|
---|
সিরিয়া সন্ধানে
কলমে:মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ
বর্তমানে সিরিয়া আন্তর্জাতিক শক্তি সমূহের কুদৃষ্টিতে পড়েছে। প্রায় প্রতিটি দেশ সিরিয়াকে নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের খেলায় মেতে উঠেছে,কেউ তাদের নতুন আবিষ্কৃত অস্ত্রের পরীক্ষা চালানোর ক্ষেত্রভুমিতে পরিণত করেছে, কেউ আবার তাদের শক্তি সামর্থ্যের প্রদর্শন করার ক্ষেত্রভুমি হিসেবে বেছে নিয়েছে এই পবিত্র ভূমিকে।প্রায় প্রতিটি দেশই সিরিয়া কে ধ্বংস-যজ্ঞের কেন্দ্রভূমিতে পরিণত করেছে।সিরিয়ায় প্রকৃতপক্ষে কি হচ্ছে সেটা বিশ্ব জানতে পারে না কারণ আন্তর্জাতিক শক্তি সমূহ তাদের অসভ্যতা, নির্লজ্জতা, কাপুরুষতার চিত্র ও উদ্দেশ্য পশ্চিমা মিডিয়াতে প্রকাশ করতে দিচ্ছে না।আজ পশ্চিমা মিডিয়ার ক্যামেরা
সিরিয়ার শিশুদের ও মহিলাদের করুন কান্নার দৃশ্যাবলী বন্দি করতে অপারগ।তারা শুধু আলকায়েদা, তালিবান, বুকোহারাম,হিজবুল্লাহ ইত্যাদির মত ইসলামী সন্ত্রাসীদের কথা বলে প্রকৃত সত্য ঢেকে রাখতে চাচ্ছে। সিরিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি বুঝতে চাইলে সিরিয়ার ইতিহাস জানতে হবে, সিরিয়ায় কাদের স্বার্থ আছে এবং কি তাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য তা জানতে হবে। সিরিয়ার আদি ইতিহাস না জানলে সিরিয়া সম্পর্কে বেশি কিছু বোধগম্য হবে না।তাই নিম্নে সিরিয়ার ইতিহাস সংক্ষেপে আলোচনা করা হল:-
সিরিয়া মধ্যপ্রাচ্যের একটি একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্র। আয়তন প্রায় ৭১,০৬২ বর্গমাইল। সিরিয়ার রাজধানী ও প্রধান শহর হল দামেস্ক ।সিরিয়ার প্রধান ধর্ম হলো ইসলাম। এখানকার প্রায় সাতানব্বই শতাংশ মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী,দশ শতাংশ মানুষ খ্রিস্ট ধর্ম অনুসারি ও তিন শতাংশ মানুষ দ্রুজ।দেশটির সকল জেলাতে ইসলাম ধর্মের মানুষের সংখ্যা বেশি।সিরিয়ার সরকারি ও প্রধান ভাষা হল আরবি। এখানকার প্রায় চার-পঞ্চমাংশ লোক আরবি ভাষাতে কথা বলে। সিরিয়াতে প্রচলিত অন্যান্য ভাষার মধ্যে আদিজে ভাষা, আরামীয় ভাষা,আর্মেনীয় ভাষা, আজারবাইজানি ভাষা, দোমারি ভাষা (রোমানি ভাষা), কুর্দি ভাষা এবং সিরীয় ভাষা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।কিন্তু আন্তর্জাতিক কাজকর্মে বিশেষ করে ফরাসি ভাষা ব্যবহার করা হয়।
এখানকার মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা নানান ভাগে বিভক্ত এবং জাতিগতভাবে ভিন্ন।এই ভিন্নতার কারণে জাতিগতভাবে নানান সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় সিরিয়া বাসীকে।সিরিয়ায় মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সুন্নি মুসলমানদের আধিক্য দেখা যায়। এছাড়াও শিয়া আবার, শিয়াদের মধ্যে আলাউয়িদের প্রাধান্যই বেশি। এরপরেই রয়েছে ইসমাইলি এবং দ্বাদশবাদি । আবার, সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে কুর্দি ও তুর্কমেন আলেভি জাতির বাস দেখা যায়।
বিশ্বের দরবারে সিরিয়ার গুরুত্ব শুধু ভৌগলিক কারণে নয়,রাজনৈতিক,আন্তর্জাতিক ও ধর্মীয় কারণেও।সিরিয়ার ইতিহাস তার ঐতিহ্যকে অতি সমৃদ্ধ করেছে। আরবরা সিরিয়া এলাকাকে “বালাদে শাম” বলে থাকেন, সেই নবী মোহাম্মদ (স:) -এর পূর্ববর্তী সময় থেকে এই খুবই উন্নত ব্যাবসা-বাণিজ্যর দিকে।সিরিয়ার আদি নাম শাম, যা ভারতীয় উপমহাদেশের বুদ্ধিজীবীদের কাছে শাম দেশ নামে পরিচিত। পবিত্র কোরআন শরীফে সিরিয়ার কথা উল্লেখ পাওয়া যায়।পবিত্র কোরআনের সুরা রুমের শব্দগুচ্ছ “ফি আদনাল আরদি” যার অর্থ নিকটস্থ নিম্ন এলাকার দেশ হল সিরিয়া।সেই আদি কাল থেকে সিরিয়াতে মানব ইতিহাসের প্রধান প্রধান সভ্যতার চূড়ান্ত সংঘাতগুলি ঘটেছে।সিরিয়ার ভূমি অনেক যুদ্ধের সাক্ষী স্বরুপ।সেটি যেমন ইরানীদের সাথে গ্রীক ও রোমানদের, তেমনি খৃষ্টানদের সাথে মুসলমানদের।এই সিরিয়ার ভূমিতেই মুসলমানগণ তৎকালীন বিশ্বশক্তি রোমানদের পরাজিত করে প্রধান বিশ্বশক্তি রূপে আবির্ভূত হয়েছিল। মুসলিম বীর সালাউদ্দিন আয়ুবীর কথা কে না জানে ?তিনি তাঁর বীরদর্পে এ পবিত্র ভূমিতেই ইউরোপীয় ক্রসেডার বাহিনীকে পরাজিত করে মুসলিমদের হৃতগৌরব ফিরিয়েছিলেন।বলা বাহুল্য যে বিশ্বশক্তির পটপরিবর্তন কেন্দ্র হিসেবেও সিরিয়া সর্বদাই ব্যবহৃত হয়েছে।
ইসলামের হাদিসের দিকে উঁকি মেরে দেখলে, সিরিয়ার ও ইসলামের আদি সম্পর্কের প্রমাণ স্বরূপ অনেক হাদিসের সন্ধান পাওয়া যায়।
সিরিয়া অঞ্চল ইসলামি সভ্যতার প্রাচীন ভূমি। ইসলামের ইতিহাসে পৃথিবীর বেশিরভাগ নবী-রাসুল এ অঞ্চলেই আগমন করেছেন। মানব সভ্যতার সুচনা হয় এখান থেকেই।
সিরিয়া সম্পর্কে নবী (সা.)-এর অনেক হাদিসও আছে। শাম দেশ বলতে বর্তমানে সিরিয়াকে বোঝালেও এর প্রাচীন সীমানা বর্তমান সিরিয়া থেকে আরও বিস্তৃত ও বড় ছিল।যেমন সিরিয়া, জর্ডান, ফিলিস্তিন ও লেবানন- এই দেশগুলো মিলেই ছিল পূর্বযুগের শাম। এই সিরিয়ার প্রধান ও অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো আল্লাহপাক যুগে যুগে যত নবী ও রাসূল এই ধরাই পাঠিয়েছেন তার বড় একটি অংশকেই এই সিরিয়ায় বা শামদেশে পাঠিয়েছেন। শাম বা সিরিয়ার এই পবিত্র ভূমি হবে কিয়ামতের মাঠ যেখানে স্বয়ং মহান আল্লাহ মানুষের পাপ-পুণ্যের হিসেব করবেন। সিরিয়ার এই পবিত্র ভূমিতে উন্নয়নশীল,উন্নতশীল, ও অনুন্নত দেশের সমস্ত জাতির মানুষেরা কিয়ামতের দিন উপস্থিত হবে।ইসলামের দৃষ্টিতে মক্কা ও মদিনার পরে গুরুত্বপূর্ণ ও পবিত্র ভূমি হল সিরিয়ার ভূমি।তাই সিরিয়াকে বলা যেতে পারে মানব সভ্যতার সুতিকাগার। কিন্তু সেই সিরিয়াতেই আজ মানবতা মুখ থুবড়ে পড়ছে, ভূমধ্যসাগরেই ঘটছে মানবতার ভরাডুবি।
সিরিয়ার অন্তদ্বন্দের প্রধান কারণ হল
বিভিন্ন ফির্কা পরিস্তিতি।নিম্নে সিরিয়ার বিভিন্ন ফির্কা অর্থাৎ স্বধর্মের ভাগগুলোনিয়ে আলোচনা করা হল:-
সুন্নি মুসলিম:
সুন্নি মুসলিমরা ইসলাম ধর্মের মধ্যে সবচেয়ে বড় ও প্রাচীন সম্প্রদায়। সুন্নিদের আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’য়াত বা সংক্ষেপে আহল আস-সুন্নাহ বলা হয় । সুন্নি শব্দের উৎপত্তি আরবি শব্দ ‘সুন্নাহ’ থেকে যার অর্থ নবি মুহাম্মদ (স:)-এর বাণী ও কর্মকে বুঝায়। নবি মুহাম্মদ(স:)-এর জীবিত অবস্থায় সুন্নি বা শিয়া বা অন্য কোনো নামে কোনো সম্প্রদায় ছিল না। সুন্নিরা ইসলামের সেই অংশের প্রতিনিধিত্ব করে যারা নবি মুহাম্মদ(স:)-এর মৃত্যুর পর সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নির্বাচিত খলিফা আবু বকরকে মেনে নিয়েছিল। তাই প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থায় ‘খলীফা’ নির্বাচন বা ‘শুরা’ সুন্নি ইসলামের একটা বড় বৈশিষ্ট্যগুলোর একটি। অধিকাংশ সুন্নি মুসলিমরা নিজেদের সুন্নি আইনের চারটি মাজহাবের অর্থাৎ হানাফি, মালিকি, শাফিয়ি ও হানবালির যে কোনো একটির অনুসরণ করেন। এর বাইরেও কয়েকটি সংখ্যালঘু সুন্নি মাযহাব পরিলক্ষিত হয়।সিরিয়ার মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ মুসলিম হল সুন্নি।সিরিয়ার সুন্নিরা বেশির ভাগই শাফিঈ মাযহাবের অনুসারী, যা কিছুটা হানাফি ও হানবালির সাথে মিলে যায়। কিছু বড় বড় সুফি নিয়মকানুন দেশটির পুরোটা জুড়ে রয়েছে। যেমন কাদেরিয়া ,তরিকা, নাথিং, নকশবন্দি ইত্যাদি।
শিয়া মুসলিম:
শিয়া মুসলিম যাদেরকে ইসলামের দ্বিতীয় বৃহত্তম সম্প্রদায় হিসেবে গণ্য করা হয়। শিয়া ইসলাম অনুসরণকারীদের শিইতি বা শিয়া বলা হয়। ‘শিয়া’হল ঐতিহাসিক বাক্য ‘শিয়াতু আলি’ এর সংক্ষিপ্ত রূপ, যার অর্থ হল ‘হজরত আলির অনুগামী’ বা ‘হজরত আলির দল’। শিয়া মতবাদের মূল ভিত্তি হলো, আলি এবং ফাতিমার বংশের মাধ্যমে নবি পরিবারের (আহলে বাইত) লোকেরাই হলেন ইমামত বা নেতৃত্বের প্রধান দাবীদার; তাই আলি খিলাফতের প্রশ্নে আবু বকর, উমর ও উসমানের মুকাবেলায় অগ্রাধিকারী। শিয়ারা বিশ্বাস করে ইসলামের সর্বশেষ নবী ‘গাদির খুমের’ ঘটনার মাধ্যমে তাকেই খিলাফতের জন্য মনোনীত করে গিয়েছিলেন। আবু বকর ছিলেন বনু তাইম গোত্রের, উমর বনু আদি গোত্রের, উসমান বনু উমাইয়া গোত্রের কিন্তু আলি মুহাম্মদের হাশেমি গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া আলি একাধারে প্রথম পুরুষ মুসলিম, মোহাম্মদ রাসুল্লাহ (সা:)-এর আপন চাচাতো ভাই ও রাসুলের জামাতা, রাসুলের দৌহিত্র হাসান ও হোসেনের পিতা ও রাসুলের সেনাপতি ছিলেন। রাসুলের কোনো পুত্রসন্তান ছিলনা এবং দৌহিত্রা (হাসান, হোসেন) শিশু ছিলেন। এসবদিক বিবেচনায় রাসুলের ইন্তেকালের পর আলিই নেতৃত্বের সর্বাধিক যোগ্য বলে শিয়া মুসলিমগণ মনে করেন। তারা আলি ও মুয়াবিয়ার মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধেও আলিকে সমর্থন করেন। পরবর্তীতে মুয়াবিয়ার পুত্র ইয়াজিদের সেনাবাহিনী আলির পুত্র হোসেনকে হত্যা করলে শিয়া মুসলিমরা খিলাফতের প্রতি পুরোপুরি আস্থা হারিয়ে ফেলে এবং হোসেনপুত্র জয়নুল আবেদিনের মাধ্যমে আলি ও ইসলামের রাসুলের বংশধরদের মধ্যে থেকে ইমামতের নীতি অনুসরণ করতে থাকে।
ইসলামের অন্য সব নিয়মাবলির মতো, শিয়া মুসলিমরা ইসলামিক ধর্মগ্রন্থ, পবিত্র কুরআন এবং ইসলামের সর্বশেষ নবী-এর জীবনাদর্শের উপর প্রধান আরোপ করে।কিন্তু তাঁরা আব্বাসিয় শাসনামলে প্রায় তৃতীয় হিজরীতে সংকলিত সিহাহ সিত্তাহ হাদিসের তুলনায় আহলে বাইতের নিকট থেকে প্রাপ্ত হাদিস সমূহকে অধিকতর গ্রহণযোগ্য মনে করে। শিয়া মুসলিমরা বিশ্বাস করে যে, শুধুমাত্র আল্লাহই ইসলাম,কুরআন এবং শরিয়াত রক্ষা করার জন্য একজন প্রতিনিধি (নবী এবং ইমাম) নির্বাচন করতে পারেন যা সাধারণ মুসলমানরা পারে না। যার কারণে শিয়ারা ইসলাম এবং কুরআনের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য জনগণ যে আবু বকর, উমর এবং উসমানকে নির্বাচন করেছেন তা অনুসরণ করে না। এই জন্য শিয়ারা আলিকে চতুর্থ খলিফা হিসেবে বিবেচনা করে না, বরং প্রথম ইমাম হিসেবে বিবেচনা করেন। শিয়ারা বিশ্বাস করে যে, অনেক বর্ণনা রয়েছে যেখানে ইসলামের নবী তার উত্তরাধিকারী হিসাবে আলিকে নির্বাচিত করেছিলেন।সিরিয়ার মোট জনসংখ্যার ১২ শতাংশ শিয়া মুসলিম বসবাস করে।এমনকি ইরান, ইরাক, বাহরাইন, আজারবাইজান, লেবানন, ইয়েমেন ইত্যাদি দেশে শিয়ারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাছাড়া সিরিয়া, কুয়েত, জর্ডান, ফিলিস্তিন, সউদি আরব, ভারত, পাকিস্তানেও প্রচুর শিয়া মুসলিমদের বসবাস পরিলক্ষিত হয়।সিরিয়ার সবেক রাষ্ট্রপতি হাফিজ আল আসাদ ও বর্তমান রাষ্ট্রপতি তাঁর পুত্র বাসার আল আসাদ শিয়া ধর্মাবলম্বী।সিরিয়ার শিয়ারা বারোটি ইমামে বিশ্বাসী, তাঁরা হলেন ইমামুল মুত্তাকীন আলি,ইমাম হাসান মুজতাবা,ইমাম আবু আব্দিল্লাহ হোসাইন,ইমাম সাজ্জাদ আলি জয়নুল আবেদিন,ইমাম মোহাম্মদ বাকির ইবনে আলি,ইমাম আবা আব্দিল্লাহ জাফর সাদিক,ইমাম আবুল হাসান মুসা কাজিম,ইমাম আবুল হাসান আলি রেজা,ইমাম মোহাম্মদ জাওয়াদ ত্বকি,ইমাম আলি নাকি ইবনে মোহাম্মদ,ইমাম আবু মোহাম্মদ হাসান আস্কারি ওআয়ুহাল কায়েম মুন্তাযারাল মাহাদী