তিনি ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড ও বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন অ্যাওয়ার্ড পান। ১৯৭৪ সালে ববি ছবির জন্য পান বেস্ট ফিল্ম ফেয়ার অ্যাওয়ার্ড। ২০০৮ সালে ফিল্মফেয়ার লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। এছাড়া আরও অনেক পুরস্কার তাঁর ঝুলিতে।

    ২০১৮ সালে ঋষি কাপুরের বোনের ক্যান্সার ধরা পড়ে। চিকিৎসার জন্য নিউ ইয়র্ক সিটি যান। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে সফল চিকিৎসার পরে, ২০১৯ সালে ২৬ সেপ্টেম্বর দেশে  ফিরে আসেন। শ্বাসকষ্টের অসুবিধে হওয়ায় ২৯ এপ্রিল বুধবার মুম্বাইয়ের স্যার এইচ এন রিলায়েন্স ফাউন্ডেশন হাসপাতালে ভর্তি হন। বৃহস্পতিবার ৩০ এপ্রিল সকালেই তিনি মারা যান। তাঁর মৃত্যুতে শোকের ছায়া নামে বলিউডে, এবং গোটা দেশ বিদেশে ছড়িয়ে থাকা কোটি কোটি ভক্তদের মধ্যে ।

    বুধবারই মুম্বইয়ের কোকিলাবেন হাসপাতালে মৃত্যু হয় অভিনেতা ইরফান খানের। ক্যান্সারে  আক্রান্ত ছিলেন। কোলন সংক্রমণ নিয়েই গত মঙ্গলবার ভর্তি হন হাসপাতালে। গত শনিবারই মা সইদা হোসেনের মৃত্য়ু হয় জয়পুরে। লক ডাউন চলায় শেষকৃত্য়ে যেতে পারেননি। শেষ শ্রদ্ধা জানান ভিডিও কলের মাধ্যমে। নিয়তির পরিহাসে চারদিনেই তিনি মায়ের কাছে পাড়ি দিলেন।

    ক্রিকেটার হতে চাওয়া ইরফান অভিনয় জগতে হয়ে উঠেছিলেন অলরাউন্ডার। অভিনয়ে কনটেন্টই তাঁর মূল অস্ত্র। ১৯৮৫ সাল থেকে ২০২০ সাড়ে তিন দশকের অভিনয় জীবনে বরাবরই এই কনটেন্টই ছিল তাঁর সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।  হলিউডের অনেকগুলো ছবিতেই তাঁর সাবলীল অভিনয় নজর কাড়ে  বিশ্বচলচ্চিত্রপ্রেমীদের। স্লামডগ মিলিয়োনেয়ার থেকে লাইফ অফ্ পাই, দ্য নেমসেক, লাইফ ইন আ মেট্রো, নিউ ইয়র্ক আই লাভ ইউ থেকে জুরাসিক ওয়ার্ল্ড। বলিউডে তাঁর ছবির তালিকাও বেশ ইর্ষা করার মতো। মকবুল, হায়দার, পান সিং তোমর, হাসিল, দ্য লাঞ্চ বক্স, তলোয়ার, পিকু, আংরেজি মিডিয়াম  চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। টেলি সিরিয়ালে ও তাঁর উপস্থিতি ছিল লক্ষ্যণীয় বেশ দীর্ঘ তাঁর অভিনয় জীবনে- চন্দ্রকান্তা, বনেগি আপনি বাত, চাণক্য়, ভারত এক খোঁজ।

    ২০১১ সালে পান পদ্মশ্রী পুরস্কার। ২০১২ সালে পান সিং তোমর ছবিতে সেরা অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার পান। কেউ যদি বলিউড ফিল্মে খান ভাইদের সঙ্গে তাঁর তুলনা করলে তিনি বলতেন, আমি খান নই, আমি শুধু ইরফান। বাঙালি স্ত্রী সুতপা ও দুই পুত্র বাবিল ও আয়ান। ২০১৮ সালে নিউরো এন্ডোক্রাইম টিউমার ধরা পড়ে। চিকিৎসার পাশাপাশি আংরেজি মিডিয়াম ছবিতে অভিনয়ও করেছিলেন। তার মৃত্যুতে অপূরণীয় ক্ষতি হলো চলচ্চিত্র জগতের।

    তথ্যসূত্র :বার্তা সাম্প্রতিক